২২ ডিসেম্বর ২০২০, ১৫:৫০

ভাস্কর্য-মূর্তির উন্মাদনা: কেমন আছে শ্রমিকরা?

  © টিডিসি ফটো

ঘটা করে শোনানো হয় শতকরা ৯০% মুসলমানের বসবাসরত বাংলার জমিনে কোন মূর্তি স্থাপন করা চলবে না! মানুষ বা অন্য জীবের মূর্তি স্থাপন এদেশের আলেম সমাজ বরদাস্ত করবে না! শরীরের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে মূর্তি স্থাপনের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাবো...! তথাকথিত আলেম সমাজের এমন ঘোষণা এবং কর্মসূচির প্রেক্ষিতে আরেকটি গোষ্ঠী যুক্তির খাতা নিয়ে হাজির! হুজুর সাহেব আপনারা ভুল ভাবছেন, আপনারা যেটা দেখছেন সেটা মূর্তি না, এটা ভাস্কর্য। ইহা স্থাপনে কোন পাপ হয় না! ইহা একদম জায়েজ! বর্তমান সময়ে চলমান মূর্তি- ভাস্কর্য ইস্যুতে পাল্টাপাল্টি কাদা ছোড়াছুড়ি ও কর্মসূচিতে চাপা পড়ে যাওয়া ঢাকা প্রেসক্লাবে অবস্থানরত শ্রমিকরা কেমন আছেন? করোনা মহামারিকালে হাড়কাঁপা প্রচন্ড শীতে জাতীয় প্রেসক্লাবে ১১ মাস ধরে বেতন না পাওয়া 'এ ওয়ান' গার্মেন্টসের শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনার দাবিতে অবস্থান করছে। একই স্থানে অগ্নিদগ্ধ তাজরিন গার্মেন্টসের শ্রমিকরা তাদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছে।

ইতোমধ্যে শারমিন আক্তার নামে একজন শ্রমিক বকেয়া পাওনার দাবিতে অবস্থানের ৬৮ তম দিনে এসে গুরুতর অসুস্থ্য হয়ে পড়েন এবং উন্নত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তবুও মালিকপক্ষ এবং সরকারের টনক নড়ে নি। আচ্ছা এসব ঘটনা সম্পর্কে আমি, আপনি বা ঐ আলেম সমাজ কিংবা এদেশের জনগণ কতোটুকু জ্ঞাত। আমরা জানবোই বা কি করে বলুন?

যখন ভাস্কর্য-মূর্তির পক্ষ-বিপক্ষ গোষ্ঠীর কাদা ছোড়াছুড়ি, পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি এবং মিডিয়ার প্রচারণা আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে, তখন অন্যদিকে কী কী ঘটছে তা আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে চলে যাচ্ছে।

যে গার্মেন্টস শ্রমিকরা ১১ মাসের বকেয়া পাওনার দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে আড়াই মাস ধরে লাগাতার অবস্থান করছিলেন সেই শ্রমিকদের ওপর গত ৭ ডিসেম্বর ভোরে পুলিশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মতো হামলা চালায়। রাতের আঁধারে ঘুমন্ত শ্রমিকদের ওপর টিয়ারশেল ছোড়ে, লাঠি চার্জ করে এবং এই কনকনে শীতে শ্রমিকদের ওপর জলকামান দিয়ে ঠাণ্ডা পানি ঢালে। নারী শ্রমিকদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালায় পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ নারী শ্রমিকদের গালিগালাজ করে বলে, 'বেশ্যারা এখানে বেশ্যাগিরি করতে আসছিস?' পুলিশ এই আচরণ করার সাহস কোথায় পায়! যাদের টাকায় পুলিশের গায়ের পোশাক কেনা হয়েছে, যারা পুলিশকে বেতন দিয়ে পুষে সেইসব শ্রমিকদের গায়ে হাত তোলার সাহস পুলিশকে কে দিয়েছে? জনগণের ট্যাক্সের টাকায় রাষ্ট্র চলে অথচ সেই টাকা লুটপাট করে সরকারের মন্ত্রী-আমলারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে; মালেশিয়া, কানাডায় বেগম পাড়া করছে; হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে। জনগণের জীবন-জীবিকার দায়িত্ব না নিয়ে সরকার শ্রমিকদের অনিরাপদ জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়ার সাহস কোথায় পায়? সরকারের এই উদ্ধত্য কেন?

আচ্ছা বুকে সাহস নিয়ে এইসব প্রশ্ন করার ক্ষমতা আছে? ভাস্কর্য ইস্যু নিয়ে চাঞ্চল্যকর অবস্থার সৃষ্টিকারী হুজুর সাহেবগণ আঙ্গুল তুলে এই প্রশ্নগুলো করতে পারবে? উহু, এমন ভয়ঙ্কর সাহস তারা করবে না! কারণ এতে তাদের ফায়দা নেই, উল্টো সরকারের কুনজরে পড়ে যাবে। ফলত শ্রমিকদের স্বার্থে তাদের চুপ থাকাই শ্রেয়! তারা বরং লোক দেখানো সরকারবিরোধী কর্মসূচি দিয়ে ঢাকায় এসে মহাসমাবেশ করে সরকারকে যুগ-যুগ ধরে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার দোয়া করবে! এবং স্বৈরাচার সরকারকে ইসলামের রক্ষাকর্তা বানিয়ে দিয়ে মহাসমাবেশের সমাপ্তি ঘোষণা করবে! এতেই তাদের ফায়দা! তারা এভাবেই ধর্মরক্ষার মহান কাজটি করেন! অথচ শ্রমিক নিপীড়নের ব্যাপারে উনারা নিশ্চুপ। শ্রমিকের মর্যাদাপূর্ণ জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার প্রশ্নে উনারা নিশ্চুপ। ধর্মীয় লেবাসে এই ধরনের 'ফায়দা' লোটার কর্মকাণ্ডই হলো ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার।

গার্মেন্টস মালিকরা ও রাষ্ট্রপক্ষ দিনের পর দিন শ্রমিকদের ঠকিয়ে নিজেরা ফুলে ফেঁপে উঠছে। শ্রমআইন থাকলেও মালিকপক্ষ তার কোনো তোয়াক্কা করছে না। যে নিপীড়ক সরকার হাজার হাজার শ্রমিককের জীবন-জীবিকাকে চরম অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিচ্ছে সেই স্বৈরাচারী সরকারের দীর্ঘায়ু কামনা করে যে ধর্ম রক্ষা করা যায় না এটা নিশ্চই মামুনুল হকরা জানেন! কিন্তু এ ব্যাপারে তারা কিছু বলবে না। কারণ এতে লাভ-ক্ষতির জটিল হিসেব রয়েছে! যা পূর্বেই বলেছি।

শুধু গার্মেন্ট শ্রমিকরাই অনিরাপদ জীবনযাপন করছেন তা নয়। একই সময় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থানরত ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের ওপরেও পুলিশ বর্বরোচিত হামলা চালায়।

আমরা ছোটবেলা থেকে পাঠ্যপুস্তকে পড়ে আসছি পাট আমাদের সোনালী আঁশ কিন্তু সেই পাটকল ও পাটকল শ্রমিকদের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০২ সালে আদমজি পাটকল বন্ধ করে দেয় তৎকালীন বিএনপি সরকার। যার কারণে পাটশিল্প বড় হুমকির মধ্যে পড়ে। পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ সরকার পাটকলগুলোকে রক্ষার পরিবর্তে সেগুলোকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। লোকসানের অভিযোগে হাজার-হাজার শ্রমিককে কর্মচ্যূত করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। লোকসানের দায় শ্রমিকদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে এই অযোগ্য সরকার। যদিও শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকারের এমন হটকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে যাচ্ছে। আবার সরকারও কম কিসে? তার তো লাঠিয়াল পুলিশ আছে। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, মামলা ও পুলিশি হয়রানি করে আন্দোলন থামানোর চেষ্টা চলছে। পাটকল আন্দোলনের সংগঠক ও ছাত্রনেতা আল-আমিন শেখ, আন্দোলনের নেতা অলিয়ার রহমান, শামসেদ আলম শমসের, এসে এ আব্দুর রশীদ, জনার্দন দত্ত নান্টুসহ সংগঠকদের গ্রেফতার করে পুলিশ। যদিও আন্দোলনের তোপের মুখে পড়ে তাদেরকে আদালত জামিনে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে। চলমান রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল রক্ষার আন্দোলন। কিন্তু এই আন্দোলনের শেষ পরিণতি কি? যৌক্তিক একটা আন্দোলন চাপা পড়ে গেছে ভাস্কর্য ইস্যুর প্রচারণায়।

চিনি কলগুলোর অবস্থা কি? শত শত মণ চিনির বস্তা কারখানায় পড়ে আছে। অথচ ভারত থেকে চিনি আমদানি করে দেশীয় চিনির বাজার নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।

যার ফলে চিনিকলগুলো ইচ্ছে করে লোকসানের দিকে নিয়ে গিয়ে চিনি কল বন্ধ করে এখানেও হাজার হাজার শ্রমিকাকে কর্মচ্যূত করার ষড়যন্ত্র চলছে।

প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের অবস্থা আরো করুণ। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন ও দেশের অর্থনীতিকে সচল করার বুক ভরা আশা নিয়ে বিভিন্ন দেশে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের অবস্থা কতোটা করুণ সেটা মধ্যপ্রাচ্যের দু'একটা ঘটনার দিকে তাকালেই বুঝা যায়। সৌদি আরব থেকে গতবছর অক্টোবরে নাজমা নামের একজন নারীর লাশ বাংলাদেশে এসেছে। মৃত্যুর দু’দিন আগেও ফোন করে নাজমা অনেক কাঁন্নাকাটি করেছিল। শেষবার বলেছে, নির্যাতন করে তাঁকে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে তাঁর সৌদি ‘মালিক’। নাজমার দুজন শিশু পুত্র আছে; যাদের বাবা নাই। এখন তারা মাকেও হরালো। এই শিশুদের কী হবে? মা হারা শিশুদের আর্তনাদ কি পৌঁছেছে আমাদের সরকারের কাছে?

সাংবাদিক ও কবি ফারুক ওয়াসিফ গত বছর অক্টোবরে প্রথম আলোতে লিখেছেন, "মধ্যপ্রাচ্য থেকে দিনে গড়ে ১১টি কফিন আসছে বাংলাদেশে। আট মাসে এসেছে ২ হাজার ৬১১টি। এর মধ্যে নারীদের সংখ্যাও কম না। এই সাড়ে তিন বছরে নারী শ্রমিকের লাশ এসেছে প্রায় সাড়ে তিনশো।"

২০১৯ সালের ২৯ নভেম্বরে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত একটা রিপোর্টে ব্র্যাক অভিবাসন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, "২০১৯ সালের প্রথম ৯ মাসে শুধু সৌদি আরব থেকে ৪৮ জন নারীর মরদেহ বাংলাদেশে আসে। এবং গত চার বছরে দেশে এসেছে ১৯২ জন নারীর মরদেহ।"

চোখে হাজারো স্বপ্ন নিয়ে প্রবাসে কাজ করতে গিয়ে আমাদের দেশের শ্রমিকরা অমানষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে লাশ হয়ে দেশে ফিরছে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র নিশ্চুপ। এটা নিয়ে কি আমরা প্রশ্ন তুলেছি? আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কতোটা ভঙ্গুর ও ব্যর্থ হলে এমন বর্বরতা চলতে পারে? এসব বিষয়ে আমরা কতোটুকু কনসার্ন?

আমরা এমন একটা দেশে বসবাস করছি যেখানে শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার কোন নিরাপত্তা নেই। নেই স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। করোনা মহামারীর লকডাউনের সময় যখন সবাই জীবনের নিরাপত্তার জন্য ঘরে অবস্থান করছে ঠিক এমন সময় সরকার ও বিজিএমইএ'র হঠকারি সিদ্ধান্তে কারখানা খুলে দেওয়া হয়। ফলে শ্রমিকদেরকে বাধ্য হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ নিজ কর্মক্ষেত্রে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরতে হয়। কিন্তু লকডাউনে দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ। তারা আসবে কি করে? আবার না আসলে চাকরি থাকবে না। ফলে করোনা মহামারীতে দেখেছি অনিরাপদ বাহনে ঝুলে ঝুলে ঢাকায় ফিরছে দেশের প্রধান চালিকা শক্তি হতভাগা শ্রমিকরা। যারা যানাবাহন পায় নি তারা এক হাতে শিশু সন্তান আরেক হাতে কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে পায়ে হেটে কর্মস্থলে ফিরছে। যখন হাজার বাধা পার করে শ্রমিকরা কর্মস্থলে ফিরলো ঠিক এমন সময় আবার কারখানা বন্ধের নির্দেশ আসে। বেচারা শ্রমিকরা যাবে কোথায়? কতো উপায়ে শ্রমিকদের হেনস্থা করা যায় তার বাস্তব প্রমাণ দেখলো এদেশের জনগন।

এটাই হচ্ছে এদেশের শ্রমিকদের জীবনের গল্প। যে গল্পে কোন সুখ নাই, জীবনের নিরাপত্তা নাই, নাই মর্যাদাপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা। সরকার, বিজিএমইএ এবং গার্মেন্টস মালিক পক্ষের ভাবখানা এমন, ওরা তো শ্রমিক এদের আবার কিসের নিরাপত্তা?

যে শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি, যাদের শ্রমের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকে আছে সেই শ্রমিকদেরকে কেন বেতনের দাবিতে রাস্তায় নামতে হবে? কেন তারা তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক পাবে না।

আমরা কি এই ভোটবিহীন অবৈধ সরকারকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলতে পারবো না- শ্রমিক মারার পায়তারা বন্ধ কর? আমরা কি বলতে পারবো না- যেই সরকার শ্রমিক মারে সেই সরকার নিপাত যাক?

বন্ধুরা, আমাদের ভাবার সময় এসেছে। ফলত মৌলিক সমস্যা এবং শত্রু পক্ষকে চিহ্নিত করতে হবে। যদিও এই সরকার তার ফ্যাসিবাদকে কায়েম রাখার জন্য মূল সমস্যা থেকে আমাদের দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে রাখার জন্য নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করে চলেছে। কখনো ভাস্কর্য ইস্যু, কখন জাতীয়তাবাদী চেতনার ইস্যু, কখনও বা হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ইস্যু...।

ফলে আমাদেরকে সাবধান হতে হবে। আমরা স্বৈরাচারী সরকারের কৌশলী ছকে খেলবো নাকি মূল সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করবো?

আমাদের মনে রাখতে হবে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি ছাড়া জনমানুষের মুক্তি মিলবে না। ফলে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার রক্ষার আন্দোলন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এই ন্যায্য আন্দোলন পরিচালনার জন্য নারী-পুরুষ, ছাত্র-জনতার বৃহত্তর ঐক্য গঠন করতে হবে। বিভক্তির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জনগনের মুক্তির জন্য সকল ধর্ম-বর্ণ, গোত্রসহ নানান শ্রেণি-পেশার মানুষের রাজনৈতিক ঐক্যই পারে নতুন মানুষের সমাজ বিনির্মাণ করতে। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের মাধ্যমে পরিবর্তন সম্ভব।

 

লেখক: সম্পাদক, উত্তরণ সাহিত্যের ছোটকাগজ, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।