উচ্চমাধ্যমিকে গড়ের ফলাফল এবং উচ্চ শিক্ষার ভর্তি পরীক্ষা

লেখক রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী
লেখক রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী

২০২০ এর মহামারী অনেক নতুন কিছুর সাথেই আমাদের পরিচিত করেছে। করোনা মহামারী আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ভীষণ ভাবে বিভিন্ন দিক দিয়ে প্রভাবিত করেছে। এরই সর্বশেষ উদাহরন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল এবং পরীক্ষা ছাড়াই জেএসসি ও এস এস সি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে এইচ এস সি এর পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারনের সরকারি সিদ্ধান্ত।

এই সিদ্ধান্ত কি ভাল হয়েছে? ব্যাপারটা বেশ আপেক্ষিক। যদি পরীক্ষা নেওয়ার সাথে তুলনা করা হয় তাহলে অবশ্যই ভালো হয় নি। পরীক্ষার বিকল্প হলো শুধুই পরীক্ষা। কিন্তু যদি সার্বিক অবস্থার কথা বিবেচনা করা যায়, তাহলে আমার মতে সিদ্ধান্ত ঠিকই আছে। এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প আমাদের হাতে ছিলো না।

অনেকেই বলতে পারেন যে, দেশে সব কিছুই প্রায় স্বাভাবিক। তাহলে পরীক্ষা নিতে সমস্যা কোথায় ছিলো? আসলে প্রশ্নের মাঝেই উত্তরটি আছে। প্রায় স্বাভাবিক। পুরোপুরি স্বআভাবিক না। অনেক বহুজাতিক কম্পানি, বিভিন্ন দূতাবাস, বিশ্বব্যাংক সহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো বাসা থেকে কাজ ( ওয়ার্ক ফ্রম হোম ) চালিয়ে যাচ্ছে।

অন্য অনেক কম্পানি তাদের সক্ষমতার অভাবে অথবা ব্যাবসার ধরনের জন্য বাসা থেকে কাজ চালাতে না পারলেও স্বাস্থ্য বিধি মানার চেষ্টা করছে। অবশ্যই পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হচ্ছে না। সাথে যোগ হয়েছে আমাদের অসচেতনতা। আর তাই করোনা পরীক্ষার তুলনায় সংক্রামণ শনাক্তের হার আমাদের দেশে বাড়ছেই। সাথে মৃত্যুও।

এই অবস্থায় প্রায় ১৪ লাখ পরীক্ষার্থীর ( আক্ষরিক অর্থে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন) পরীক্ষা নিতে যেয়ে মোটামোটি প্রায় ৪০ লাখ মানুষকে নতুন করে স্বাস্থ্য ঝুকিতে ফেলার তেমন কোনো যুক্তি সংগত কারণ নেই।

আর একটি ব্যাপারে অনেকেই বলছেন যে, যারা জে এস সি এবং এস এস সি তে তুলনা মূলক ভাবে খারাপ ফলাফল করেছিলেন তাদের নিজেদের উন্নতি করার সুযোগ ব্যাহত হলো। কথাটি আংশিক ভাবে সত্য। অনেকেই এসএসসি তে কম সিজিপিএ পেলেও এইচএসসিতে ভালো সিজিপিএ পেয়ে থাকেন।

আমার ধারণামতে সংখ্যাটা ৫% এর বেশি না। এই ৫% এর জন্য ব্যাপারটি আসলেই বেশ দুঃখের। আসলে গড় এর ব্যাপারই হলো বেশি সংখক ব্যাপারকে বিবেচনায় নেওয়া। তাই গড়ের ফলে বেশীরভাগ ছাত্র ছাত্রীই সুবিধাভোগীর দলে। তাহলে কি সুবিধাঞ্চিত ৫% এর জন্য আমাদের কিছু করার নেই? অবশ্যই আছে। শুধু সেই ৫% এর জন্য না। বরং এবার পাশ করা সবার জন্যই আমাদের কিছু করার আছে।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বেশি দরকারী কেনো? কারণ এই পরীক্ষার ফলাফল বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ভর্তির ব্যাপারে বেশ বড় অবদান রাখে। এবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে অবশ্যই তাদের ভর্তির নিয়ামবলিতে বিশেষ পরিবর্তন আনতে হবে যেনো মেধার সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমেই ভর্তি করা সম্ভব হয়।

তাই প্রথমেই এইচএসসি এর ফলাফলের উপরে নম্বরের শতকরা হার কমিয়ে দিতে হবে। উদাহরন স্বরুপ বলা যায় ২০০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষাতে আগে ৮০ নম্বর ছিলো এসএসসি এবং এইচএসসি র ফলাফল এর উপরে ভিত্তি করে। বাকি ১২০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হতো। এবার প্রথমেই এই নিয়মটি বদল করতে হবে। এসএসসি এবং এইচএসসির ফলাফল এর উপরে ভিত্তি করে ৮০ নম্বরকে কমিয়ে ৪০ নম্বর করতে হবে।

এর ফলে গড় ফলাফলের জন্য যারা সুবিধা পেয়েছিলো এবং যারা অসুবিধায় পরে ছিলো তাদের মধ্যে পার্থক্য কমে যাবে। আর ১৬০ নম্বরের পরীক্ষায় মেধা যাচাই এর জন্যও বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে।

এখন আসা যাক পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে। আমি বরাবরই গুচ্ছ পরীক্ষার বিরোধী। এর অনেকগুলো কারণের মাঝে একটা কারণ হলো এতে পরীক্ষার্থীদের যাচাই করার সুযোগ কমে যায়।

একটা ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক ইউনিটের পরীক্ষায় একদিন খারাপ করতেই পারে। কিন্তু সেই ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক ইউনিটের পরীক্ষায় ভালো করে কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হতে পারে। গুচ্ছ পরীক্ষা তার কাছ থেকে এই সুযোগটুকু কেড়ে নেয়। আর এই বার তো গুচ্ছ পরীক্ষা আরো নেওয়া উচিত না।

মহামারিতে পরীক্ষার্থী অথবা পরিবারের কেউ অসুস্থ্য থাকলে তার পরিক্ষা খারাপ হওয়া অথবা পরীক্ষা দিতে না পারা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। গুচ্ছ পরীক্ষা হলে সে একদিনই পরীক্ষা দিতে পারবে। একদিনেই মোটামোটি তার বাকি জীবনের পথ ঠিক হয়ে যাবে। এমন বিপদের দিনে তার ভুল ঠিক করার সুযোগ তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া কোনো ভাবেই ন্যায্য না।

এখন কথা হলো তাহলে ভর্তি পরীক্ষা কিভাবে নেওয়া হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে শারীরিক ভাবে যদি পরিক্ষা নেওয়ার পরিবেশ না থাকে তাহলে অনলাইনে পরীক্ষা নিতে হবে। আর আমাদের মানতেই হবে,আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি বদল করার সময়ও এসেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে আমরা সবসময় সনাতন পদ্ধতির উপরে নির্ভর করে থাকতে পারবো না। আমাদের আজ অথবা কাল অনলাইন পরীক্ষা পদ্ধতিতে যেতেই হবে। পৃথিবীর বহু বিশ্ববিদ্যালয় এ পদ্ধতিতে তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে এখনই।

এখন কথা হলো এমন কিছু কি করা আমাদের দেশে কি সম্ভব? এতে কি পরীক্ষার মান, প্রশ্ন ফাসের সমস্যা, পরীক্ষার গ্রহনযোগ্যতা ঠিক থাকবে? আমরা ব্যাপারটা একটু খাতিয়ে দেখি। প্রথমেই বলে রাখি ব্যাপারটার সাম্ভব। অবশ্যই সম্ভব। পৃথিবীতে এমন ধরনের পরীক্ষা চালু আছে। জিআরই তার একটি উদাহরন। অনলাইনে পরীক্ষা হবে। একটা নির্দিষ্ট সময়ে পোর্টালটি খোলা হবে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে তা বন্ধ হয়ে যাবে। প্রশ্ন অবজেক্টিভ ধরনের হবে যাতে সফটওয়ার দ্রুত দেখে ফলাফল দিতে পারে।

এমনকি চাইলে কিছু ছোট প্রশ্নও দেওয়া যেতে পারে। ব্যাপারটা একদমই সহজ। এমন একটি সফটওয়্যার আমাদের কিছু স্টার্টআপকে দিলেই বানিয়ে দিবে। আর গাইড করার জন্য আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা তো আছেনই।

এখন পরীক্ষার্থীরা কিভাবে পরীক্ষা দিবেন? তারা নিজেদের লাপটপ মোবাইল থেকে দিতে পারেন। যাদের তা নেই, তারা তাদের ভাই, বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশীর কাছ থেকে যোগাড় করবেন। যারা সেটাও পারবেন না, তারা জেলা প্রশাসক অথবা থানা নির্বাহী অফিসার বরাবর আবেদন করলে নির্দিষ্ট কক্ষে, নির্দিষ্ট দিন, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেখানে তাদের ল্যাপটপ অথবা মোবাইল সর্বরাহ করা হবে।

দরকারে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার জন্য পরীক্ষার্থীরা ল্যাপটপ বা মোবাইলের আবেদন করেছেন, সেই বিশ্ব বিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা অনুপাতে জেলা প্রশাসন অফিসে একটি ফি ও দিতে পারে। এই টাকা ফর্ম বিক্রির টাকা থেকে আসবে।

এবার বিদ্যুত এবং ইন্টারনেট সংযোগের ব্যাপারে কথা। যেহেতু ল্যাপটপ এবং মোবাইলে পরীক্ষা দেওয়া যাবে তাই বিদ্যুত সংযোগ চলে গেলেও তেমন ক্ষতি নেই। তবে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটির ব্যাপারটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু বাংলাদেশের বেশীর ভাগ জায়গায়ই মোবাইল ইন্টারনেটের আওতাধিন তাই এটি খুব বড় সমস্যা হবে না বলেই আমার ধারণা।
পরীক্ষার সময়ে পরীক্ষার্থীদের সততা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়? এটাও তেমন কঠিন কিছু না। প্রত্যেক প্রশ্ন এর জন্য নির্দিষ্ট সময় থাকবে।

এর পরে সেই প্রশ্ন চলে যাবে এবং আবার আসবে না। একটা প্রশ্নের জন্য প্রশ্ন ভেদে সর্বচ্চ ৪০ সেকেন্ড থেকে ২ মিনিট সময় থাকবে। এটিই পরীক্ষার্থীর সততা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ঠ বলে মনে করি।

সবসময়ই আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যাবস্থায় মেডিকেল, প্রকৌশল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অতিগুরুত্বপূর্ণ। আর এবার ব্যাপারটা আরো বেশি। আমাদের মেধার সঠিক মূল্যায়নের জন্য সঠিক ভাবে, সঠিক পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাবস্থা করতে হবে। এই ভর্তি পরীক্ষার সাথে সরাসরি ভবিষ্যত জড়িত প্রায় ১৪ লাখ পরীক্ষার্থী আর ৫০ লাখ পরিবার সদস্যের। আমি আশা করি এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় গুলি সর্বচ্চ যত্নশীল হবে।

 

লেখক: সহকারি অধ্যাপক, ফাইন্যান্স, ডিপার্টমেন্ট অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন,  বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি।   


সর্বশেষ সংবাদ