বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ: সংকট উত্তরণে আস্থা অর্জন জরুরি
সাম্প্রতিককালে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার ধরণ ও নিয়োগের স্বচ্ছতা নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে। সবকিছুর মধ্যে কেন আমরা দুর্নীতির প্রসঙ্গ নিয়ে আসি। উত্তরটা মনে হয় খুব কঠিন নয়। আস্থার সংকট তৈরি হলে সবকিছু নিয়েই ধোঁয়াশা থেকে যায়।
যেকোন নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি ও তা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের রোডম্যাপ থাকতে হবে। নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকের যোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন প্লাটফর্মে আমরা বিভিন্ন কথা বলি। কিন্তু আমরা বেমালুম ভুলে যায় উনি একটি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়েই আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন।
সুতরাং তাকে হেয় করার আগে আপনার উচিত নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিটা দেখে নেওয়া। আপনি কী কী ক্রাইটেরিয়ার আলোকে একজন শিক্ষককে নিয়োগ দিচ্ছেন সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার মেজারমেন্ট ঠিকঠাক হলেই কোট-টাই ফিটিং হবে।
নতুবা আলুথালু ড্রেস পরেই দৌড়াতে হবে। সুতরাং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ক্রাইটেরিয়া সুনির্দিষ্ট ও মানসম্পন্ন করুন এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করুন আপনার শিক্ষক ডাউডি হবে না- ড্যান্ডি হবে।
এতো মানুষের দেশে চারটা বা দুইটা (অনার্স, মাস্টার্স) ফার্স্ট ক্লাসসহ পিএইচডি ডিগ্রিধারী প্রার্থী খুঁজে বের করতে মোসাদের সহায়তার দরকার হবে না নিশ্চয়ই। দরকার হবে সদিচ্ছার। যেখানে সবক্ষেত্রে ফার্স্ট ক্লাসসহ উচ্চতর ডিগ্রিধারী প্রার্থী আছে সেখানে তুলনামূলকভাবে দুর্বল প্রার্থীকে বাছাই করার কোন প্রশ্নই আসে না।
নিয়োগের পর সময়ভেদে যোগ্যতার নিরিখে শিক্ষকরা পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। সেখানেও অনেক সময় বিভিন্ন বিশৃঙ্খলার খবর শোনা যায়। আমি বলব, কোন ক্ষেত্রেই লুকোচুরি করার অবকাশ নেই।
বর্তমানে আর একটা বিষয় উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে-গ্রুপিং। এটাকে গ্রুপিং না বলে ‘কোলাবোরেশন’ বলতে পারলে আমি খুশি হতাম। তা না হয়ে হচ্ছে লেকচারার ঐক্য গ্রুপ, সহকারি অধ্যাপক গ্রুপ ইত্যাদি ইত্যাদি। কেন হচ্ছে? কারণ নিয়োগ নীতিমালায় অসামঞ্জস্যতা বা নীতিমালা অনুযায়ী নিয়োগ না হওয়া বা নীতিমালা না মানা।
নীতিমালা টেকসই, যুগোপযোগী ও যুক্তিসংগত হলে এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন হলে কিছু শিক্ষক একত্রিত হয়ে এই গ্রুপ সেই গ্রুপ গঠন করে দাবি আদায়ে সোচ্চার হওয়ার দরকার হত না। মাস্টার্স বা পিএইচডি বা উচ্চতর অন্য ডিগ্রির অগ্রাধিকার বা প্রাপ্যতা বা সুবিধা কোন ধাপে কি হবে তার সুস্পষ্ট বিধান থাকতে হবে এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
কোন শিক্ষক তার ডিগ্রি বা পারফরম্যান্স এর কারণে সুবিধা পেতেই পারেন-এটা শিক্ষাবান্ধব। কিন্তু অনিয়ম বা কাউকে বঞ্চিত করে নয়। সবকিছু নিয়মমাফিক ও সমতার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। পারফরম্যান্স বা যোগ্যতার পুরস্কার নিশ্চিত করতে হবে। চাটুকারিতা বা তৈলমর্দন সর্বদাই পরিত্যাজ্য হওয়া উচিত।
নীতিমালায় গলদ রেখে বা নীতিমালা না মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করার কারণে শিক্ষকরা নিজেদের মধ্যে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করার প্রয়াস পায়। একই প্রতিষ্ঠানের বা একই বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।
ভালো কাজকে মূল্যায়ন করতে হবে। ভালো কাজের প্রতি প্রণোদনা থাকতে হবে। মুখে বোমা না ফাটিয়ে কাজে প্রমাণ দিতে হবে।
মোদ্দা কথা, সব ক্ষেত্রেই আমাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। কোন কাজ সম্পন্ন করার পর সেটির উপযোগিতা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। গঠনমূলক ব্যতিচারের মাধ্যমেই তো উজ্জ্বলতা সৃষ্টি হয়। সে অর্থে গঠনমূলক আলোচনার অবশ্যই দরকার আছে। সর্বোচ্চ যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য আলোচনা হতে হবে। কিন্তু আমাদের আলোচনা হয় নিয়োগের বৈধতা নিয়ে; যা নিঃসেন্দহে দুর্ভাগ্যজনক। স্বাধীনতার এতো বছর পরও আমরা এখনও নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করতে শিখিনি।
আমরা যে দুর্নীতি করি সেটা অনেকটাই সর্বজনবিদিত। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বিভিন্ন সংস্থার বিভিন্ন জরিপের প্রকাশিত ফলাফলে মাঝেমধ্যেই আমাদের দুনীর্তির কেচ্ছা উন্মোচিত হয়। দুনীর্তি করার কালচার থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। এটি করতে পারলেই বাজিমাত করা সম্ভব-শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে। আর এই বাজিমাত করতে পারলেই পরিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে। আমি খুব আশাবাদী মানুষ। বাজিমাত দেখার, বাজিমাত করার এবং পরিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।
লেখক: সহকারি অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়