আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, দরকার সচেতনতা

  © প্রতীকী ছবি

আজকাল পত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখা যায় আত্নহত্যার খবর। এসব আত্মহননকারীর বেশিরভাগই তরুণ প্রজন্ম। কিন্তু প্রশ্ন হলো একজন তরুণকে কেন বেছে নিতে হবে আত্মহত্যার মতো কঠিন পথ?কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় এর পরিধি বিস্তৃত। তবে বর্তমানে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে হতাশা ও মানসিক চাপ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এই হতাশার পেছনে আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থা দায়ী। এছাড়া আরো অনেক কারণ যেমন-জীবিকার জন্য চাকরি না পাওয়া, সম্পর্কে ভাঙন, অপমান সহ্য করতে না পারা, পরীক্ষায় ফেল করা, সাইবার বুলিং এর শিকার, তর্ক-বিবাদ, পরিবারে আর্থিক অনটনসহ ক্ষেত্র বিশেষে পারিপার্শ্বিক নানান কারণে তরুণরা আত্মহত্যা করছে৷

আমাদের দেশের যেসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করছে সেসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও কখনো এর কারণ জানার চেষ্টা করেন না৷ ফলে আত্নহত্যার মতো ঘটনা যেনো থামছেই না। বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটা জিপিএ নির্ভর হয়ে পড়েছে। সমাজের সিংহভাগ অবিভাবকই সন্তানের মাথায় একটি বিষয় ঢুকিয়ে দেয় তা হলো জিপিএ-৫ পেতেই হবে, তা না হলে সমাজে তাদের মানসম্মান থাকবে না। আমাদের দেশে বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত ও স্বচ্ছল বাবা-মায়ের এমন মানসিকতা সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিগোচর হয়। অভিভাবকের এমন প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব শিক্ষার্থীদের এক ধরনের মানসিক চাপ ও ভীতি সৃষ্টি করে। ফলে তারা বিষন্ন ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

দেখা যায়, প্রতিবছর পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পরে যেসব শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করতে পারে না তারা আত্মহত্যার মতো কঠিন পথ বেচে নেয়। মূলত পরিবারের সম্মান রক্ষা করতে না পারা ও সহপাঠীদের কাছে মুখ দেখানোর গ্লানি ও চাপ সহ্য করতে না পেরে তারা এই কাজটি করে৷ এ ধরনের আত্মহত্যার কারণ হিসবে শিক্ষার্থীদের পরিবার দায় এড়াতে পারে না। আমাদের দেশে অনেক পরিবারের বাবা-মা সন্তানের সাথে দুর্ব্যবহার করে। ফলে দূর্বলতা ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে তারা আত্মহত্যা করে থাকে। একজন শিক্ষার্থীর বেড়ে ওঠার পেছনে পরিবারের সহযোগিতামূলক আচরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ পরিবারে সন্তানের সাথে সহযোগিতামূলক আচরণের অভাব দেখা যায় যা সন্তানের জন্য সুফল বয়ে আনে না।

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১৩ সালের ১৪ আগষ্টের কথা? বলছি ঐশির কথা, যে কিনা পিতা-মাতার অতিরিক্ত শাসন এবং বয়সন্ধিকালে সঠিক পরিচর্যার অভাবে মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে এক পর্যায়ে মদ, গাজা, ফেনসিডিল ইত্যাদি নেশায় মেতে ওঠে এবং সে একাই তার মা-বাবা কে খুন করে মেরে ফেলে। তাই পরিবারের উচিত সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা। এছাড়া আমাদের দেশে অনেক পরিবারে বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ সন্তানের আত্মহনেনর কারণ।অন্যদিকে বর্তমানে সাইবার বুলিং এর শিকার হয়ে আত্মত্যার ঘটনা বেশি শোনা যায়।

দেশের ৪৯ শতাংশ কিশোর-কিশারী এই সাইবার বুলিং এর শিকার। ছোটখাটো ঝামেলা, সম্পর্কে টানাপোড়েন, ইত্যাদি হলেই প্রেমিকার আপত্তিকর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে তরুণরা, যার ফলে নিজের আপত্তিকর ছবি দেখে আত্মহত্যা করছে অনেক তরুণী।

দেশে বেড়েছে ধর্ষণের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা, এতে অনেক ধর্ষণের শিকার তরুণী সমাজে মানসম্মানের কথা চিন্তা করে আত্মহনন করছে৷ শুধু তাই নয়, বর্তমানে আত্মহত্যা এক ধরনের সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আত্মহত্যা 'মহাপাপ' জেনেও তারা এই কঠিন পথ বেচে নেয়। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয় এই বৃত্ত থেকে তরুণদের বেরিয়ে আসতে হবে।

দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার ও সমাজ আত্মহত্যার কারণ হিসেবে দায় এড়াতে পারে না। আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে৷ একজন শিক্ষার্থী কেন আত্মহনন করেছে সে বিষয়টি জানতে হবে এবং নিয়মিত শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সমস্যার কথা জানার চেষ্টা করতে হবে এবং তা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আত্মহত্যা নিয়ে নেই কোনো সচেতনতা। শিক্ষার কোন অংশেই এটির নেতিবাচক ধারণাও দেয়া হয় না। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্য ও গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করতে হবে, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সামাজিক কাজের প্রতি উৎসাহিত করতে হবে,তাহলে আত্মহত্যার প্রবণতা কমতে থাকবে৷

এছাড়া শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটের ব্যাবহার নিয়ে আরো সচেতন করতে হবে যাতে করে তারা সাইবার বুলিং এর শিকার না হয়। আত্মহনন এর পেছনে আমাদের পরিবারগুলোর ও দায় রয়েছে। তাই প্রতিটি পরিবারের উচিত শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত চাপ না দেওয়া, ভালো ফলাফলের চেয়ে ভালো মানুষ হওয়ার বিষয়ে সন্তানদের আরো উৎসাহিত করতে হবে। এছাড়া তাদের বিভিন্ন শখের বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। পরিবারের পাশাপাশি আত্মহত্যা প্রতিরোধে সহপাঠীর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।

আত্মহত্যা কোনো প্রতিবাদের ভাষা নয়, এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত। আমাদের জীবনকে উপভোগ করতে শিখতে হবে। আত্মহত্যাকে প্রতিরোধে সমাজের সকলে মিলে যেমন সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে তেমনি তরুণদের অনুকূলে পরিবেশ গড়তে হবে।


সর্বশেষ সংবাদ