‘মামা’ ডাকটা অনেক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার
দুইদিন আগে এক ছাত্রী প্রশ্ন করল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাদের কাদের স্যার ডাকব? প্রশ্নের সাথে একটি ছবিও দিল যেখানে লেখা: ‘কলেজের কাউকে মামা ডাকা যাবে না। স্যার/ভাই সম্বোধন করতে হবে!’ এখানেই শেষ না।
প্রায়ই শুনি অমুক ইউএনও, তমুক মেজিস্ট্রেট বা সরকারি প্রকৌশলীকে ভাই বা আপা বলেছে বলে প্রচন্ড রেগে গিয়েছেন এবং ডিমান্ড করেছেন যেন স্যার বা মেডাম ডাকে। সরকারি কর্মকর্তারা ‘স্যার’ সম্বোধন শুনতে একদম মুখিয়ে থাকে। কেউ ভাই/আপা বা অন্য কিছু ডাকলে সহ্য করতে পারেন না। আমাদের সময়ে সাধারণ মানুষ সরকারি কর্মকর্তাদের ‘ইউএনও সাহেব’, ‘ইঞ্জিনিয়ার সাহেব’, ‘ডাক্তার সাহেব’ ইত্যাদি বলে সম্বোধন করতেন এবং তাতে উনারা মনে কিছু করতেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও শিক্ষিত সাধারণ মানুষ ড. X বা প্রফেসর X বলে ডাকতেন। এখন এগুলোও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এখন শিক্ষকদের সবাই ‘স্যার’ ডাকে! কিন্তু স্কুল কলেজের শিক্ষকদের ক্ষমতাবানরা ‘মাস্টর’ বলে ডাকে। সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে ‘স্যার’ ডাকের প্রতি এত ভালোবাসাতো শিক্ষকতা পেশা বেছে নিলেই পারতেন। কিন্তু শিক্ষকতা পেশাটা আবার পছন্দের তালিকায় সর্বনিম্নে। এইটা একটা বিরাট puzzle! স্যার শোনার বাসনা আছে কিন্তু যেই পেশায় by default স্যার শোনা যায় সেই পেশা পছন্দ না।
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কর্মচারী এবং হলের ছোটখাটো কর্মকর্তাও আমাদের স্যার ডাকতো। কেবল বিভাগের উচ্চ পদের ক্লার্ক আমাদের ভাই ডাকতো আমরাও তাদের ভাই ডাকতাম। তারপর ক্যাম্পাস ছেড়ে ইতালি চলে গেলাম, ফিরে এসে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হলাম এবং ১০ মাসের মাথায় পিএইচডি করতে চলে গেলাম। এরপর ফিরে এসে আবার শাজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে join করে ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলাম। তখনো দেশে যে একটা phase transition হয়ে গেছে তেমন একটা টের পাইনি। তারপর যখন আবাসিক হলের হাউস টিউটর হলাম তখন phase transition টা পুরোদমে টের পেলাম। দেখলাম ছাত্ররা হলের সকল কর্মচারীকে ছাত্ররা মামা ডাকে আর তারাও ছাত্রদের মামা ডাকে। শুধ তাই নয় রাস্তাঘাটে রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে ফুটপাতের বিক্রিতাদেরও মামা ডাকে এবং তারাও মামা ডাকে। এইসব দেখে বড় একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম কারণ আমার কাছে ‘মামা’ ডাকটা অনেক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার। আমার বড় মামা আমার কাছে ছিলেন ফেরেস্তাসম মানুষ। এছাড়া আমার আরেকজন মামা আছে আমার পরম বন্ধুসম তাই আমি সহজে কাউকে মামা ডাকি না।
আমরা বাঙালিদের একটা স্বভাব আছে সেটা হলো অপরিচিতদের ভাই, চাচা ইত্যাদি বলে সম্বোধন করা। এখন সেটা মামা ডাকে এসে থেকেছে। কেন আত্মীয়তার সম্পর্ক ধরে অপরিচিতদের ডাকতে হবে? এইটা আমার একদম পছন্দ না। বিশেষ করে কাউকে ‘মামা’ এবং ‘বুয়া’ ডাকা এখন অনেকটা গালিতে রূপান্তরিত হয়েছে। পশ্চিমা দেশের শিক্ষকদেরকেও কেউ স্যার ডাকে না। ইংল্যান্ডে ‘স্যার’ একটা উপাধি যেইটা ইংলেন্ডের রাজা বা রানী কাউকে bestow করে। শিক্ষকদের ছাত্ররা শিক্ষকের surname এর আগে মিস্টার বা ডক্টর বা প্রফেসর ইত্যাদি জুড়ে দিয়ে ডাকে। শ্রদ্ধা আসলে অন্য জিনিস। কাউকে স্যার ডাকা মানেই যে তাকে শ্রদ্ধায় লুটিয়ে স্যার ডাকে মোটেও এমন না। কিন্তু আমরা স্যার বা মেডাম ডাক শোনার জন্য প্রচন্ড লালায়িত। তাও যদি সেই ডাকটা কর্মের মাধ্যমে অর্জন করত। ভালো কাজ করে শ্রদ্ধা অর্জন করলে মানুষ এমনিতেই স্যার ডাকবে। আর স্যার না ডেকেও শ্রদ্ধা দেখানো যায়। শ্রদ্ধা বিষয়টা যত উলঙ্গ করে দেখানো হয় ততই সেটা প্রমান করে সমাজটা আসলে অগ্রগামী না। এইটা অনেকটা ছবি আর অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবির মধ্যে পার্থক্যের মত। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে, স্যার ডেকে, সিগারেট নিভিয়ে ফেলে সম্মান দেখালে মনে হয় আমাকে আন্ডার এস্টিমেট করছে। এর মধ্যে আমি দেখানো সম্মান দেখি। সম্মান যখন অন্তর থেকে আসবে আর আমাকে বুদ্ধিমান ভাববে তখন সম্মান দেখানোটা অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের সমাজটা এখনো সেই জায়গায় পৌঁছেনি। এখানে দেখিয়েই সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। কিন্তু তারপরেও অপরিচিতদের মামা, বুয়া, ভাই, চাচা ডাকা বন্ধ করতে হবে এবং বন্ধ হওয়া উচিত।
ব্রিটিশরা নিজের দেশে ‘স্যার’ ডাকা চালু না করলেও ভারত উপমহাদেশে এসে আমাদের মুখে ‘স্যার’ শুনতে মুখিয়ে থাকতো। আমরা সেই কলোনিয়াল লিগেসি এখনো বহন করছি।
লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়