রাবির শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নে অন্তরায়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩ এর মূল উদ্দ্যেশ্য “Improving the Teaching and Research” (তথ্যসূত্র: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যালেন্ডার; চ্যাপ্টার ১)। শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নত করার পূর্বশর্ত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উন্নত মানের শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা। সেই লক্ষ্যে প্রায় আড়াই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ২০১৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে “শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা” অনুমোদিত হয়, যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ নামে পরিচিত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ এর মূল বৈশিস্ট ছিল, অনার্স ও মাস্টার্সে ন্যুনতম সিজিপিএ তিন দশমিক পাঁচ (CGPA 3.5) প্রাপ্তদের মধ্যে শুধুমাত্র ১ম থেকে ৭ম স্থান অধিকারীরা আবেদন করতে পারবেন। কিন্তু ২০১৭ সালের ৭ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য দ্বায়িত্ব গ্রহণের পর, একই বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ ব্যাপকভাবে শিথিল করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৭ প্রণয়ন করেন।
কারণ হিসেবে বর্তমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছেন, ২/১টি বিভাগ ও ২০১৭ সালের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ শিথিল করতে অনুরোধ করেছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের তিনটি শিক্ষক সমিতি শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ প্রণয়নে আন্তরিক ভূমিকা রেখেছিলেন। এবং ২০১৬ সালের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ পরিবর্তনের কোন দাবি করেনি, বরং আন্তরিকভাবে সমর্থন করেছে।
২০১৭ সালে শিথিলকৃত শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায় সকল অনুষদের ক্ষেত্রে ১ম থেকে ৭ম স্থান অধিকারীদের আবেদনের যোগ্যতাটি শিথিল করা হয়। ২০১৭ সালের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায় অন্যান্ন অনুষদের (বিজ্ঞান অনুষদ, জীব ও ভূ-বিজ্ঞান অনুষদ, কৃষি অনুষদ এবং প্রকৌশল অনুষদ) আবেদনের নুন্যতম সিজিপিএ (অর্থাৎ CGPA 3.5) ঠিক রেখে বিজনেস স্ট্যাডিজ অনুষদ, আইন অনুষদ, কলা অনুষদ, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ও চারুকলা অনুষদের আবেদনের যোগ্যতা সিজিপিএ তিন দশমিক পাঁচ (CGPA 3.5) এর নিচে নামিয়ে আনা হয়।
এমনকি, কিছু অনুষদে আবেদনের যোগ্যতা সিজিপিএ তিন দশমিক শুন্য (CGPA 3.0) করা হয়। উল্লেখ্য যে, উপাচার্য প্রফেসর এম আব্দুস সোবহানের মেয়ে সানজানা সোবহান বিজনেস স্ট্যাডিজ অন্তর্ভূক্ত মার্কেটিং বিভাগ থেকে পাস করে ২২তম অবস্থানে থেকে শিক্ষক হয়েছে্ন এবং উপাচার্যের নিজ জামাতা এ টি এম শাহেদ পারভেজ বিজনেস স্ট্যাডিজ অন্তর্ভূক্ত মার্কেটিং বিভাগ থেকে সিজিপিএ তিন দশমিক চার সাত নয় (CGPA 3.479) পেয়ে ৬৭তম অবস্থানে থেকে শিক্ষক হয়েছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্ট্যাডিজ অন্তর্ভূক্ত মার্কেটিং বিভাগ থেকে উপাচার্য প্রফেসর এম আব্দুস সোবহানের মেয়ে ও জামাতা উভয়েই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন। রাবির বিজনেজ অনুষদ অন্তর্ভূক্ত মার্কেটিং বিভাগ থেকে ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের বিবিএ ফাইনাল পরীক্ষায় যথাক্রমে ৪০, ৫১ ও ২৬ জন শিক্ষার্থী সিজিপিএ তিন দশমিক পাঁচ (CGPA 3.5) বা অধিক সিজিপিএ পেয়েছিল এবং একই বিভাগ থেকে এমবিএ ফাইনাল পরীক্ষায় ২০১২, ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের এমবিএ ফাইনাল পরীক্ষায় যথাক্রমে ৬৬, ৪৭, ৬১ ও ২৫ জন শিক্ষার্থী সিজিপিএ তিন দশমিক পাঁচ (CGPA 3.5) বা অধিক সিজিপিএ পেয়েছিল। যুক্তিযুক্ত কারণে এটি মনে করা স্বাভাবিক যে, রাবির বিজনেজ অনুষদ অন্তর্ভূক্ত মার্কেটিং বিভাগ থেকে এত অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী সিজিপিএ তিন দশমিক পাঁচ (CGPA 3.5) ও অধিক সিজিপিএ পাওয়ার পরও, শুধুমাত্র উপাচার্যের জামাতা ২০১২ সালের এমবিএ পরীক্ষায় সিজিপিএ তিন দশমিক চার সাত নয় (CGPA 3.479) পাওয়ায় এবং উপাচার্যের মেয়ে ২০১২ সালের এমবিএ পরীক্ষায় ২২তম অবস্থানে থাকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ শিথিল করা হয়।
কারণ রাবির শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ এর মূল বৈশিস্ট ছিল, অনার্স ও মাস্টার্সে ন্যুনতম সিজিপিএ তিন দশমিক পাঁচ (CGPA 3.5) প্রাপ্তদের মধ্যে শুধুমাত্র ১ম থেকে ৭ম স্থান অধিকারীরা আবেদন করতে পারবেন। পক্ষান্তরে, বিজ্ঞান অনুষদ, জীব ও ভূ-বিজ্ঞান অনুষদ, কৃষি অনুষদ এবং প্রকৌশল অনুষদে তুলনামূলক কম বা সমপরিমাণ শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সিজিপিএ তিন দশমিক পাঁচ (CGPA 3.5) পেলেও, ২০১৭ সালের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায় এই ৪টি অনুষদ থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের আবেদনের ন্যুনতম সিজিপিএ তিন দশমিক পাঁচ (CGPA 3.5) রাখা হয়েছে।
২০১৭ সালে শিথিলকৃত শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩ এর মূল উদ্দ্যেশ্য “Improving the Teaching and Research” থেকে ইচ্ছেকৃতভাবে বিচ্যুত হয়ে রাবির শিক্ষা ব্যাবস্থা ধ্বংসের পথ সুগম করা হয়েছে। রাবির আইন বিভাগে সিজিপিএ তিন দশমিক চার তিন (CGPA 3.43) প্রাপ্ত উপ-উপাচার্য প্রফেসর চৌধুরী মো. জাকারিয়ার নিজ জামাতা সালাউদ্দিন সাইমুম নিয়োগ পেয়েছেন, কিন্তু উক্ত নির্বাচনী বোর্ডে নিয়োগ পাননি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত প্রার্থী।
২০১৭ সালের শিক্ষক সমিতির দাবির প্রেক্ষিতে “শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা” পরিবর্তন, এটি গ্রহণযোগ্য নয়। শিক্ষক সমিতি প্রতি বছর বেশ কিছু দাবী করে; তা্র অধিকাংশ বাস্তবায়ন হয় না। অধিকিন্তু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩ এ উপাচার্যের ক্ষমতা ও দায়িত্বে (Powers and Duties of the Vice-Chancellor) ১০ নম্বর উপ-ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন অথরিটি বা বডির সিদ্ধান্ত আইনসম্মত মনে না করে একমত না হলে, উপাচার্যের ক্ষমতা আছে তা বাস্তবায়ন না করার বা সংশ্লিষ্ট অথরিটি/বডির কাছে পুনঃবিবেচনার জন্য ফেরত পাঠানোর (তথ্যসূত্র: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যালেন্ডার; চ্যাপ্টার ১)। উপাচার্য প্রফেসর এম আব্দুস সোবহান একমত হয়েছিলেন (বা চেয়েছিলেন) বলেই, শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ ব্যাপকভাবে ২০১৭ সালে শিথিল হয়েছিল।
উল্লেখ্য যে, রাবির শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা-২০১৫ অনুযায়ী, বর্তমান উপাচার্যের মেয়ে ও নিজ জামাতার আবেদনের যোগ্যতা ছিল না। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যিই যে, ২০১৭ সালের শিথিল শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায় প্রায় সকল ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদকপ্রাপ্তরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান নাই।
উপাচার্যের এরূপ স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের কারণে দেশের ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে এবং গবেষণার মানও নিম্নগামী করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমতাবস্থায় উপাচার্যের মেয়ে-জামাতার নিয়োগ কেন বাতিল করা হবে না- ১০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারি সচিব নিলীমা আফরোজ স্বাক্ষরিত পত্রে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে উপাচার্যকে অনুরোধ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) এর তদন্ত কমিটির রিপোর্টের সত্যতা পেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম দূরীকরণসহ শিক্ষা ও গবেষণার মান সুরক্ষার স্বার্থে চলতি বছরের ১০ ডিসেম্বর নির্দেশনা দেন যে,
১) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল নিয়োগ কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিতকরণ।
২) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭ সালের নিয়োগ নীতিমালা বাতিল করে ১৯৭৩ এর আদেশ অনুযায়ী পরিচালিত অন্যান্ন বিশ্ববিদ্যালয় যেমন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপর্যুক্ত নির্দেশনাগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন উপাচার্যের অবশ্যই করণীয়। কিন্তু, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখ বিকেলে ভারতীয় জনগণের পক্ষ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া দুটি বাসের চাবি হস্তান্তর অনুষ্ঠান শেষে আপাতত নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকবে কিনা এমন প্রশ্নে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, “না না, চিঠি আসলোই তো কালকে। এছাড়া রেজিস্ট্রারের অব্যাহতি বিষয়টি আইনি ব্যাপার।” এ বক্তব্য বিভিন্ন অনলাইন/প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে এবং উপাচার্য উক্ত বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন নাই।
অধিকিন্তু, আমার জানা মতে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭ সালের নিয়োগ নীতিমালা বাতিল করে ১৯৭৩ এর আদেশ অনুযায়ী পরিচালিত অন্যান্ন বিশ্ববিদ্যালয় যেমন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়নের জন্য অদ্যাবধি কোন সিন্ডিকেট সভা ডাকা হয়নি।
লেখক: অধ্যাপক, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়