ভয়ঙ্কর মরণঘাতী করোনাভাইরাস

করোনাভাইরাসের পাঁচটি ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে। ইনসেটে লেখক জাহিদ দেওয়ান শামীম
করোনাভাইরাসের পাঁচটি ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে। ইনসেটে লেখক জাহিদ দেওয়ান শামীম  © ফাইল ফটো

মহামারীতে বিশ্বব্যাপী আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ৭ কোটি ৭ লাখ ছাড়িয়েছে, এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন প্রায় ১৭ লাখ এবং রোগ থেকে সেরে উঠেছেন প্রায় ৫ কোটি চার লাখ। এ পর্যন্ত রোগটির কোনো স্পেসিফিক চিকিৎসা না থাকায় হাসপাতালে নিবিড় চিকিৎসা ছাড়া রোগ থেকে সেরে ওঠার উপায় নেই। বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা মনে করছে ভ্যাকসিন ছাড়া এই মরণঘাতী করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে করা সম্ভব না, তাই প্রতিরোধে ভ্যাকসিনের উপর ভরসা রেখছে।

ভ্যাকসিন হল এক ধরনের রাসায়নিক প্রিপারেশন যা অ্যান্টিবডি তৈরীর প্রক্রিয়াকে উত্তেজিত করে দেহে কোন একটি রোগের জন্য প্রতিরোধ ক্ষমতা জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। নতুন ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে মূলত ছয়টি ধাপ অনুসরণ করতে হয় যেমন - ১. অনুসন্ধানী, ২. প্রি-ক্লিনিক্যাল, ৩. ক্লিনিক্যাল, ৪. নিয়ন্ত্রক পর্যালোচনা এবং অনুমোদন, ৫. উৎপাদন ও ৬. মান নিয়ন্ত্রণ। প্রতি ধাপই খুব গুরত্বপূর্ণ ভ্যাকসিন তৈরির জন্য, তাই একটা বাদ দিয়ে আরেক ধাপে যাওয়া যায় না। সবক’টি ধাপ পেরিয়ে তবেই ভ্যাকসিন ব্যবহারের উপযোগী হয় বলে, তৈরিতে ২ থেকে ১০ বছর সময় লাগতে পারে।

তবে করোনা ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে গবেষকেরা ৬ মাসের মধ্যেই তা সম্পন্ন করেছে। ভ্যাকসিন তৈরির সব ধাপ পেরিয়ে পাঁচটি এরমধ্যে পরীক্ষামূলক ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে, যা সবার মধ্যে আশার আলো জাগাচ্ছে। করোনার কার্যকারী ৫টি ভ্যাকসিন - ১. ফাইজার ও বায়োএনটেকের এমআরএনএ ভ্যাকসিন ৯৫ শতাংশ কার্যকর, দাম ২০ ডলার, লাগবে ২ ডোজ, মাইনাস (-) ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করতে হবে। ২. মডার্নার এমআরএনএ ভ্যাকসিন ৯৪.৫ শতাংশ কার্যকর, দাম ২৫-৩৭ ডলার, লাগবে দুই ডোজ, ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৩০ দিন সংরক্ষণ করা যাবে।

৩. অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন ৭০ শতাংশ কার্যকর, দাম ৩-৪ ডলার, লাগবে ২ ডোজ, ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করা যাবে। ৪. স্পুটনিক ফাইভ টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর (বলা হয়েছে কিন্তু তথ্য বা ডাটা দেওয়া হয় নাই), দাম ১০ ডলার, লাগবে ২ ডোজ, ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করা যাবে। ৫. জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কে এখনো স্পষ্টভাবে জানা যায়নি, দাম ১০ ডলার, লাগবে ১ ডোজ, ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করা যাবে।

করোনাভাইরাস মহামারিতে বিশ্বে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্র, এই ভাইরাসে দেশটিতে সবথেকে বেশি মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করেছে। স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও শিক্ষাসহ সব সেক্টরে করোনার নেগেটিভ প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র এখন লন্ডভন্ড। করোনাভাইরাসের মহামারী ঠেকাতে দেশটি জরুরি চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য এক সপ্তাহের মধ্যেই দুটি ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে। মহামারিতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির দেশটি শুরুতে ফাইজার ও বায়োএনটেকের তৈরি টিকার অনুমোদন দেয়। এরপর গত শুক্রবার ডিসেম্বর ১৮ মডার্নার তৈরি করোনার ভ্যাকসিন অনুমোদন দেয় দেশটি।

ভ্যাকসিন দুটির মধ্যে পার্থক্য বা মিল-অমিল কি। মিল হলো ভ্যাকসিন দুটি মেসেঞ্জার আরএনএ (এমআরএনএ) প্রযুক্তি ব্যবহৃত করে তৈরি করা হয়েছে। এমআরএনএ ভ্যাকসিনে কোনো প্রকৃত ভাইরাস থাকে না। ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্না দুটি ভ্যাকসিন করোনাভাইরাসের পৃষ্ঠে থাকা মুকুটসদৃশ স্পাইককে লক্ষ্যবস্তু বানায়। ওই স্পাইকগুলো মূলত মানবদেহের সবল কোষগুলোকে ভাঙার কাজ করে। মূলত এমআরএনএ ভ্যাকসিন মানুষের শরীরের ইনজেকশন করার পর কোষে প্রবেশ করে করোনাভাইরাসের অংশবিশেষ স্পাইক প্রোটিনের অনুকরণীয় প্রোটিন তৈরির করে। যা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে কার্যকর করতে উৎসাহিত করে এবং শরীরকে ভাইরাস প্রতিরোধী ভ্যাকসিনের কারখানায় পরিণত করে।

করোনাভাইরাস ঠেকাতে দুটি ভ্যাকসিন প্রায় একই রকম কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফাইজার ও বায়োএনটেকের ভ্যাকসিনটি পরীক্ষার তৃতীয় ধাপে ৯৫ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। মডার্নার ভ্যাকসিনটি ৯৪ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। দুটি ভ্যাকসিনই দুই ডোজ করে দিতে হয়। এর মধ্যে ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজ দেওয়ার পর দ্বিতীয়টি ডোজের জন্য ২১ দিন আর মডার্নার ক্ষেত্রে ২৮ দিনের বিরতি দিতে হয়। পরীক্ষার সময় এ দুটি ভ্যাকসিন যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের অসুস্থতা বা সাইড-ইফেক্টের হার খুব সামান্য।

যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) কাছে দুটি প্রতিষ্ঠান যে তথ্য জমা দিয়েছে তাতে দেখা গেছে, ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ গ্রহণের দুই সপ্তাহ পর থেকে করোনাভাইরাস ক্ষেত্রে আংশিক সুরক্ষা পেতে শুরু করেন টিকা গ্রহণকারী। দুটি ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে মূল পার্থক্য বা অমিল হচ্ছে তা দীর্ঘ মেয়াদে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাপমাত্রার বিষয়টি। ফাইজারের ভ্যাকসিনটি অবশ্যই মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হবে। একবার গলানো হলে এটি কেবল পাঁচ দিন রেফ্রিজারেটরে এবং ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৬ ঘন্টা রাখা যাবে। এ ছাড়া ভ্যাকসিনটি পরিবহনের জন্য শুষ্ক বরফযুক্ত বিশেষ কনটেইনারের প্রয়োজন।

অন্যদিকে মডার্নার ভ্যাকসিনটি মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ছয় মাস পর্যন্ত থাকবে। একবার গলানো হলে এটি রেফ্রিজারেটরে এক মাস এবং ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ১২ ঘন্টা পর্যন্ত রাখা যাবে। দুটি ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেই বড় আকারের পরীক্ষা চালানোর সময় কোনো মারাত্মক দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তবে সামান্য স্বল্পমেয়াদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ফাইজার ও মডার্নার ভ্যাকসিন অবশ্য সরাসরি তুলনা করে দেখা হয়নি। তবে মডার্নার ভ্যাকসিনে কিছুটা বেশি মাত্রায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পর প্রথম দিন বা দ্বিতীয় দিনে ক্লান্তি, মাথাব্যথা ও জ্বরের উপসর্গ দেখা যায়। ৬৫ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে এ উপসর্গ বেশি দেখা যায়।

ফাইজারের ভ্যাকসিন মানবদেহে পরীক্ষার পর্যায়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে এই ভ্যাকসিনটি ব্যবহার শুরুর পর কিছু ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে গুরুতর অ্যালার্জি দেখা গেছে। যুক্তরাজ্যে দুজন ও আলাস্কায় একজন স্বাস্থ্যকর্মী ফাইজারের ভ্যাকসিন নেওয়ার পর অ্যালার্জির কথা বলেছেন। যুক্তরাজ্যের ওষুধ নিয়ন্ত্রকের পক্ষে বলা হচ্ছে, যাঁদের অ্যানাফিল্যাক্সিস বা কোনো খাবার বা ওষুধে গুরুতর অ্যালার্জি সমস্যা রয়েছে, তাঁরা যেন এ ভ্যাকসিন না নেন।

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নেওয়ার পর কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা জানতে চান সবাই। কারা ভ্যাকসিন নেবেন আর কারা নেবেন না, এমন প্রশ্নও রয়েছে মানুষের মনে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) এ নিয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। সিডিসি স্থানীয় সময় গত শনিবার জানিয়েছে, অ্যালার্জি আছে—এমন লোকজনও ভ্যাকসিন নিতে পারবেন। তবে ভ্যাকসিনের কোনো উপাদান নিয়ে আগে যদি কারও অ্যালার্জি হয়ে থাকে, তাহলে তাঁরা চট করে টিকা নিতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে আরও কিছু পরীক্ষা করতে হবে।

সিডিসি তাদের ওয়েব পেজে বলছে, খাবার পরিবেশসহ নানা বিষয়ে যাঁদের অ্যালার্জি আছে, তাঁরা করোনার ভ্যাকসিন নিতে পারবেন। যাঁদের মুখে নেওয়া ওষুধে অ্যালার্জি অথবা অন্য কোনো ভ্যাকসিনে হালকা বা মাঝারি অ্যালার্জি হয়েছে, তাঁরাও ভ্যাকসিন নিতে পারবেন। তবে যাঁদের অন্য কোনো ভ্যাকসিনে অনেক বেশি অ্যালার্জি বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে, তাঁদের টিকা নেওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলা হয়েছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে দুটি ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর, তার সঠিক চিত্র বুঝতে আরও তথ্য প্রয়োজন। দুটি ভ্যাকসিন করোনার উপসর্গ ও মারাত্মক অসুস্থ রোগীর ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর হলেও ভ্যাকসিন নেওয়ার পর সেই রোগী থেকে নতুন কেউ সংক্রমিত হন কিনা, তা এখনো জানা সম্ভব হয়নি। যতক্ষণ তা জানা যাচ্ছে না, ততক্ষণ মাস্ক প্রয়োজন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে টিকা পাওয়া ব্যক্তিরা যাতে করোনাভাইরাস না ছড়ান, তা নিশ্চিত হবে।

আমেরিকার শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশন ডিজিজেসের পরিচালক ড. অ্যান্থনি ফাউসি বলেছেন, মাত্র ৬ মাসের মধ্যে ডেডলি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি একটি যুগান্তকারী সাফল্য। পাশাপাশি ভ্যাকসিন ডিসকভারিতে নতুন এমআরএনএ টেকনোলজী একটি মাইলফলক। ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্না দুটি ভ্যাকসিন করোনাভাইরাস ছড়ানো প্রতিরোধে কতটা কার্যকরী তা এখনো জানা যায়নি। তাই সংক্রামণে রোধে ড. ফাউসি সকলকে মাস্ক পরার পাশাপাশি সামাজিক দুরত্ব মনে চলতে বলেছেন।

লেখক: সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র


সর্বশেষ সংবাদ