ক্যাম্পাসে সবাই পায়ের ছাপ রেখে যায়, আমি রাখব হুইলচেয়ারের ছাপ
আমার দুটো পরিচয়, একটা সাংমা অর্থাৎ আমি আদিবাসী; আরেকটা আমার হুইলচেয়ার, যা ছাড়া আমি একমুহূর্তও চলতে পারিনা। জন্মের পরে সব শিশুই কেঁদে ওঠে, কিন্তু আমি অন্যদের চাইতে বেশিই কাঁদছিলাম দেখে নার্স সন্দেহ করে আমার দেহে কোথাও আঘাত লেগেছে কি না। পরবর্তীতে বারবার এভাবে শরীরে আঘাত পেতে থাকায় ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে তারা জানায় আমি ‘ব্রিটল বোন ডিজিজ’ এ আক্রান্ত।
যার কারণে আমার হাড় স্বাভাবিকের তুলনায় ভঙ্গুর। ক্লাস থ্রিতে যখন পড়ি, তখন দুই পা এবং এক হাতে আঘাত পাই। এরপর আর হুইলচেয়ার ব্যবহার না করে উপায় ছিলো না। আমার নিজের হুইলচেয়ার ব্যবহার করার ইচ্ছে ছিল না তেমন, কারণ আমাদের দেশের মানুষ প্রতিবন্ধিতাকে স্বাভাবিকভাবে নেয় না। স্কুলগুলোও আমাকে ভর্তি করতে চাইতো না কারণ তাদের আশঙ্কা ছিল খেলতে গিয়ে আমি কোনোভাবে আঘাত পেতে পারি।
শ্রেণিকক্ষে যেতে সিড়ি ব্যবহার করতে হতো বলে অনেক স্কুল তাদের ক্লাসগুলো নিচতলায় নেয়ার ঝামেলায় যেতে চায়নি। আমার বাবা-মাকে অনেক অবহেলার শিকার হতে হতে হয়েছে আমাকে স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে। মাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করার পরেও অনিশ্চয়তা ছিল ভালো কলেজে পড়তে পারবো কিনা এটা নিয়ে। পরবর্তীতে বাসার কাছেই একটা সরকারী কলেজে ভর্তি হই।
কলেজের বন্ধুদের ফেসবুক পোস্ট থেকে টিএসসি সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। পহেলা বৈশাখ, বসন্তবরণ উৎসবসসহ বিশেষ দিবস উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনগুলো টিভিতে দেখে এখানে পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মায়। আমার পক্ষে সম্ভবও ছিলো না ঢাকার বাইরে কোথাও পড়তে যাওয়ার। কোচিং করার সুযোগ আমার ছিল না, বন্ধুরা সবাই কোচিং করতো বলে আমাকে তাদের উপেক্ষার শিকারও হতে হয়েছে। কারণ তাদের ধারণা ছিল আমি কোচিংয়ে না গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার দিন যখন আসি, সেদিনই প্রথমবারের মতো ভালোভাবে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখার সুযোগ হয়। এখানেই ভর্তি হতে হবে এমন একটা অনুভূতি বোধ হয় নিজের মধ্যে। আমার সিট পড়েছিল কলাভবনের চারতলায়, আর এখন আমি সেখানেই ক্লাস করি।
একটা ব্যাপার আমাকে খুব করে ভাবায়; এই যে আমি পাঁচটা বসন্ত এই ক্যাম্পাসে কাটালাম, এই কলা ভবন- চারুকলায় আড্ডা দিলাম বন্ধুদের সাথে- অথচ এই ক্যাম্পাসেই কিনা আমার কোনো পায়ের ছাপ থাকবে না। কিন্তু তখনই আবার ভাবি, সবাই যেমন তাদের পায়ের ছাপ রেখে যায় ক্যাম্পাসে; আমি রেখে যাবো আমার হুইলচেয়ারের ছাপ।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক সদস্য
(ফেসবুক থেকে নেয়া)