এইচএসসি অটোপাস, শিক্ষার্থীদের কতটা ভোগাবে?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনার এই মহামারির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে। আমাদের দেশও প্রাথমিকভাবে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। এরই মধ্যে পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল হয়েছে। সেটি কিছুটা স্বস্তি এনে দিলেও গত ৭ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রী এক ঘোষণায় চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষা না নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা সরাসরি গ্রহণ না করে জেএসসি ও এসএসসির ফলের গড় অনুযায়ী এইচএসসির ফল নির্ধারণের কথা জানিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রীর এমন ঘোষণা আমাদের শুধু হতবাকই করেনি, লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
যারা গত দুই বছর ধরে পড়াশোনা করল, তার কোনো মূল্যায়ন না রেখে চার বছর আগে একজন শিক্ষার্থী কী করেছে, তা টেনে এনে এইচএসসির মূল্যায়নের মানদণ্ড করা কতটা মানানসই। শুধু মূল্যায়নই নয়, এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে উচ্চশিক্ষায়। উচ্চ মাধ্যমিকে যেসব বিষয় পড়ানো হয়, তার অনেকাংশ কাজে লাগে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায়। অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পঠিত বিষয়গুলো নির্দিষ্ট করে ভর্তি পরীক্ষার যোগ্যতায় দেখা হয়। ঠিক এসব বিষয় কীভাবে নির্ধারিত হবে, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ধরন কেমন হবে, তা এখনও পরিষ্কার নয়।
উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীকে সাতটি বিষয়ে ১৩টি প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিতে হয়। যে বিষয়গুলোর প্রাপ্ত ফলাফল পরবর্তী সময়ে নম্বরপত্রে তোলা হয়। এসএসসি কিংবা জেএসসি যে বিষয়ে একজন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে তার ভিন্নতা আছে উচ্চ মাধ্যমিকে। বায়োলজি, গণিত, পদার্থ, রসায়ন বিজ্ঞানের এ বিষয়গুলোর আলাদা পত্র রয়েছে, অন্যদিকে এসএসসিতে তা নেই। এসব বিচার করলে, বলা যেতে পারে, উচ্চ মাধ্যমিকের সঙ্গে মাধ্যমিকের বিস্তর ফারাক। আমি ঠিক জানি না, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঠিক কীভাবে জেএসসি ও এসএসসির মূল্যায়ন করবে, তবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে যা জেনেছি তাতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কখনোই কমবে না, বরং বাড়বে।
এ তো গেল কাগজে-কলমের ব্যাপার। কিন্তু একজন শিক্ষার্থী জেএসসি বা এসএসসিতে ভালো ফলাফল করলেই যে উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করবে সে যুক্তি কখনও মেনে নেওয়ার মতো নয়। বরং দেখা যায়, উচ্চ মাধ্যমিকে যারা ভালো ফলাফল করে তাদের একটি বড় অংশ নতুন করে ভালো ফলাফল করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনেকে কলেজে ওঠার পর থেকে কঠোর অধ্যবসায় করে নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলে। জিপিএ-৫ পাওয়ার আশায় পড়াশোনা করে।
এসএসসি আর জেএসসির ফলাফল টেনে এইচএসসির ফলাফল দেওয়ার চেয়ে মূল্যবান হতো যদি শিক্ষার্থীদের বার্ষিক ও নির্বাচন পরীক্ষার ফলাফলকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। গত কয়েক মাস ধরে দেশের সবকিছু খুলে দেওয়া হয়েছে। রাস্তাঘাটে যতসংখ্যক মানুষ প্রতিদিন চলাফেরা করছে, তাতে দেখে বোঝার ক্ষমতা নেই যে, এই দেশে করোনার প্রকোপ রয়েছে। দেশের অফিস-আদালত থেকে শুরু করে ফুটপাতের হকার পর্যন্ত কাজে নেমে পড়লেও আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছি মূলত স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বলে। আমি বলছি না এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে নেই। তবে একটা গণ্ডির মধ্যে রেখে আমরা এইচএসসি পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারতাম।
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, করোনার মধ্যে ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিচালনায় ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলের পরীক্ষা নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে সরকার। ব্রিটিশ কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর পাঁচ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী এসব পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ইতোমধ্যে নিবন্ধন করেছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের অনুরোধে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৩৫টি ভেন্যুতে এ পরীক্ষা নেওয়ার কথা ইতোমধ্যে জানিয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে। আর সেটি যদি সফল হয়, তাহলে বৈষম্যর শিকার হতে চলেছেন আমাদের সাধারণ পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণেচ্ছুরা।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী চলতি বছর ১৫ জুলাই পর্যন্ত ধনী ও মধ্যম রাষ্ট্রের ৪০ শতাংশ এবং গরিব রাষ্ট্রের ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তারা যে সুপারিশ করেছে, সেখানে পরীক্ষা বাতিল বা অটোপাসের কোনো কিছুই বলেনি। বরং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস ও পরীক্ষা সীমিত আকারে চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা তা করেতে পারিনি। বিশ্বের ঠিক কতটি দেশ পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করেছে তার কোনো পরিসংখ্যান আমি পাইনি। পাসের দেশগুলো এত বড় পরীক্ষা বাতিলের ফাঁদে পা দেয়নি বলে জেনেছি।
তবে আমরা এই পরীক্ষা বাতিলের আগে কিছু চিন্তা করতে পারতাম। লিখিত পরীক্ষার পরিবর্তে ঘণ্টাব্যাপী নৈর্ব্যক্তিক বা এমসিকিউ আকারে পরীক্ষার কথা চিন্তা করা যেত কিনা তা ভাবনার বিষয় ছিল। পরীক্ষা শুধু প্রথমপত্র কিংবা প্রথম বা দ্বিতীয়পত্র মিলে একটি পত্র আকারে নেওয়া যেত। ওএমআর উত্তরপত্রের মূল্যায়নের সময় লাগত খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষায় হাজার হাজার ছেলেমেয়ের ফলাফল যেমন কয়েক দিনের মধ্যে দিয়ে দিত, ঠিক তেমনিভাবে এবার এইচএসসি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেত বলে আমি মনে করি।
এ ক্ষেত্রে একদিনে ডাবল শিফটে পরীক্ষার ব্যবস্থা মোটেই খারাপ কিছু ছিল না। ১৩ লাখ শিক্ষার্থীর সাত বিষয়ে পরীক্ষা দিতে সাত দিন লাগত। সেটি তিন সপ্তাহ কিংবা এক মাসের মধ্যে কয়েকটি শিফটে নেওয়া যেত। পরীক্ষা কেন্দ্রে অতিরিক্ত ভিড় এড়ানোর জন্য কয়েকশ বেশি কেন্দ্র করা যেত। কিংবা স্থানীয় কলেজগুলোতে শিক্ষকরাই পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারতেন।
শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আয়োজনও এ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে করা যেত। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আওয়তায় একটি অতিরিক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষা করা যেত। এইচএসসি ফলাফলের সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলও দেওয়া সম্ভব হতো। যারা পাস করবেন, তারা মেধা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতেন। ফলে লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধরনা দিতে হতো না।
বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের জন্য এবারের এইচএসসির ফলাফল যেমন ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে, তেমনি যেসব ছেলেমেয়ে শুধু নিজের মেধায় এগিয়ে যেতে চান, তারা কিছুটা মানসিক কষ্ট পাবেন। আত্মতুষ্টির অভাব যেমন তারা বোধ করবেন, ঠিক তেমনি অটো পাসের গল্গানি সারাজীবন বহন করতে হবে। এই পাবলিক পরীক্ষার গুরুত্ব অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষার মতো নয়। শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে পরীক্ষার বিষয় কমিয়ে এনে কিংবা পরীক্ষার ধরন পাল্টে পরীক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব কিনা তা পুনরায় ভাবা দরকার।
লেখক: গবেষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান
সূত্র: সমকাল