০৮ নভেম্বর ২০২০, ১৮:১৪

প্রশ্নফাঁস: ঢাবিতে ভর্তি হতে না পারাটা ছিল জীবনের বড় স্বপ্নভঙ্গ

  © টিডিসি ফটো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) চান্স পেয়েও আবার চান্স না পাওয়াটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নভঙ্গের একটি! চান্স পেয়েও চান্স না পাওয়া মানে! হ্যাঁ এটাই হয়েছিল আমাদের অনেকের সাথে। ২০১৮ সালে ঢাবির ডি-ইউনিটের প্রশ্নফাঁস হওয়ার ফলে আন্দোলন। তার প্রেক্ষিতে ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বাতিল করা হয়েছিল। বাতিল হওয়া সেই ভর্তি পরীক্ষায় আমার সিরিয়াল ছিল ১২২৩! যাই হোক প্রশ্নফাঁসতো হয়ে গেছে সেখানে তো আর কিছুই করার ছিল না। একমাস পর আবার পরীক্ষা দিলাম, পরীক্ষা দিয়েই বুঝতে পারলাম ভালো সিরিয়াল আসবে না। রেজাল্টও সেরকম হল। সিরিয়াল আসলো ২২৯৭! পরে ১৭০০ পর্যন্ত সাব্জেক্ট পেল।

এভাবেই একটি আবেগ, একটি স্বপ্নের সমাপ্তি হল। আবেগ হোক আর স্বপ্ন হোক মেডিকেল এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রস্তুতি নেওয়া ছাত্র ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। স্বপ্ন থাকে লাল বাস চড়ার। আমিও এর ব্যাতিক্রম ছিলাম না।

যখন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর পরিচয় পেয়েছি তখন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের মনের ভিতরে লালন করতে থাকি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইয়াদের ফ্রেন্ড লিস্টে জায়গা পেলেই মনে হত এইতো বুঝি চান্স পেয়ে যাওয়ার নিঞ্জা টেকনিক পেয়ে যাব। কিন্তু কি আর করার দ্বিতীয় বার চান্স না পাওয়াটা আমার নিজেরই ব্যার্থতা। এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করতে না পারার শাস্তি।

যা হোক ঢাবির পর ২০১৮ সালে সাস্ট এবং চবিতেও পরীক্ষা দিলাম, সাস্টে প্রথমেই ওএমআরে ভুল করার কারণে রেজাল্ট দেখার প্রয়োজন পড়েনি। চবিতে সিরিয়াল আসলেও সাব্জেক্ট পাওয়ার মতো সিরিয়াল আসলো না। শেষ হলো ২০১৮ সালের ভর্তি পরীক্ষা। কোথাও চান্স না পেয়ে, দিশেহারা হয়ে, ব্যার্থতার গ্লানি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসলাম।

এবার একটু পিছনে চলে যাচ্ছি, বাংলাদেশের আট-দশটি মফস্বল এলাকার মত আমিও একটি গ্রামের স্কুল থেকে প্রাইমারি পাশ করি। যদিও স্যারদের আশা ছিল পিএসসিতে এ+ পাবো কিন্তু না, পেলাম ফার্স্ট ডিভিশন (২০১০ এরপর গ্রেডিং সিস্টেম চালু হয়), এভাবে দেখতে দেখতে জেএসসি পরীক্ষা দিলাম, না এবার ও হলো না। নিজের নামের পাশে জিপিএ-৫ লেখাটা দেখা হল না।

নবম শ্রেণিতে সায়েন্স নিলাম। স্কুলেও মুটামুটি ভালোই করছিলাম। ক্লাসে ভালোই পারফরম্যান্স করতাম। তখনও বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিল না। এসএসসিতে খুব খারাপ না করলেও ৪.৬১ এর বেশি নিজের নামের সাথে যুক্ত করতে পারলাম না। বোর্ড পরীক্ষায় সর্বোচ্চ রেজাল্ট করার আজন্ম লালিত স্বপ্ন এবারও স্পর্শ করা হল না।

যাক তবুও আশাবাদী ছিলাম যে আরেকটা বোর্ড পরীক্ষা তো আছে,তার মানে আরেকবার নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছি। ইন্টারে নতুন উদ্যমে শুরু করলাম। কিন্তু এখন আমি আবিষ্কার করতে শুরু করলাম যে এসএসসির সায়েন্স আর এইচএসসির সায়েন্স এর মধ্যে বিরাট ফারাক।

সায়েন্স এর বিষয়গুলো মাথার উপর দিয়ে যেত। তার উপর কলেজের স্যাররা সায়েন্স সহজভাবে বুঝানোর মতো যোগ্যতাসম্পন্ন ছিল না। কোচিং করার জন্য জেলা শহরে পাড়ি দিলাম। ভাবলাম বিসিএস ক্যাডার টিচারদের ক্লাস হয়তো বুঝতে পারবো। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। মাথার উপর দিয়ে যেত ক্লাসগুলো। তারচেয়ে বড় সমস্যা ছিল আমি পড়ালেখাই করতাম না তখন খুব একটা। প্রচন্ড হতাশার মধ্যে সময় অতিবাহিত হতে থাকে। সোলায়মান সুখন, আয়মান সাদিক ভাইয়ের মোটিভেশনাল ভিডিও, শিবখেরার "তুমিও জিতবে", কিংবা টিম ফেয়ারলেস এর মোটিভেশন কোনো কিছু আমাকে পড়ালেখার মধ্যে সন্নিবিষ্ট করতে পারেনি।

কলেজে সবসময় হীনম্মন্যতায় ভোগতাম, কারণ ক্লাসের পারফরম্যান্স ভালো হক্তো না, স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসতে লাগলো। জেতাটা যেমন অভ্যাস, তেমনি হারাটাও একটা মারাত্মক অভ্যাস। আপনি যখন হারতে থাকবেন তখন আপনার ইতিবাচক ভাবনাগুলো কর্পূরের মতো উদাও হয়ে যেতে থাকবে।

আমার ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছিল। প্রত্যাশার সাথে বাস্তবতার সংঘর্ষে আন্তবিশ্বাস একটা গর্তের মধ্যে আটকা পড়ে যাচ্চিল।দেখতে দেখতে টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে দিলাম। কোনোরকম পাশ করলাম। প্রস্তুতি এতই খারাপ ছিল যে তখন আর জিপিএ-৫ এর আশাই করলাম না। জিপিএ-৪ নিয়েই আমার বোর্ড পরীক্ষায় সর্বোচ্চ রেজাল্ট করার স্বপ্নের পরিসমাপ্তি ঘটলো। কখনো সর্বোচ্চ রেজাল্ট না করতে পারার এই অতৃপ্তি এখনো নিজের মধ্যে অনুভব করি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা সম্পর্কে ঘাটাঘাটি করে বুঝতে পারলাম ইন্টারে আমার যে বেসিক তা দিয়ে অন্তত সায়েন্স এর ইউনিটে চান্স পাওয়াটা আমার জন্য অসম্ভব। তাছাড়া ততদিনে সায়েন্সের প্রতি আকর্ষণ ও শূন্যের কোঠায় পৌছেছিল। ইংরেজিতে খুব ভালো না হলেও ইংরেজি আমার খুব ভালো লাগতো, সাধারণ জ্ঞান আর ইতিহাসের প্রতি আকর্ষণ ছিল।বাংলাতে আমি সবসময় ভালো ছিলাম।

সবকিছু বিবেচনা করে স্রোতের গতির বিপরীতে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এর প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম।প্রস্তুতি খুব ভালো না হলেও অনেকটা আত্নবিশ্বাসী ছিলাম যে হয়তো ডি ইউনিটে চান্স পেয়ে যেতে পারি। পরীক্ষা ভালোই দিলাম। আলহামদুলিল্লাহ সিরিয়ালও মুটামুটি ভালোই আসলো। কিন্তু অযোগ্যদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় না। দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় আমারও হয়নি। বুঝতে পারলাম রেজাল্ট সবকিছু না হলেও অন্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ভর্তি পরীক্ষায় এটা অনেক বড় ব্যবধান গড়ে দেয়।Two years hard work shouldn't be triumphed by 3 months hard labour. যা হোক, চবিতে পরীক্ষা দিলেও রাবিতে পরীক্ষাই দিতে পারলাম না।চান্স না পেয়ে দিশেহারা হয়ে হতাশার অতলে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। তবুও আল্লাহকে ভুলে বা যাইনি। সেজন্য হয়তো তিনি আবার নতুনভাবে নিজের মধ্যে আশা সঞ্চয় করে দিলেন।

কিন্তু সমস্যা হলো বাড়িতে কেউই চায় না আমি আবার ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেই। কারণ উনাদের দৃষ্টিতে ততদিনে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে যে আমি ভার্সিটিতে পড়ার যোগ্যই নয়! যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবার চান্স পাওয়ার পর আমি পরিবারসহ এলাকার গর্বের সামগ্রীতে পরিণত হয়েছিলাম। ঐই সময়ে মানসিকভাবে বড় ভাই ছাড়া সাপোর্ট দেওয়ার কেউ ছিল না ফ্যামিলিতে। নিষেধ না করলেও আর্থিকভাবে সহায়তা করার আশ্বাস কারো থেকেই পেলাম না যদিও আমার পরিবারের সেই সামর্থ ছিল।

বড় মামার কাছ থেকে ২ হাজার টাকা এবং বড় ভাইয়ের থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবার সিলেট শহরে পাড়ি দিলাম। এবার শুরু হল একা একা সংগ্রাম। টিউশন করাতাম পাশাপাশি একটু একটু করে প্রস্তুতি নিতে থাকি। রমজান মাসে ২ কিলোমিটার জায়গা হেটে গিয়ে টিউশন করাতাম। রাস্তায় বসে বসে মাঝে মাঝে ভাবতাম যদি সেই প্রশ্নফাঁসটা না হতো তাহলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতে পারত। তবে খুব বেশি আফসুস করতাম না এটার জন্য। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলতাম আল্লাহ হয়তো এর চেয়ে ভালো কিছু আমার জন্য রেখেছেন। হয়তো স্বপ্নের ভার্সিটিতে কোনরকম একটা সাব্জেক্টে পড়া হত। কিন্তু আল্লাহ হয়তো এর চেয়েও ভালো কিছু আমার জন্য রেখে দিয়েছেন। সময় এগিয়ে যেতে লাগলো, কিন্তু আশানুরূপ প্রস্তুতির গতি বাড়াতে পারছিলাম না। ২টা টিউশন করে পড়ালেখা ঠিকমতো চালিতে যাওয়া সম্ভবপর হচ্ছিল না। যেই উদ্যম আর স্পৃহা ছিল সেটা দিয়েও খুব বেশি পড়তে পারতাম না।

এপ্রিল মাস শেষে ততদিনে বলার মতো জোবায়েরস জিকে বইয়ের মাত্র ১৫০ পৃষ্ঠার মত পড়া হল,নবম-দশম শ্রেণির গ্রামারের কয়েকটি টপিক্স! একজন বড় ভাইয়ের পরামর্শে স্পেশাল একটা মেসে উঠলাম। মেসের নিয়ম ছিল প্রতিদিন ন্যুনতম ১০ ঘন্টা পড়তে হবে! আমিতো ধারাবাহিকভাবে কখনো ৬ ঘন্টা করে পড়তে পারিনি, আর এখানে ১০ ঘন্টা কিভাবে পড়বো! রামাদ্বানে খুব চেষ্টা করেও ৪-৫ ঘন্টার বেশি পড়তে পারিনি। ২ কিলোমিটার রোদের মধ্যে হেটে, টিউশনি করনোর পর পড়ার এনার্জি থাকতো না।

শাপ মোচনের শুরুটা হয় ঈদের পরে। মেসে আসার পরদিনই মেসের পরিচালক ভাইয়া জানিয়ে দেন ১০ ঘন্টার কম পড়লে মেস থেকে বের করে দেওয়া হবে। তখন কথাটি খুব আঘাত করলেও গভীরভাবে নিজের লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করার ও সুযোগ করে দেয়। শুরু হল আমার ব্যাক্তিগত অভূতপূর্ব পরিশ্রম! স্মার্টফোন ব্যবহার বাদ দিলাম, টিউশনিতে যেতে হাটার সময় স্লিপ পেপারে ভোকাবুলারি পড়তাম, খাবার সময়ে ভোকাবুলারি পড়তাম,সব সময় আমার সাথে ভোকাবুলারির স্লিপ পেপার থাকতো। সপ্তাহে ৫ দিন টিউশনি করানোর কারণে ঐ ৫ দিন কোনভাবেই ১০ ঘন্টা পড়তে পারতাম না। পরিচালক ভাইয়া প্রতিদিন আমাকে কথা শুনাতেন। এদিকে প্রতি মাসের শুরুতে চিন্তায় থাকতাম এইমাসের মেসের খরচ কিভাবে ম্যানেজ করবো। মেস লাইফের এমন কোন মাস ছিল না যেই মাসে আমি টাকার জন্য উদ্ধিগ্ন থাকতাম না। প্রস্তুতি শুরু করার সময় থেকে প্রতি মাসে আমার বড় মামা ১০০০ টাকা করে দিতেন। টিউশনি থেকে পেতাম ২০০০ টাকা, আর বাকি টাকা কিভাবে মেনেজ হত একটু পরে বলছি।

এদিকে পরীক্ষার বাকি আছে মাত্র ৪ মাস কিন্তু টিউশনির কারণে পড়ালেখাটা মনের মতো করতে পারছিলাম না। প্রবাসে থাকা আমার দুইজন ভাইকে ফোন দিলাম, বুঝালাম ভাইয়া পরিক্ষার মাত্র ৪ মাস আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াটা আমার স্বপ্ন, এই তিনটা মাস আপনারা আমাকে পুরোপুরি সাপোর্ট দিন। ভাইরা রাজি হল। আমি জানতাম পরিবার আমাকে অবশ্যই সাপোর্ট দিবে যদি আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারি। সেই আশাতে তখন আল্লাহর উপর ভরসা করে একা একা এই কঠিন পথে পা বাড়িয়েছিলাম। কারণ একজন অপরাধীকেও দিনশেষে পরিবারই একমাত্র সাপোর্ট করে। আর আমার উদ্দেশ্য তো মহত।

Family is the greatest shelter provider of a man. সিলেট যাওয়ার পর থেকেই বাসা থেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রতি মাসে ২-৩ হাজার টাকা দেওয়া হত। টিউশনি ছেড়ে এবার পূর্ন মাত্রায় পড়ালেখায় মনোনিবেশ করলাম। খাওয়া-দাওয়া,ঘুম,নামাজ,তেলাওয়াত ছাড়া বাকি সময়টা শুধুই পড়তাম। দেয়ালে একদম পিঠ ঠেকে গেলে সামনে আগানো ছাড়া কোন উপায় থাকে না। আমারও অবস্থা তখন সেরকমই হল।খাতায় লিখে রাখতাম প্রতিদিন কত ঘন্টা পড়া হয়েছে। যেই ছেলেটা তার ছাত্র জীবনে কখনো একমাসে ১৫০ ঘন্টার উপরে পড়তে পারে নি সেই ছেলেটা এমন ও হয়েছে যে ৭ দিনে ৯০ ঘন্টার উপরে পড়েছে। বাড়িতে আসা-যাওয়ার সময় গাড়িতে পড়তাম, কোথাও বের হলে ২-৩ টা স্লিপ পেপার সাথে নিতাম।

আমার মনে আছে কুরবানির ঈদের দিনও আমি ৫ ঘন্টা পড়েছিলাম। প্রথমবার শর্টকাট ভাবে চান্স পাওয়ার ব্যার্থ চেষ্টা করেছিলাম। সাধারণ জ্ঞানের জন্য জোবায়েরস জিকে এবং ক্যাপ্সুল ছাড়া তখন সাধারণ জ্ঞান এর আর কোন বই পড়িনি। ইংরেজির জন্য কম্পিটিটিভ এক্সাম বইটা পর্যন্ত কিনি নাই।বই কিনতে কার্পণ্য করেছিলাম।কিন্তু এবার আর কোন কার্পণ্য করি নাই। বাজারের ভালোভালো সকল রাইটারেরই বই কিনেছি। যখনই কেউ ভালো বই রেফার করতো সাথে সাথে কিনে নিতাম। এভাবে নিজে নিজে বেশ ভালো প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। প্রথমে কোচিং করলেও পরেরবার আর কোচিং করা হয় নি।সেপ্টেম্বরে জাবির পরীক্ষা চলে এলো সি ইউনিট এবং এফ ইউনিটের পরীক্ষা দিলাম।

এফ ইউনিটে সিরিয়াল ১০০০ এর উপরে আসলো আর সি ইউনিটে তো পাজিশন ই আসলো না যদিও আমার মনে হয়েছিল পরীক্ষা বেশ ভাল দিয়েছিলাম। একটা ভালো পজিশন আসবে। সি ইউনিটের রেজাল্ট ভাইয়াকে বলার পর বললেন সবকিছু ঘুচিয়ে বাড়িতে চলে আয়, আমি বুঝে গেছি তোকে দিয়ে কিছু হবে না,বাড়িতে এসে হাল চাষ কর। এই কথা শুনার সাথে সাথে বলেছিলাম, আমি ডং করার জন্য এখানে আসি নাই, ফাজলামি করার জন্য আসি নাই,এতদিন অনেক কষ্ট করেছি,ভর্তি পরীক্ষা শেষ না করে আমি বাসায় আসবো না। সেদিন বারান্দায় বসে অঝোর ধারায় কেঁদেছিলাম। আর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছিলাম, আল্লাহ কেন আমার চান্স হয়নি খুব পড়লেও আমি যে নিশ্চিত চান্স পেতে পারি সেই আত্নবিশ্বাসটা ভেতর থেকে আসতো না তখন। কারণ আমি এমন এক গ্রামে বড় হয়েছি, যেখানে শুধু সেই গ্রামই নয়, এর আশেপাশের ৫-৭ টা গ্রাম থেকে তখন পর্যন্ত কেউ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে নাই। এমনকি আমার ব্যাচ থেকে আমাদের কলেজের কেউ পাব্লিকে চান্স পায় নি। ভাইয়ের কথা শুনে কষ্ট এবং হতাশ হলেও আমি সেদিন থেকেই আবার নতুন উদ্যমে পড়ালেখা শুরু করলাম। ততদিনে আমার সেই বিশ্বাস জন্য নিয়ে গিয়েছিল একমাত্র টেবিলে বসে থাকলেই নতুন নতুন কার্যকরী পদ্ধতি আয়ত্ত্ব করা সম্ভব। যে ১০০ এর ভিতরে থাকে সে নিশ্চয় ১০০০ এর ভিতরে থাকা ছাত্রের থেকে ১ পৃষ্ঠা হলেও বেশি পড়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে রাখলে নিজের মধ্যে অন্যরকম একটা শক্তি অনুভব করতাম।

জাবিতে পরীক্ষা দেওয়ার পর আমার সামনে অপশন ছিল তিনটি বিইউপি, বশেমুরপ্রবি, ইবি। এইচএসসিতে জিপিএ ৪ এবং এসএসসিতে ৪.৬১ থাকার কারণে বিইউপির এক্সাম ক্যান্ডিডেট লিস্টে টিকে গেলাম। (ন্যূনতম জিপিএ ৪+৪ সহ ৮.৫০, আমার ছিল ৮.৬১) । উপলব্ধি হলো যে, আমি হাজার ঘন্টা পড়লেও আমার চান্স পাওয়া বন্ধুর মত এত বই পড়তে পারিনি। বুঝতে পারলাম যে আমি যেই সময়ে ১০ টা বই পড়তে পেরেছিলাম ঐ সময়ে আমার চান্সপ্রাপ্ত বন্ধু ১৫ টি বই পড়েছিল। I was not a great student but i was great enough to accept my failure. Won is not for those who desire but for those who deserve it.

সাধারণ জ্ঞানে বেশি মনোযোগ দিলাম। বিউপির পরীক্ষার বাকি ছিল ১ মাসের মত। প্রফেসরস বিসিএস বাংলাদেশ, আন্তর্জাতিক বই দুটি আগে থেকেই কিনা ছিল। ওটা দুইবার শেষ করলাম । নাঈম স্যারের লাস্ট ভিউ(শেষ সময়ের প্রস্তুতির জন্য এর থেকে ভালো বই বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কেউ লিখতে পারে নি) ৩ বার পড়লাম। কুয়েশ্চন ভিউ পড়লাম্ ৩ বার। জোবায়েরস জিকে পড়লাম ২ বার,জাহাংগীরনগরস জিকে যেটা আগে পড়া ছিল, আরেকবার রিভিশন দিলাম। এই সাধারন জ্ঞানে কম মার্কসের কারনেই আমার ঢাবিতে চান্স হয়নি যদিও আমি বাংলা এবং ইংরেজিতে অন্য দশজনের থেকে কম নম্বর পাইনি। আমার লেখা এমনিতেই অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে, তাই আর বই এর নাম বলতে চাচ্ছি না। In short,the realization was that there is no short way to success. বিইউপির পরীক্ষা চলে আসলো। ইতিমধ্যে ব্যাপক পড়াশোনার ফলে নিজের ভিতর থেকে আত্নবিশ্বাস আসতে লাগল।২৫ অক্টোবর ছিল Fass এর পরীক্ষা। পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে জিজ্ঞাসা শুরু করলাম কে কয়টা বাদ দিয়েছে। পরীক্ষা ভালো হলে নিজে থেকেই বুঝা যায়। ভাইকে ফোন দিয়ে বললাম ভাই এই ফ্যাকাল্টি তে চান্স না হলে আর কোন ইউনিভার্সিটিতে আমার চান্স হবে না। ভাইয়া বললেন ইনশাআল্লাহ হয়ে যাবে। ২৬ অক্টোবর ছিল Sust+Fsss এর পরীক্ষা। Fsss এ যেহেতু প্যাশনেট সাব্জেক্ট ছিল তাই বিইউপিতেই পরীক্ষা দিলাম। Fass এর তুলনায় Fsss এর প্রশ্ন বেশ কঠিন হল তাই বুঝতে পারছিলাম না কতটুকু ভালো পরীক্ষা দিয়েছিলাম। বাসায় এসে বড় ভাইয়াদের বললাম ভাই ৮৮টা আন্সার করেছি। ভাই বললেন, ৬৫+ হলেই তোমার চান্স হয়ে যাবে। আমি হিসেব করে দেখলাম এর থেকে বেশি নাম্বার টিকবে।বিউপিতে পরীক্ষা দিয়ে গোপালগঞ্জ চলে গেলাম, ওখানে ২টা ইউনিটে পরীক্ষা দিলাম। আলহামদুলিল্লাহ পরীক্ষা ভালো হল। বশেমুরপ্রবিতে পরীক্ষা দিয়ে ট্রেনের ছাদে করে ইবিতে গেলাম, ইবিতে পরীক্ষা দিয়ে সিলেট আসার পরের দিনই সব ঘুছিয়ে, সিলেট থেকে চলে এলাম। কারণ সিলেট থাকার কোন কারণ ছিল না। বাড়িতে এসে রেজাল্টের অপেক্ষা করছি। রেজাল্ট দিতে দেরি করছিল। ও হ্যাঁ গোপালগঞ্জ যাওয়ার আগেই বিইউপির ভাইবার জন্য সিলেক্টেড লিস্ট দিয়েছিল। দুইটাতেই নাম আসলো। এদিকে বাড়িতে এসে ভাইবার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না। ভাইবার জন্য সম্ভাবনাময় প্রশ্নগুলো বারবার প্রাক্টিস করছিলাম। কারণ বিইউপির ভাইভাতে ১০℅ মার্ক ছিল। কিন্তু বিইউপিতে চান্স না পাওয়া কয়েকজন বড় ভাইয়ার কাছ থেকে শুনলাম বিউপিতে নাকি আর্মির সন্তান না হলে চান্স পাওয়া যায় না। আমার তো বাবা-চাচা,মামা, কেউ আর্মিতে নেই, তাহলে কি আমার চান্স হবে না?

যাক এইসব মাথা থেকে ঝেড়ে ভাইবা দিয়ে আসলাম। ভাইবা দিয়ে আসার পর অবশেষে আমার ভর্তি পরীক্ষার ইতি ঘটলো। রেজাল্ট দিতে দেুর করছিল। ১৩ নভেম্বর রাতে পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাস পড়ছিলাম। ভাইয়া বললেন এইসব পড়ালেখা দিয়ে কি করবা, তুমি তো কোথাও চান্স পাবা না। তার চেয়ে বরং কাল থেকে আমার সাথে ব্যবসার হাল ধরো। তখন বলেছিলাম ভাই আগে রেজাল্ট টা দিয়ে দিক তারপরে না হয় আমাকে জাজ করবেন। পরদিন সকালে নামাজ পড়ে শুয়ে আছি এমন সময় হঠাৎ গোপালগঞ্জ থেকে ফোন আসলো অপর প্রান্ত থেকে ভাই বললেন রেজাল্ট পাব্লিশড। রোল দিতে বললেন। এদিকে আমার হৃদস্পন্দন খুব বেড়ে গিয়েছেল। ভাই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বললেন,"রুমন মিষ্টি খাওয়াতে হচ্ছে" বললাম ভাই রেজাল্ট কি? তুমি আইন অনুষদে ৭৬ তম হয়েছো। আর সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে? ওটাতে ৬৫তম। ভাইয়ের কাছ থেকে রেজাল্ট শুনে বিশ্বাস হচ্ছিল না। নিজের আত্নবিশ্বাস এত তলানিতে চলে গিয়েছিল যে নিজের চোখে না দেখে বিশ্বাস করতে পারলাম না। ভাইয়ের ফোন নিয়ে নিজেই রেজাল্ট দেখলাম। না ভাইয়া ঠিকই বলেছেন। রেজাল্টের মধ্যে দিয়ে নিশ্চিত হল পড়ালেখা এখনি শেষ হচ্ছে ন। কারন আমার স্বপ্ন একটাই ছিল তখন। হয় পাবলিকে পড়ব না হয় পড়ালেখাই আর করবো না। প্রথমবার কোথাও ভর্তি হই নি।

দ্বিতীয়বার ও যখন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাচ্ছিল তখনো কোথাও ভর্তি হই নি। কারণ তখন যদি ঐই টাকা দিয়ে ভর্তি হয়ে যেতাম তাহলে হয়তো আমি বিইউপি,ইবি,বশেমুরপ্রবির ফর্মই তুলতে পারতাম না। বশেমুরপ্রবির রেজাল্ট আমার সকল শঙ্কা কাটিয়ে দিল। ইবিতে বি ইউনিটে সিরিয়াল আসলো ১৪২। তবুও মনের মধ্যে একটা অপূর্ণতা থেকে যাচ্ছিল। কারণ কুষ্টিয়া এবং গোপালগঞ্জ আমার বাসা থেকে অনেক দূর।তাছাড়া ঢাকা শহরে থাকার প্রবল ইচ্ছা ছিল। বিইউপির সার্কুলারে ২১ নভেম্বর ফাইনাল সেলেক্টেড লিস্ট পাবলিশড হওয়ার কথা ছিল। দুপুরে নামাজ পড়ে রেজাল্টের অপেক্ষা করছি। হঠাৎ বিইউপির একটা গ্রপে দেখলাম রেজাল্ট পাবলিশড। মামার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ছিলাম। পিসিতে ঢুকে Fsss এবং Fass এর রেজাল্টের পিডিএফ কপি ডাউনলোড দিয়ে Fsss এর রেজাল্টের নিচ থেকে উপর দিকে নিজের নাম খুজতে লাগলাম। প্রথমে খুজে ওয়েটিং লিস্ট, সেলেক্টেড লিস্ট কোথাও নিজের নাম খুঁজে পেলাম না। তাহলে কি বিইউপিতে চান্স হল না! আবার উপর থেকে একটা একটা করে নাম দেখতে লাগলাম। ৫০ নাম্বার সিরিয়ালে এসে নিজের নাম দেখে চোখ আটকে গেল। আবার রোল চেক করে দেখি না ঠিকই আছে। আর Fass এর রেজাল্ট! না নিজের কাছে মনে হওয়া সবচেয়ে ভালো পরীক্ষার পরও Fass এর প্রথম মেরিট লিস্টে জায়গা হয়নি (ভাইবা খুব বাজে হয়েছিল)।

যথার্থই মনে হল ‘আল্লাহর পরিকল্পনাই সর্বোত্তম পরিকল্পনা’। মানুষ তার চেষ্টার সর্বোচ্চ করতে পারে,কিন্তু ফলাফলটা ভাগ্যে নির্ধারিত নিয়মে আসে। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। মহান রবের দরবারে শুকরিয়া আদায় করে বাসার সবার জন্য রসগোল্লা নিয়ে বাড়ি গেলাম। হারাটা যদি অভ্যাস হয় তাহলে জেতাটাও একটা অভ্যাস। যখন জিততে শুরু করবেন তখন জিততেই থাকবেন।

All is well that ends well. একটা কাকতালীয় ঘটনা দিয়ে আমার লেখাটার সমাপ্তি ঘটাচ্ছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বার পরীক্ষার রেজাল্ট ২০১৮ সালের ২১ নভেম্বর হয়েছিল। আর ২০১৯ সালের ২১ নভেম্বর, ঠিক এক বছরের মাথায় বিইউপিতে দ্বিতীয়বারের ভর্তি পরীক্ষার ফল হয়েছিল।

লেখক: আইন বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস (বিইউপি)