এ দেশে প্রেম করতে গিয়েও ইংরেজিতে কথা বলতে হচ্ছে কেন?

লেখক আমিনুল ইসলাম (বায়ে)
লেখক আমিনুল ইসলাম (বায়ে)  © প্রতীকী ছবি

ইংরেজি মাধ্যম নিয়ে এখন প্রচুর কথা হচ্ছে। সপ্তাহ দুয়েক আগে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বর্তমান এবং সাবেক দুই সংসদ সদস্যের সঙ্গে তর্ক হয়েছে আমার। বছরের পর বছর ধরে আমরা যারা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে লিখে চলছি; তারা নিয়মিত'ই বলছি- আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাটা আসলে কিসের উপর দাঁড়িয়ে আছে?

এই যে দেশের বড় বড় শহর গুলোতে বাবা-মায়েরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর পেছনে ছুটছেন; এর কারণটা আসলে কি? তারা কি চান তাদের ছেলে-মেয়েরা ভালো ইংরেজি শিখুক? নাকি তারা মনে করছেন- বাংলা মাধ্যমে ভালো পড়াশুনা হচ্ছে না; তাই ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোই ভালো? কিংবা কে জানে! হয়ত এই বাবা-মা'দের অনেকেই চায়, এরা বিদেশে গিয়ে একটা সময় পড়াশুনা করুক কিংবা চাকরি করুক।

এই তিনটা ছাড়া তো আর কোন কারন আমি অন্তত খুঁজে পাচ্ছি না। প্রথম কারণ- ধরে নিলাম বাবা-মায়েরা চান সন্তানরা ভালো ইংরেজি বলবে। আমার ধারণা, আমি যে কোন এভারেজ বাংলাদেশির চাইতে ভালো ইংরেজি বলি। আমার তো ধারণা, আমি বেশ ভালো ইংরেজি বলি। কেউ আবার ভেবে বসবেন না- আমি নিজেকে জাহির করছি। বরং পুরো ব্যাপারটা বুঝানোর জন্যই বলতে হচ্ছে।

ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ক্যানাডা, জার্মানি, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, ভারত, পাকিস্তানসহ পৃথিবীর নানান দেশ থেকে আসা-ছাত্র-ছাত্রীদের আমি পড়াই। কোন দিন তো মনে হয়নি- ওরা আমার কথা বুঝতে পারছে না! এই আমি তো জীবনে কোনদিন ইংরেজি মাধ্যমে পড়িনি। ২৪ বছর বয়েস পর্যন্ত তো পুরোপুরি বাংলা মাধ্যমেই পড়াশুনা করেছি। তাহলে আমি কি করে ইংরেজি শিখলাম?

তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম- আমি না হয় ঢাকা শহরে পড়াশুনা করেছি। ভালো ভালো স্কুল-কলেজে পড়েছি; এ জন্য হয়ত আমি ইংরেজি শিখে ফেলেছি! তো, আমার সাথে যিনি থাকেন, আমার প্রিয়জন; তিনি তো কুষ্টিয়ার একটা ছোট্ট গ্রাম থেকে উঠে এসছেন। সেখানকার স্কুল থেকেই তিনি এসএসসি পাশ করেছেন। এসএসসি পাশ করেই না তবে তিনি নটরডেম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন। এরপর বিদেশে এসে এমনকি গোল্ডমেডেলসহ পিএইচডি করেছেন।

তো, উনি ইংরেজি কই থেকে শিখলেন? উনি তো গ্রামের একটা নাম না জানা স্কুল থেকে পড়ে এসছেন! দেখুন, আমাদের স্কুলগুলোতে ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত ইংরেজি পড়ানো হয়। এরপর ইন্টারমিডিয়েটেও পড়ানো হয়। তাই বেসিক ইংরেজি টুকু আমরা সবাইক শিখি। কেউ হয়ত বড় শহর কিংবা ভালো স্কুলে পড়ার জন্য একটু ভালো শিখি; কেউ হয়ত গ্রাম কিংবা সাধারণ স্কুলে পড়ার জন্য একটু কম জানে। বেসিক শিক্ষা কিন্তু সবাই পাচ্ছে।

এরপর বড় হয়ে আপনার যদি মনে হয়- আপনি ইংরেজি ভালো জানবেন কিংবা ভালো বলবেন; তাহলে নিজ আগ্রহেই সেটা শিখবেন। আপনি যদি মনে করেন চাকরি পাওয়ার জন্য কিংবা বিদেশে যাওয়ার জন্য কিংবা অন্যান্য যে কোন কাজের জন্য ইংরেজি আরও ভালো জানা উচিত; তাহলে যে বেসিক আপনাকে শেখানো হয়েছে স্কুলে; সেটাকে কেবল ঝালাই করতে হবে। আমরা তো সেটাই করেছি। আমাদের তো আলাদা করে ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে হয়নি।

আচ্ছা ধরে নিলাম শুধু ইংরেজি শেখার জন্য না। ভালো পড়াশুনা করার জন্য ইংরেজি মাধ্যমে ছেলেমেয়েগুলোকে পাঠানো হয়। কেউ কি আমাকে বলবেন- দেশের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল গুলোর মান আসলে কেমন? কয়টা ছাত্র-ছাত্রী বড় বড় সরকারি পদে চাকরি পাচ্ছে? কিংবা কয়জন দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে? পরিসংখ্যান তো বলছে- দেশের খুব সাধারণ স্কুল-কলেজ থেকে পড়ে আসারাই ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ছে কিংবা সরকারি ভালো চাকরি গুলো করছে।

আচ্ছা মেনে নিলাম- ওরা হয়ত সরকারি চাকরি কিংবা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে না। ওরা প্রাইভেট চাকরি করবে। দেশের নামকরা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখুন তো, কয়জন ইংরেজি মাধ্যম থেকে পাস করা আর কয়জন বাংলা মাধ্যম থেকে? আচ্ছা মেনে নিলাম- এরা তো আসলে দেশে পড়াশুনা করবে না কিংবা দেশে কিছু করবে না। ওরা তো বিদেশে চলে যাবে। কারো কি জানা আছে- ইউরোপ-আমেরিকার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কয়জন দেশের সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কিংবা বাংলা মাধ্যম থেকে পাস করা ছেলে-মেয়ে পড়ছে আর কয়জন ইংরেজি মাধ্যম থেকে পাস করা ছেলে-মেয়ে পড়ছে?

কই, আমি ১৭ বছর বিদেশে থেকে এমন কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না! আচ্ছা ধরে নিলাম-এরপরও টাকার জোরে ওরা টিউশন ফী দিয়ে বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ছে। এরপর কি আর খোঁজ নিয়েছেন? বাংলা মিডিয়াম থেকে পাস করা ছেলে-মেয়েগুলো ভালো করছে নাকি ইংরেজি মাধ্যম থেকে?খোঁজ নিয়ে দেখুন- বেশিরভাগই বাংলা মাধ্যম থেকে পাস করা।

দেখুন, নিজ মাতৃভাষায় একটা বিষয় আপনি যেভাবে শিখতে পারবেন; ধারণ করতে পারবেন; সেটা কোন ভাবেই সম্ভব না অন্য কোন ভাষায় ধারণ করা। আমি যেই দেশে থাকি; এই দেশে বর্তমান প্রজন্মের সবাই অত্যন্ত ভালো ইংরেজি বলে। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারব- বাংলাদেশে পড়ুয়া ইংরেজি মাধ্যমের ছেলে-মেয়েদের চাইতেও এরা ভালো ইংরেজি বলে। এরা কিন্তু কেউ ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করেনি। এরা এদের নিজের ভাষাতেই পড়াশুনা করেছে। সে সঙ্গে সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ হিসেবে ইংরেজিটাও শিখেছে।

আমি তো কাউকে দেখলাম না, এরা গিয়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হচ্ছে! এ দেশেও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল আছে। তবে এ স্কুলগুলোতে কেবলই বিদেশি দূতাবাসের ছেলে-মেয়েরা কিংবা অভিবাসীদের ছেলে-মেয়েরা পড়ে। আর আমরা কিনা সবাই মিলে ছুটছি ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার জন্য।

গত জানুয়ারিতে দেশে গেলাম। এক রেস্টুরেন্টে বসে ভাগ্নিদের সাথে খাচ্ছি; দেখি এক মা তাঁর পাঁচ বছরের বাচ্চার সাথে ইংরেজিতে কথা বলছেন! দেখে মনে হলো- তিনি গর্বিত এতে! আরেকদিন রেস্টুরেন্টে গিয়েছি। মনে হলো ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া এক ছেলে আর এক মেয়ে; প্রেমিক-প্রেমিকা হবে হয়ত- ইংরেজিতে কথা বলছে। আমি দূর থেকে শুনতে পেলাম। সেই ইংরেজিটাও যদি ভালো করে বলতে পারত! অন্তত ইংরেজি মাধ্যমে না পড়া; এই আমিই তো এদের চাইতে ভালো ইংরেজি বলতে পারবো।

আর প্রেম করতে গিয়ে ইংরেজিতে কথা বলতে হচ্ছে কেন? প্রেম-ভালোবাসাও বিদেশি ভাষায় করতে হচ্ছে আজকাল! তো, আপনারা আসলে ঠিক কোন কারণে ছেলে-মেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন? ইংরেজি জানার জন্য? ভালো পড়াশুনা শেখার জন্য? নাকি স্মার্ট হবার জন্য! বাংলা মাধ্যমে পড়লে আবার লোকে আন-স্মার্ট ভাববে!

এই যে পৃথিবীর নানান দেশ থেকে ছেলে-মেয়েগুলো এখানে পড়তে আসে, কই এরা তো কেউ ব্রিটিশ কিংবা আমেরিকান উচ্চারণে কথা বলে না। ওরা তো ওদের নিজস্ব উচ্চারণেই কথা বলে। এই যে গত বছর এক ভারতীয়-আমেরিকান অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন; তিনি তো পুরোপুরি ভারতীয় উচ্চারণে ইংরেজি বলেন। তাকে তো স্মার্ট হবার জন্য- আমেরিকান উচ্চারণে ইংরেজি শিখতে হয়নি। আর আপনারা কিনা লাখ লাখ টাকা খরচ করে ছেলে-মেয়ে গুলোকে স্মার্ট হতে পাঠাচ্ছেন!

আমেরিকান কিংবা ব্রিটিশদের উচ্চারণে ইংরেজি বললেই কি স্মার্ট হওয়া যায়? ছেলে-মেয়েগুলোকে এরপর যখন ইংল্যান্ড-আমেরিকায় পাঠান; তখন তো গিয়ে তারা দেখে- সেই দেশে সুইপারও এমন উচ্চারণেই কথা বলছে! কারণ এটাই তাদের ভাষা এবং এই উচ্চারণেই তারা কথা বলে। এজন্য আলাদা কোন ফায়দা নেই! তাদেরকে সুইপারের চাকরিই করতে হচ্ছে!

লাখ লাখ টাকা খরচ করে এই যে ছেলে-মেয়েগুলোকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছেন; এরা না পারে ভালো করে ইংরেজি বলতে! না পারে ভালো করে বাংলা বলতে! আর পড়াশুনা কতো দূর কি শিখছে জানি না; কিন্তু কোথাও তো এদের তেমন কোন কন্ট্রিবিউশনও দেখতে পাচ্ছি না। এরা তো নিজ দেশে জন্মে, নিজ দেশে বড় হয়ে; নিজের ভাষাকে ঘৃণা করছে। তাহলে এরা কি আদৌ আমাদের সংস্কৃতিকে ভালবাসবে? যেখানে মা তাঁর পাঁচ বছরের সন্তানকে বলছে- বাংলা বলবে না, ইংরেজিতে বলো!

এখনও সময় আছে স্কুল লেভেলে স্রেফ একটা স্ট্যান্ডার্ড শিক্ষা চালু করুন। পুরো বাংলাদেশের সবাই একরকম শিক্ষা পাবে। এরপর যে যার মতো ভাগ হয়ে গিয়ে ইংরেজি শিখুক, আরবি শিখুক কিংবা অন্য যা ইচ্ছে শিখুক। নইলে একটা সময় আস্ত জাতি পরিচয়হীনতায় ভুগবে। না বাংলাদেশি, না বিদেশি! আশপাশ তাকিয়ে দেখুন, বোধকরি এখনই আমরা প্রায় সেই অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছি!

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)


সর্বশেষ সংবাদ