বিশ্ববিদ্যালয়কে এখন ‘বিষ-শো বিদ্যালয়’ এর মত লাগছে

ভিসি সমীপে....

  © টিডিসি ফটো

৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এক অনিবার্য সংকটের মুখে পড়েছিল শিক্ষা ব্যবস্থা। স্বাধীনতার প্রায় ৪৯ বছরের মাথায় শিক্ষা-জীবন অনেকটা তেমন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তখন দৃশ্যমান শত্রু ছিল আর এখন অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে ঘরবন্দী থাকতে হচ্ছে। ফলে অনেকটা যুদ্ধাবস্থার পরিস্থিতি বিরাজ করছে শিক্ষা ক্ষেত্রে। ব্যতিক্রম হিসেবে অনলাইন পাঠদান কার্যক্রমের কথা বলা যায়। তবে অনলাইন পাঠদানে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল ৫০ শতাংশেরও নিচে।

এমন পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে সিংহভাগ শিক্ষার্থীর। হঠাৎ করেই পরীক্ষা গ্রহণ ও ভর্তির জন্য পীড়াপীড়ি শুরু হওয়ায় শিক্ষার্থীরা এখন চোখে সর্ষে-ফুল দেখছেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অনেকে ভাবছেন এখন কীভাবে কী করবেন। দেশের সবচেয়ে শীতলতম মাসের মধ্যেই পরীক্ষা নিতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং যখন কী না করোনার আরেক দফা মরণ কামড় দেওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে।

এমন পরিস্থিতিতে ডিসেম্বর মাসের শেষ ভাগে যখন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়ে জানতে পারে তখন তাদের হতাশ হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। অনলাইন ক্লাসে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও নিশ্চিত করা যায়নি নানা সমস্যার কারণে, সেখানে হঠাৎ করে পরীক্ষার খবর তাদের কাছে বিনা মেঘে বর্জ্রপাতের মত। ডিভাইস না থাকার কারণে যে সমস্ত শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে পারেনি, তারা এখন হঠাৎ করে এতগুলো অর্থের যোগানই বা কিভাবে দিবেন? জানুয়ারিতে পরীক্ষা মানে তাকে এখনি ঢাকায় যেতে হবে। হল বন্ধ মানে তাকে বাসা ভাড়া করে থাকতে হবে। ঢাকা শহরে ‘‘কান্নাচাপা জীবনের অরেক নাম ব্যাচেলর’’। একদিকে ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া পাবার সংকট অন্যদিকে বাসা ভাড়া নিতে হলে তাকে অন্তত দুই মাসের ভাড়া ‘অ্যাডভান্স’ (অগ্রিম) দিতে হয়। আর পরীক্ষা মানে তাকে এক্ষুনি পরীক্ষার ফি দিতে হবে এবং ভর্তি হতে হবে। কারণ মার্চ মাসে বিশ্ববিদ্যালয় যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই ভর্তির কাজ অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছিল।

অল্প সময়ের নোটিশে ঢাকায় এসে থাকার ব্যবস্থা করা নারী শিক্ষার্থীদের জন্য এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। সে প্রথমে এসে কোথায় উঠবে? বাসা খোঁজার জন্য হলেও ত তাকে ঢাকায় এসে প্রথমে কোথাও থাকতে হবে। এই ঢাকা শহর কতটা অনিরাপদ তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজধানীর কুর্মিটলায় বাস থেকে নামার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী যে ঘটনার শিকার হয়েছেন তার পুনরাবৃত্তি ঘটুক তা ভুল করেও আমরা কেউই চাই না।

০২.
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ টিউশনি করে চলে এবং অনেকে তাদের পরিবারও চালায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সে-সমস্ত শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার এখন সীমাহীন অবর্ণনীয় এক সংকটের মুখে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের এই সংকটের কথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অজানা নয়। কারণ করোনার প্রথম ঢেউ যখন আছড়ে পরে তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক-কর্মকর্তা ও অ্যালামনাইরা শিক্ষার্থীদের আর্থিক সাহায্য করেছিল। আবার যারা ডিভাইস সংকটের কারণে ক্লাস করতে পারছে না তাদেরও একটি তালিকা প্রশাসন জমা নিয়েছে। কিন্তু এখনো সেই তালিকা থেকে অর্থ প্রদান করা শুরু হয়েছে বলে শোনা যায়নি। শিক্ষার্থীদের ডিভাইস কেনার জন্য যে সহযোগিতা করার কথা ছিল ভর্তির আগে সে টাকাটা শিক্ষার্থীরা পেলে তাদের উপর থেকে আর্থিক খড়গ কিছুটা হলেও কমে আসত। শিক্ষার্থীদের এইসব দিক দেখেও কর্তৃপক্ষ যেন এখন কাকের মত চোখ বুঝে সমস্যা ও সংকটকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়-কে এখন অনেকটা ‘বিষ-শো বিদ্যালয়’ এর মত লাগছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভাষ্য, পরীক্ষাগুলো নিয়ে নিলে সেশনজট কিছুটা এড়ানো যাবে এবং বিশেষ করে অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীরা আসন্ন বিসিএস তথা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় আবেদন করতে পারবে। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই বক্তব্যেও রাজি হতে চেয়েছে, সাথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা হল খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর প্রভোস্টরা শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নিতে পারবেন না। তারা ভয় পাচ্ছেন হলে থেকে কোন শিক্ষার্থী আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। এই ঝুঁকি তারা নিতে চান না। কিন্তু কথা হল, শিক্ষার্থীরা বাইরে থেকে পরীক্ষা দিলে, লেগুনা কিংবা বাসে ঠাসাঠাসি করে যাতায়াত করে আক্রন্ত হয়ে মারা গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু যায় আসে না? ফলে বিশ্ববিদ্যালয় যেন বলতে চাচ্ছে- ‘দূরে গিয়ে মর’!

গত নয় মাস আমরা অপেক্ষা করেছি। এখন ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়েছে। আর কিছু সময় কি অপেক্ষা করা যেত না? শিক্ষার্থীদের জন্য ভ্যাক্সিন নিশ্চিত করে ফেব্রুয়ারির শেষ কিংবা মার্চ থেকে কার্যক্রম শুরু করলে হয়ত শিক্ষার্থীরাও এই দুই মাসে মানসিকভাবে প্রস্তুত হবে। শীতের প্রকোপও কমে আসবে সাথে করোনায় আক্রান্তের হারও কমতে পারে। আর তার মধ্যে যদি ভ্যাক্সিনের ব্যবস্থা করা যায় তবে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ থাকবে না। কিন্তু যদি সেই ব্যবস্থাটুকুও না করা যায় তাহলে অন্তত হুট করে শিক্ষার্থীদের উপর এমন অর্থনৈতিক ও মানসিক পীড়ন থেকে একটু রেহাই কি দেওয়া যায় না?

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
msikhan717@gmail.com


সর্বশেষ সংবাদ