কচ্ছপ হতে পারলে ভালো হতো, সাড়ে তিনশ বছর বাঁচতে পারতাম
বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদ একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং পাঠকপ্রিয় এই লেখক ২০১২ সালের ১৯ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।
২০০৮ সালে ১৩ নভেম্বর জন্মদিনে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শ্রেষ্ঠ লেখক হুমায়ূন স্যারের সাক্ষাৎকার নেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন আমি দৈনিক যায়যায়দিন-এ সাংবাদিকতা করি। পরের দিন ১৪ নভেম্বর পত্রিকায় সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়। পরে একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৪ হুমায়ূন আহমেদ-এর নির্বাচিত সাক্ষাৎকার নিয়ে সংকলন ‘হুমায়ূন কথন’ বইটি প্রকাশিত হয়। প্রতিশ্রুতিশীল নবীন সাংবাদিক দীপন নন্দী’র সম্পাদনায় বইটিতে ভূমিকা লিখেছেন আনিসুল হক। পাঠকের জন্য সেই লেখাটি তুলে ধরা হল-
একেকটি বছর যায়, আর মৃত্য আরো এগিয়ে আসে। কচ্ছপ হতে পারলে ভালো হতো, সাড়ে তিনশ বছর বাঁচতে পারতাম। কথাসাহিত্যিক-নাট্যকার-চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ গতকাল ষাট বছর পার করে একষট্টিতে পা রাখার দিন এভাবেই তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। বরেণ্য এ শিল্পস্রষ্টার জন্মদিনে পাঠক, সাহিত্যানুরাগীদের মিলন মেলায় পরিণত হয় পাবলিক লাইব্রেরির শওকত ওসমান মিলনায়তন। দিনব্যাপী নানা আয়োজনে পালন করা হয় দিনটি।
গতকাল সকাল সোয়া ১০টায় হুমায়ূন আহমেদকে তার মা বেগম আয়েশা ফয়েজ ফুল দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর পর ৬০টি বেলুন উড়িয়ে দেন। তারপর লেখকজননী ফিতা কেটে লেখকের একক বই মেলা উদ্বোধন করেন।
এ সময় লেখকের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের কোলে ছেলে নিষাদ হুমায়ূন এবং লেখকের বই প্রকাশক, ভক্ত ও অগণিত পাঠক উপস্থিত ছিলেন। সকাল সাড়ে ১০টায় হুমায়ূন আহমেদের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আমার আছে জল’-এর প্রদর্শনী শওকত ওসমান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। তার পাঠক, সাহিত্যানুরাগী, প্রকাশক এবং অগণিত দর্শকের সঙ্গে পরিবারসহ লেখক চলচ্চিত্রটি উপভোগ করেন।
দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানের দ্বিতীয়াংশে বিকালে লেখকের জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো হয় এবং ‘হুমায়ূন আহমেদ রচনাবলী’র প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে প্রিয় লেখকের জন্মৎসবের স্মারক হুমায়ূন ৬০, মিসির আলী সমগ্র এবং হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস গৌরীপুর জংশনের ফার্সি অনুবাদ- এ পাঁচটি নতুন বইয়ের মোড়ক উম্মোচন করেন লেখকের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর ময়মনসিংহ জেলার কুতুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিমার কেমিস্ট্রিতে গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি পান তিনি। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ সবাইকে বুঝিয়ে দেন সাহিত্যাঙ্গনে তিনি কালস্রোতে হারিয়ে যাবেন না। শুধু তুমুল জনপ্রিয় লেখকই তিনি নন, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকার হিসেবেও সফল। পরশ পাথরের মতো সাহিত্যের যে শাখাতেই তিনি হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন।
৬০তম জন্মবার্ষিকীতে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, একেটি বছর যায় আর মৃত্যু আরো এগিয়ে আসে। কচ্ছপ হতে পারলে ভালো হতো, সাড়ে তিনশ বছর বাঁচতে পারতাম। দেশ নিয়ে তার স্বপ্নের কথা বলেন, সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে যখন দেশের বাইরে যাই তখন নিজেদের ছোট ছোট মনে হয়, আমি এর উল্টোটার স্বপ্ন দেখি। একদিন সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে গর্ববোধ করবো। তার সৃষ্টি লজিক ও এন্টিলজিকের জনপ্রিয় চরিত্র মিসির আলী ও হিমু। হিমুর ফাঁসি নামে বইটিই এন্টিলজিক হিমু চরিত্রের সমাপ্তি ঘটাবে কি না এর উত্তরে তিনি বলেন, যতোদিন বেঁচে আছি হিমু বেঁচে থাকবে। কারণ আমিই তো হিমু। অগণিত পাঠকের উদ্দেশে বলেন, পাঠকের জন্য আমার এটুকুই বলা, আরো বেশি বেশি করে বই পড়ুন।
হুমায়ূন আহমেদের মা বেগম আয়েশা ফয়েজ ছেলে সম্পর্কে বলেন, তার লেখার জন্য কোনো নির্দিষ্ট পরিবেশের দরকার হয় না। প্রথম উপন্যাসের মাধ্যমেই তার পাকাপোক্তভাবে সাহিত্যাঙ্গনে আত্মপ্রকাশ। ব্যক্তি লেখক সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রচ রাগী হলেও তার রাগ বেশিক্ষণ থাকে না। যে রকমভাবে লিখছে লিখতে থাকবে। হুমায়ূন আহমেদ আরো অনেকদিন তার লেখার মাঝে বেঁচে থাকবে বলে তিনি কামনা করেন।
শুধু মধ্যবিত্ত জীবনের কথকতা সহজ সরল গদ্যে তুলে ধরে পাঠককে দশকের পর দশক মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। বাংলাদেশের সমকালীন এক আখ্যানকার বলা যায় তাকে। তিনি ১৯৯৪ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদক পান। এছাড়া বাংলা একাডেমি পুরস্কার, শিশু একাডেমি পুরস্কার, লেখক শিবির পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার, শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক, অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, বাচসাস টেনাশিনাস পদকসহ পেয়েছেন আরো অনেক পুরস্কার।
আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারিসহ হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো শুধু সুধীজনের প্রশংসা এবং জাতীয় পুরস্কারই অর্জন করেনি দর্শকদেরও হলমুখী করেছে।
লেখক: সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক