শ্রীভুমিতে রবি ঠাকুরের ১০১ বছর
- ইরফান রিয়াদ
- প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২০, ০৮:৫৯ AM , আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২০, ০৮:৫৯ AM
সালটা ১৯১৯। অবকাশ যাপনের জন্য শিলং এসেছিলেন বিশ্বকবি। তাঁর হাতে তখন অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার একটি আমন্ত্রণ পত্র। তার জন্য শিলংয়ে কিছুটা প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ শিলং এসেছেন শুনে সিলেটের "ব্রাহ্মসমাজ" এর সাধারণ সম্পাদক গোবিন্দনারায়ণ সিংহ মজুমদার, ‘আঞ্জুমানে ইসলাম’, শ্রিহট্ট মহিলা সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠন সিলেট আসার অনুরোধ জানিয়ে কবির কাছে তারবার্তা পাঠায়।
সিলেট এম সি কলেজের এক শিক্ষক তার তারবার্তা কবিকে লিখেছিলেন, ‘Sylhet desires India’s greatest son to honour her by his visit’(ভারতের বরপুত্র শ্রীহট্ট ভ্রমণ করে তাকে গৌরবান্বিত করুন)।
কবি সিলেটের মানুষের আকাঙ্খাকে সন্মান জানিয়ে সেদিন অস্ট্রেলিয়া যাননি। তিনি এসেছিলেন সিলেটে।
শিলং তখন আসামের রাজধানী, কিন্তু আসামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর সিলেট। তখনো সিলেট-শিলং সড়ক তৈরি হয়নি। সিলেট থেকে শিলং যাতায়াতের পথ সহজসাধ্য ছিল না। সিলেটের উত্তর দিকের খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের বৃষ্টিবহুল চেরাপুঞ্জি পার্বত্য অঞ্চল পাড়ি দিতে হতো ঘোড়ার গাড়িতে। অথবা সেই পাহাড়ি ঢালু পথ ভারবাহী মানুষের কাঁধের ওপর ভর করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবে যাতায়াতে অভ্যস্ত ছিলেন না।
এভাবে শিলং থেকে সরাসরি সিলেট আসা সম্ভব নয় বলে গুয়াহাটি ফিরে গেলেন কবিগুরু। সেখান থেকে রেলযোগে লামডিং বদরপুর এবং করিমগঞ্জ হয়ে কুলাউড়া জংশন পৌঁছান ৪ নভেম্বর রাতে।
৫ নভেম্বর ‘শ্রীহট্ট বাজার’ রেলস্টেশনে পৌঁছান বিশ্বকবি। সঙ্গে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী।
সিলেট রেলস্টেশনে বিশাল এক জনতা আতশবাজি পুড়িয়ে, তুমুল হর্ষধ্বনিসহ কবিকে অভ্যর্থনা জানায়। সুরমা নদীর উত্তর তীরে মূল শহর কিন্তু রেলস্টেশন দক্ষিণ তীরে। তখনো সুরমা নদীর ওপর ‘কিনব্রিজ’ তৈরি হয়নি। কবিকে সেসময় নৌকায় নদী পার করা হয়। নৌকা যখন তীরে ভিড়ছিল, তখন নদীর তীরে দাঁড়ানো হাজারো মানুষের কণ্ঠে ধ্বনি ছিল-
‘রবীন্দ্রনাথ কি জয়’
‘বন্দে মাতরম’
‘আল্লাহ আকবর’!
ওই সময় চাঁদনি ঘাটকেও সুসজ্জিত করা হয়েছিল। মঙ্গলঘটসহ পুষ্প সম্ভারে লালসালু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল ঘাটের প্রতিটি সিঁড়ি। মৌলভি আবদুল করিমকে নিয়ে কবিগুরু একটি গাড়িতে করে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। তাঁর থাকার জন্য সে সময়ে সিলেট শহরের উত্তর-পূর্বাংশে ছোট একটি টিলার ওপর, যেখানে পাদ্রি টমাস সাহেবের বাংলো রয়েছে তার পাশের আরেকটি বাংলোতে ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ওই দিন সন্ধ্যায় কবি স্থানীয় ব্রাহ্ম সমাজের আমন্ত্রণে উপাসনা সভায় যোগ দেন।
৬ নভেম্বর সকালে স্থানীয় লোকনাথ হল, পরে যেটা সারদা হল নামে পরিচিত হয়েছিল সেখানে হাজারো উপস্থিতিতে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
খান বাহাদুর সৈয়দ আবদুল মজিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনা সভায় মানপত্র পাঠ করেছিলেন নগেন্দ্র চন্দ্র দত্ত। অনুষ্ঠান শেষে মুরারি চাঁদ কলেজের বাংলা ও সংস্কৃতির অধ্যাপক নলিনী মোহন শাস্ত্রীর আমন্ত্রণে তাঁর বাড়িতে কিছু সময়ের আতিথ্য গ্রহণ শেষে বেলা দুইটার দিকে সিলেট মহিলা সমিতি আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় যোগ দেন কবি। সেখান থেকে রবীন্দ্রনাথ শহরের উপকণ্ঠে মাসিমপুর এলাকায় অবস্থিত মণিপুরী পল্লিতে গিয়েছিলেন। ওই সময়ে মণিপুরী হস্তশিল্প প্রদর্শনী ছাড়াও তারা কবিকে মণিপুরী নৃত্য এবং গান দিয়ে বরণ করেছিলেন।সেখানে তিনি মণিপুরী নৃত্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মণিপুরী সংস্কৃতি তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল, পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনে তিনি তাঁর প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন পাঠ্যতালিকায় মণিপুরী নৃত্যের প্রবর্তন করে।
৭ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজের ছাত্রদের উদ্দেশে একটি বক্তৃতা করেছিলেন। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আকাঙ্ক্ষা’। সেই বক্তৃতা কিশোর সৈয়দ মুজতবা আলীকে নাড়া দেয়। কিছুদিন পর তিনি কাউকে না জানিয়ে কবিকে একটা চিঠি লিখেন। চিঠিতে মুজতবার প্রশ্ন ছিল, ‘আকাঙ্ক্ষাকে উচ্চ করার জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার?’
রবীন্দ্রনাথ এই চিঠির জবাব নিজ হাতেই দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের এই চিঠির জন্যই মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়তে যান।
রবীন্দ্রনাথ যখন সিলেট আসেন জমিদার কবি হাসন রাজা তখনো জীবিত এবং বর্তমান সময়ের তুলনায় নিতান্তই অপরিচিত। এ সময়ের ১২ বছর আগেই তাঁর গানের বই ‘হাছন উদাস’ বেরিয়েছিল। সিলেট সফরের সময় ‘হাছন উদাস’-এর একটি কপি রবীন্দ্রনাথের হাতে আসে। ৬ বছর পর ১৯২৫ সালে ভারতীয় দর্শন সমতির সভাপতির অভিভাষণে ‘হাছন উদাস’ এর একটি গান উদ্ধৃত করে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম্য কবির গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই সেটি এই যে, ব্যক্তিস্বরূপের সহিত সম্বন্ধসূত্রেই বিশ্ব সত্য'।রবীন্দ্রনাথের এই স্বীকৃতি হাসন রাজাকে সিলেটের শিক্ষিত সমাজে এবং পরবর্তীকালে সারা বাংলায় পরিচিত ও স্বীকৃত হতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে।
সিলেটের রুপ বৈচিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।সিলেটের ভাষার সাথে বাংলা ভাষার ব্যাপক মিল থাকলেও তার প্রশাসনিক পরিচয় ছিল সে আসামের একটি জেলা।এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপও ছিল অনেক।সিলেটের প্রকৃতি দেখে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বকবি সিলেটকে 'শ্রীভুমি' উপাধী দিয়েছিলেন। সিলেট সফরে কবিগুরুর সিলেটকে নিয়ে একটি কবিতাও লিখেছিলেন।
'মমতাবিহীন কালস্রোতে
বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হোতে
নির্বাসিতা তুমি
সুন্দরী শ্রীভূমি।
ভারতী আপন পুণ্যহাতে
বাঙালীর হৃদয়ের সাথে
বাণীমাল্য দিয়া
বাঁধে তব হিয়া।'
সে বাঁধনে চিরদিন তরে তব কাছে
বাঙলার আশীর্বাদ গাঁথা হয়ে আছে।’
আজকের এইদিনে সিলেটে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সিলেট আগমণের ১০১ বছরে বিশ্বকবির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: শিক্ষার্থী, আর্মি ইন্সটিটিউট অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন, সিলেট