বিশ্বব্যাংককে বৃদ্ধা আঙুল দেখিয়ে বাংলাদেশের স্বপ্নজয়
১০ই ডিসেম্বরে ৪১তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে বসে গেল পদ্মা সেতুর সবগুলো স্প্যান, সেই সাথে স্বপ্নের পদ্মা সেতু তার নির্মাণযজ্ঞের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছে গেল। পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হলে শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদের নয়, পুরো দেশের অর্থনীতিকেই আমূল পাল্টে দেবে।
এছাড়া এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য, যোগাযোগ, পর্যটনসহ আরো অনেক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু খড়স্রোতা পদ্মার বুকে নিজস্ব অর্থায়নে এই দ্বিতল সেতু নির্মাণ মোটেও সহজ কাজ ছিল না। এর জন্য বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
১৯৯৮ সালে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। সেই অনুযায়ী ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে পূর্ণ সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু এরপরে বিএনপি জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে যদিও ২০০৪ সালে জাইকার সুপারিশ মেনে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়, কিন্তু এদের আগ্রহ ও সদিচ্ছার অভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখে নি।
পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় এলে তারা পদ্মা সেতুর প্রকল্পটিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। ২০০৯ সালের ১৯ জুন সেতু নির্মাণের নকশা মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে এবং পরামর্শকের সাথে চুক্তি করা হয়। ২০১৩ সালের মধ্যে সেতুর কাজ শেষ করার সময় নির্ধারণও করা হয়। ২০১০ সালে প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বান করলে পদ্মা সেতুর অর্থায়নে আগ্রহ দেখায় বিশ্বব্যাংক।
সেই সাথে সহযোগী হতে চায় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিপি), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও জাইকা। ২৯০ কোটি ডলার ব্যয়ে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পদ্মা সেতু প্রকল্পে জন্য ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে সরকার। এরপর ওই বছরের ১৮ মে জাইকা (৪০ কোটি ডলার), ২৪ মে আইডিবি (১৪ কোটি ডলার) এবং ৬ জুন এডিবি’র (৬২ কোটি ডলার) সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়।
কিন্তু এরপরেই শুরু হয় সরকার বিরোধী দেশী ও আর্ন্তজাতিক মহলের ষড়যন্ত্রের জালবোনা। তাদের ইন্ধনে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা সংস্থাগুলো দুর্নীতির অভিযোগ করে অর্থায়ন স্থগিত করে দেয়। ঋণ চুক্তি স্থগিতের সময় ঋণ পুনর্বিবেচনার জন্য দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ চারটি শর্ত জুড়ে দেয় বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশ সরকার চুক্তি বাতিল এড়াতে তখন যোগাযোগ সচিবকে সরিয়ে দেওয়াসহ বেশ কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপও নেয়। কিন্তু এগুলো বিশ্বব্যাংকের চোখে সন্তোষজনক ছিল না। ফলে ২০১২ সালের ২৯শে জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণচুক্তি বাতিল করে দেয় এ সংস্থাটি।
বিশ্বব্যাংকের এ চুক্তি বাতিলের পেছনে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের হাত আছে বলে ধারণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তখন কয়েকটি বক্তৃতায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধের কারণ হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের দিকে ইঙ্গিত দেন। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি না থাকতে পেরে তিনি এমন কাজটি করেছেন বলে অনেকে ধারণা করেন। এ বিষয়ে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সাথে শেখ হাসিনার কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে বলেও জানা যায়।
বিশ্বব্যাংকের এই নেতিবাচক কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি বিভাগকে বলেছিলেন ‘রাবিশ’ ও ‘অপদার্থ’। বলে রাখা ভালো, বিশ্বব্যাংক এখন তাদের অর্থায়ন বন্ধের সিদ্ধান্তটিকে ভুল বলে স্বীকার করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের এমন কাজে তীব্র নিন্দা প্রকাশ করেন এবং প্রয়োজনে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলেন। এক্ষেত্রে তিনি দেশের ধনী গরীব সকল নাগরিককে পদ্মা সেতু নির্মাণে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। শুরু হয় অর্থ সংগ্রহ। মন্ত্রিসভার বৈঠকে সেতুর অর্থ সংগ্রহে প্রতিটি তফসিলী ব্যাংকে দুটি করে ব্যাংক হিসাব খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সকল মন্ত্রী ও প্রায় শতাধিক সচিব তাদের এক মাসের সম্মানী পদ্মা সেতুর ফান্ডে জমা দেন। এছাড়া দেশি বিদেশি আরো অনেক লোক সাহায্যে এগিয়ে আসেন।
এরমধ্যেই অর্থমন্ত্রীর প্রচেষ্টায় ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক আবার ফিরে আসার ঘোষণা দেয়। বিশ্বব্যাংকের দেওয়া শর্ত অনুসারে পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করা শুরু করে দুদক।
এসময় বিশ্বব্যাংকের একাধিক প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসে দুদকের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করে এবং নতুন নতুন শর্ত আসতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের এরূপ তালবাহানায় ক্ষিপ্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ২৪শে জানুয়ারী সংস্থাটিকে ১ সপ্তাহের আল্টিমেটাম দিয়ে বলেন, ১ মাসের মধ্যে তারা তাদের অবস্থান পরিস্কার না করলে বাংলাদেশ তাদের কাছ থেকে কোন ঋণ নেবে না।
অবশেষে ৩১শে জানুয়ারী পদ্মা সেতুতে ঋণ সহযোগিতা প্রত্যাহার চেয়ে বিশ্বব্যাংককে চিঠি দেয় সরকার এবং নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহসী উদ্যোগ নেয়।
বিশ্বব্যাংকের অর্থ সহযোগিতা প্রত্যাহারের আগে ও পরে চীন, মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশ পদ্মা সেতু অর্থায়নে আগ্রহ দেখায়। কিন্তু সেগুলো সাশ্রয়ী না হওয়ায় সরকার তা নাকচ করে দেয়। পরবর্তী অর্থবছরের (২০১৩-১৪) বাজেটে সরকার ৬,৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে চীনের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন কোম্পানির সাথে চুক্তি করে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে।
প্রসঙ্গত, পদ্মাসেতুর দুর্নীতির মামলায় কানাডার আদালতে দুর্নীতির পক্ষে বিশ্বব্যাংক কোন প্রমাণ ই দিতে পারে নি। বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আদালত জানায়, বিশ্বব্যাংক যে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মাসেতুর অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে, তার কোন প্রমাণ ই তারা পায় নি। এ রায়ের প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সততার শক্তি ছিল বলেই তিনি বিশ্বব্যাংকের ঐ অভিযোগকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পেরেছিলেন।
২০১৭ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতুতে ১ম স্প্যান বসে। এরপর গুটি গুটি করে কিছুদিন আগে ৪১তম স্প্যান বসে। এখন শুধু সেতুর উপর সড়ক ও রেলের স্ল্যাব বসানোর কাজ বাকি আছে। এরপরেই দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে শুরু করবে পদ্মা সেতু। এই সেতুকে কেন্দ্র করে দেশে সর্বপ্রথম সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
সেতুটি হলে ঢাকার সাথে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবন পরিবর্তন হতে শুরু করবে। মংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সাথে ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। কোনো বিনিয়োগের ১২ শতাংশ রেট অব রির্টান পেলে সেটিকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সেতু হলে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ উঠে আসবে। কৃষি, শিল্প, অর্থ, শিক্ষা, বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এছাড়া এই সেতুতে ঘিরে চীনের সাংহাই শহরের মত একটা শহর গড়ে তোলার কথা বার্তা হচ্ছে। পর্যটনে এই সেতু নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। বলা যায়, বাংলাদেশের ভবিষ্যত অর্থনৈতিক কাঠামো এ সেতুকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠবে। পদ্মা সেতুর কল্যাণে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: ল' এন্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।