নাগর্নো-কারাবাখ চুক্তি: তুরস্ক এবং রাশিয়ার ভূমিকায় মুখ্য
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত, তখন আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যবর্তী নাগর্নো-কারাবাখ যুদ্ধের সমাধানের একটি অসাধারণ প্রক্রিয়া চলছিল। এই অঞ্চলে তাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকলেও, রাশিয়া এবং তুরস্ক আবারও যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক শক্তির সম্পৃক্ততা ছাড়াই একটি আঞ্চলিক সংকট সমাধান করে ফেললো এ সময়।
সদ্য অনুষ্ঠিত মার্কিন নির্বাচন সমাপ্তির আগে, রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি হয় যাতে আর্মেনিয়া দখলকৃত ভূখণ্ড থেকে সরে আসতে সম্মত হয়। চুক্তি অনুসারে তুর্কি এবং রাশিয়ার সেনাবাহিনী যৌথ নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি কেন্দ্রে এক সাথে কাজ করবে, যার অবস্থান আজারবাইজান নির্ধারণ করবে।
গত এক দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দিকে মনোনিবেশ করায় ভূমধ্যসাগর, বাল্টিকস, উত্তর আফ্রিকা, ককেশাস এমনকি মধ্য প্রাচ্যে কর্তৃত্বের শুন্যতা সৃষ্টি হয়।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই অভাবনীয় পরিবর্তনের জন্য লিটমাস টেস্ট হিসাবে কাজ করে। ট্র্যাম্প নেতৃত্বাধীন ওয়াশিংটন প্রশাসন সিরিয়ার ভাগ্য মস্কো এবং তেহরানে ছেড়ে যায়, অন্যদিকে রাশিয়া মধ্য প্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার করে এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরেও এর অবস্থানকে সংহত করে।
ইউরোপীয় শক্তিগুলোর ইউক্রেনকে তাদের নিজস্ব মহাদেশীয় ব্যবস্থায় একীভূত করার প্রয়াসের জবাবে, রাশিয়া কেবল ক্রিমিয়াই নয়, পূর্ব ইউক্রেনের একটি শিল্প অঞ্চল ডোনেটস্ককেও নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে। এছাড়া আবখাজিয়াকে জর্জিয়া থেকে পৃথক করে রাশিয়া ককেশাস অঞ্চলে তার নিজস্ব প্রভাব প্রভাব বলয় বিস্তার করে।
লিবিয়ায় জাতিসংঘ-অনুমোদিত স্বীকৃত সরকার ‘গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল একর্ড’ (জিএনএ) যখন জেনারেল খলিফা হাফতার বাহিনীর হুমকির মুখে ছিল, তুরস্ক দেশটির বৈধ সরকারের পক্ষে রাজনৈতিক এবং সামরিক সহায়তা প্রদান করে। ফলস্বরূপ, জিএনএ তার রাজনৈতিক শক্তি সুসংহত করে হাফতার বাহিনী থেকে বেশ কয়েকটি শহর দখল করে নেয়। তুরস্ক ফয়েজ সররাজের বৈধ সরকারকে সমর্থন করে, আর হাফতারকে সমর্থন করে ফ্রান্স, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, গ্রীস ও রাশিয়া।
লিবিয়ার সঙ্কটে আমেরিকার অবস্থান অস্পষ্ট হলেও, তুরস্ক এবং রাশিয়া অনেকটা মুখোমুখি অবস্থান নেয়। তবে দ্বন্দ্বের পরিবর্তে দুই দেশই আঞ্চলিক সঙ্কটের মতো লিবিয়া নিয়েও একে অপরের সাথে আলোচনার টেবিলে বসে।
স্নায়ু যুদ্ধ শেষ হলেও আর্মেনিয়া আজারবাইজানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছিল এবং এর ২০% জমি দখল করেছিল। গত ৩০ বছরে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি আজারবাইজানীয় ভূখণ্ডে আর্মেনিয়ান দখল বন্ধে দৃশ্যত কিছুই করেনি।
ফলে,আজারবাইজানের অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তির কথা জেনেও অতি সম্প্রতি আর্মেনিয়া আজারবাইজানের বিরুদ্ধে আরও এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যা আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল প্যাসিনিয়ার জন্য ছিল স্পষ্টত ‘পলিটিকাল সুইসাইড’, কারণ আজারবাইজান নাগোরানো-কারাবাখ অঞ্চলে আর্মেনিয়ার দখলে থাকা প্রায় অর্ধেক ভূমি মুক্ত করে ফেলে ।
তুরস্ক কারাবাখ চুক্তিতে কার্যকর ভুমিকার মাধ্যমে এক শতাব্দীরও বেশি সময় পরে দক্ষিণ ককেশাসে তার অবস্থান পুনরায় সুসংহত করল। অপরদিকে আজারবাইজানের বিজয়ের মধ্য দিয়ে আজারবাইজানীয় সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষিত ও সজ্জিত করার জন্য তুরস্কের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হল।
তুরস্ক নাখচিভান অঞ্চল দিয়ে বাণিজ্য পথের মাধ্যমে মুলত ককেশাস অঞ্চলের সাথে সংযুক্ত ছিল। কারাবাখ চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের লাভগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি হ'ল এটি তুরস্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি টার্নিং পয়েন্ট কারণ তুরস্ক কেবলমাত্র স্বল্প মেয়াদেই নয়, দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে এ অঞ্চল থেকে উপকৃত হবে।
তুরস্কের যুদ্ধ ড্রোন ব্যবহারের ফলে আজারবাইজানীয় সেনাবাহিনী দুর্দান্ত সাফল্য অর্জন করে। আর্মেনিয়া পরাজিত হয়েছে এবং রাশিয়া এই অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য কৌশলগত সুবিধা অর্জন করেছে। এদিকে, সংকট নিরসনে ফ্রান্স কোনও অবদান রাখেনি। যদিও রাশিয়া ও তুরস্কের নিজ নিজ আঞ্চলিক স্বার্থ রয়েছে, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, শক্তিশালী দেশ দুটি আলোচনার মাধ্যমে আরও একটি আঞ্চলিক সংকট সমাধানে সফল হয়েছে।
মূল: ইহসান আকতাস, দি ডেইলি সাবাহ, ১৪ নভেম্বর ২০২০।
অনুবাদ: এহতেশামুল হক, পিএইচডি গবেষক,আঙ্কারা ইলদিরিম বেয়াযিত বিশ্যবিদ্যালয়, তুরস্ক।