রাবি ভিসির ১৯৭৩ সালের অ্যাক্ট, স্ট্যাটিউটস ও অর্ডিন্যান্স লঙ্ঘন
- ড. মু. আলী আসগর
- প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২১, ০৭:২৫ PM , আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২১, ০৭:২৫ PM
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক প্রধানকে বলা হয় ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি)। কিন্তু এই পদটির মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হতে হতে এমন স্তরে পৌঁছেছে যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভিসির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করার জন্য অভিযুক্ত ও অভিযোগকারী- উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তদন্ত কমিটি উন্মুক্ত শুনানির ব্যবস্থা করে্ন এবং ভিসির অনিয়মের সত্যতা প্রমাণ পায়।
ইউজিসির তদন্ত কমিটি সরকারকে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইউজিসির তদন্ত রিপোর্টের সত্যতা পেয়ে গত বছরের ১০ ও ১৩ ডিসেম্বর কিছু বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করেন ও কিছু বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদত্ত ১৯৭৩ সালের অ্যাক্ট দ্বারা পরিচালিত। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, রাবি ভিসির বাসভবনে তালা ঝুলানোর বিষয়টি স্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও এগ্রোনমি এন্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ফারুক হাসান বলেন, ‘১৯৭৩ এর এ্যাক্ট অনুযায়ী চারটি বিশ্ববিদ্যালয় চলে, এর মাঝে রাবি একটি। কয়েকদিন আগে দেখেছি ভিসির ওপর কিছু কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠাচ্ছে শিক্ষামন্ত্রণালয়। নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে একটা নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে। আমরা ভিসি স্যারের কাছে জানতে চেয়েছি তারা এটি পারে কিনা? তখন স্যার বলেছেন, ‘এটা ৭৩ এর এ্যাক্টের লঙ্ঘন। এটা তাদের পার্সোনাল ইন্টারেস্টের জায়গা থেকে আমাকে ব্লক করতেছে।’
এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, আওয়ামী লীগ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ এ্যাক্ট সম্পর্কে অবগত নন এবং নিজ দলীয় ভিসিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোন পার্সোনাল ইন্টারেস্টের জায়গা থেকে ব্লক করতেছে? তাছাড়া আদালতে ও ইউজিসিতে রাবি ভিসির বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে ভিসির পক্ষ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যালেন্ডারে বর্ণিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ এ্যাক্টের অধীন ৫১ নং ধারার ‘Appeals to Chancellor’ এর রেফারেন্স দিয়ে বলা হয়, কেউ ভিসির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হলে ৫১নং ধারায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর মহোদয়ের নিকট আপিল করা উচিৎ। কিন্তু আমি ১৯৭৩ এ্যাক্টের অধীন ৫১নং ধারা পড়ে আমার স্বল্প বুদ্ধিতে বুঝেছি, আদালত বা অন্য কোথাও অভিযোগ করার আগে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর মহোদয়ের নিকট আপিল করা আবশ্যিক (mandatory) নয়। এটি একটি অপশন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ এ্যাক্টের অধীন ১২ নং ধারার “Powes and Duties of the Vice-Chancellor” (ভিসির ক্ষমতা ও কর্তব্য) ২ নং উপধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ভিসির কর্তব্য ১৯৭৩ এ্যাক্ট, স্ট্যাটিউট ও অর্ডিন্যান্স যথাযথভাবে (faithfully) প্রতিপালন/মান্য করা।
কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর এম আব্দুস সোবহান নিম্নোক্তভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ এ্যাক্টের অধীন ১২ নং ধারার (ভিসির ক্ষমতা ও কর্তব্য) ২নং উপধারায় বর্ণিত কর্তব্য প্রতিপালন/মান্য করেন নাই।
১) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩ এর মূল উদ্দ্যেশ্য “Improving the Teaching and Research” (তথ্যসূত্র: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যালেন্ডার; চ্যাপ্টার ১)। শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নত করার পূর্বশর্ত হচ্ছে -- বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উন্নত মানের শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা। সেই লক্ষ্যে প্রায় আড়াই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ২০১৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে “শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা” অনুমোদিত হয়, যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ নামে পরিচিত। কিন্তু ২০১৭ সালের ৭ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি দ্বায়িত্ব গ্রহণের পর, একই বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ ব্যাপকভাবে শিথিল করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৭ প্রণয়ন করেন। ২০১৭ সালে শিথিলকৃত শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩ এর মূল উদ্দ্যেশ্য “Improving the Teaching and Research” থেকে ইচ্ছেকৃতভাবে বিচ্যুত হয়ে রাবির শিক্ষা ব্যাবস্থা ধ্বংসের পথ সুগম করা হয়েছে। সেকারণেই গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারি সচিব নিলীমা আফরোজ স্বাক্ষরিত পত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭ সালের নিয়োগ নীতিমালা বাতিল করে ১৯৭৩ এর আদেশ অনুযায়ী পরিচালিত অন্যান্ন বিশ্ববিদ্যালয় যেমন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়নের জন্য নির্দেশক্রমে ভিসিকে অনুরোধ করা হয়েছে।
ভিসি প্রফেসর এম আব্দুস সোবহানের মেয়ে সানজানা সোবহান বিজনেস স্ট্যাডিজ অন্তর্ভূক্ত মার্কেটিং বিভাগ থেকে পাস করে ২২তম অবস্থানে থেকে শিক্ষক হয়েছে্ন এবং ভিসির নিজ জামাতা এটিএম শাহেদ পারভেজ বিজনেস স্ট্যাডিজ অন্তর্ভূক্ত মার্কেটিং বিভাগ থেকে সিজিপিএ তিন দশমিক চার সাত নয় (CGPA 3.479) পেয়ে ৬৭তম অবস্থানে থেকে শিক্ষক হয়েছেন। উল্লেখ্য যে, রাবির শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ অনুযায়ী, বর্তমান ভিসির মেয়ে ও নিজ জামাতার আবেদনের যোগ্যতা ছিল না। ভিসির এরূপ স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের কারণে দেশের ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে এবং গবেষণার মানও নিম্নগামী করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমতাবস্থায় ভিসিরর মেয়ে-জামাতার নিয়োগ কেন বাতিল করা হবে না- ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারি সচিব নিলীমা আফরোজ স্বাক্ষরিত পত্রে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে ভিসিকে অনুরোধ করা হয়েছে।
২) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩ এর ২৯ ধারা ‘দ্য ফার্স্ট স্ট্যাটিউটস অব দ্য ইউনিভার্সিটি’ এর ৩ এর ১ ধারায় বর্ণিত আছে, ভিসি জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে (এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর পদের নিচে নয়) পর্যায়ক্রমে তিন বছরের জন্য বিভাগের সভাপতি নিয়োগ দিবেন। কিন্তু, গত ৮ই মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর করোনা সংকটকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তিনটি বিভাগে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বিভাগের সভাপতি নিয়োগ না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন লঙ্ঘন করেন। এ বিষয়টি ইউজিসির উন্মুক্ত শুনানিতে এজেন্ডা ছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি তাঁর ১ম মেয়াদে একইভাবে এগ্রোনমী এন্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগে এবং ২য় মেয়াদে ২১ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৭৩ এর ২৯ ধারা ‘দ্য ফার্স্ট স্ট্যাটিউটস অব দ্য ইউনিভার্সিটি’ এর ৩ এর ১ ধারা লঙ্ঘন করে সভাপতি নিয়োগ দিয়েছিলেন।
৩) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ এ্যাক্টের চ্যাপ্টার ৫ এর ধারা ২ (সি)/ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল পদ সৃষ্টি, উক্ত পদ পুরনার্থে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সর্বোপরি সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ। অর্থাৎ স্ব-স্ব বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির কর্তৃক শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা নির্ধারণ ভিন্ন সিন্ডিকেটের শিক্ষক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সুযোগ নাই। আইন অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা নির্ধারণ শুধুমাত্র বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির উপর ন্যস্ত। একমাত্র বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই সিন্ডিকেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর এম আব্দুস সোবহান প্ল্যানিং কমিটির সিদ্ধান্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিজেই তাঁর ১ম ও ২য় মেয়াদে কয়েকটি বিভাগের শিক্ষকের যোগ্যতা নির্ধারণ করে, তা সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদন দেন। রাবির ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগের তিন শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে (হাইকোর্টের রীট পিটিশন নং ৮৯৮৬/২০১৯) আদালত বলেছেন, ‘যিনি সুপারিশকারী তিনিই অনুমোদনকারী হতে পারে না।’
লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়