পরীক্ষা ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক পাসের সুবিধা-অসুবিধা
‘এইচএসসি পরীক্ষায় সবাই পাস’- সমকালের এই শিরোনাম দেখেই ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে মহান শিক্ষা আন্দোলনের সাফল্যের ছবিটি মানসপটে ভেসে উঠল। আইয়ুব-মোনায়েমের দুরভিসন্ধিমূলক শিক্ষানীতিতে বাঙালির শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও জাতীয়তাবাদের মূলে শক্ত কুঠারাঘাত আসে। দলমত নির্বিশেষে- ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্রলীগের নেতৃত্বে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। জালিমশাহির পুলিশের গুলিতে ওয়াজিউল্লাহ, মোস্তফা ও বাবুল শাহাদাত বরণ করেন। ১৯৬২ সালের মহান শিক্ষা অন্দোলনটি পূর্ব বাংলার, সম্ভবত তখন পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ সর্বজনীন গণআন্দোলন। শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নির্বিশেষে সব ছাত্রছাত্রী এতে অকুতোভয় সাহসিকতার সঙ্গেই স্বৈরশাসকের চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
নেতৃত্বে সৃষ্টিসফল আজকের চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী জনবন্ধু শেখ হাসিনা তখন ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের তুখোড় নেতা হিসেবে শক্তিশালী সরব আন্দোলনে রাজপথে ঝড় তুলেছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন সেলিনা হোসেন, বেবী মওদুদ, শিরীন খান, নাজমা শামস প্রমুখ দলমত নির্বিশেষে অনেক নেতা। প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গগনবিদারী স্লোগান আর সরকারকে পর্যুদস্ত করার নিত্যনতুন কর্মকাণ্ড। আন্দোলনে শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, সিরাজুল আলম খান, আনোয়ার আনসারি খান ও পঙ্কজ ভট্টাচার্যের সঙ্গে যেমন মিছিল-মিটিং করেছি; তেমনি আবুল হাসনাত, মওদুদ আহমদ, মিজানুর রহমান শেলী, শাহ আব্দুল হালিম এবং এআর ইউসুফ প্রমুখ নেতার পাশেও থেকেছি।
অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের স্কুল-কলেজে গিয়ে পিকেটিং করার দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হতো ছোট নেতাদের। আজিমপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে তখন প্রধান শিক্ষক ছিলেন অত্যন্ত কড়া মেজাজের বিখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তি কাজী আম্বর আলী। নেতৃবৃন্দের আদেশে দিলারা জামান আর আমি ওই স্কুলে পিকেটিং করতাম এবং নানা ফন্দিফিকিরে ছাত্রীদের বের করে নিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল মিছিলে শামিল করে দিতাম।
১৯৬২ সালের সম্পূর্ণ সফল শিক্ষা আন্দোলনের তীব্রতায় আইয়ুব-মোনায়েম পিছু হটেন। বাতিল হয়ে যায় সর্বনাশা বাঙালি স্বার্থবিধ্বংসী শিক্ষা আন্দোলন। এর একটা পরিণতি হিসেবে ওই নীতির অধীনে তিন বছরের ডিগ্রি পাস কোর্সের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নকারীরা অটো প্রমোশনে রাতারাতি গ্র্যাজুয়েট হয়ে যান। এর বেদনা অনেককেই দীর্ঘদিন বইতে হয়। তবে অনেকেই পরবর্তী সময়ে মাস্টার্স পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গৌরবের পথে ফিরে আসেন।
২০২০ সালে এইচএসসি পরীক্ষা বিশ্ব অর্থনীতিকে লণ্ডভণ্ড এবং ধনী, মধ্যম, গরিব রাষ্ট্র নির্বিশেষে সবাইকে এক কাতারে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে। অবশ্য কম বিত্ত ও বিত্তহীনদের ওপর অভিঘাতটি অনেক বেশি নির্মম। সে পরিপ্রেক্ষিতে এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গ্রহণে শিক্ষার্থীদের কভিডে আক্রান্ত হওয়া থেকে সুরক্ষা দিতে সবাইকে পাস করিয়ে দেওয়া হলো। জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে ফল নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিয়ে অত্যন্ত সঠিক কাজটিই করেছে সরকার। বৃত্তি ও স্বীকৃতিপ্রত্যাশী এবং পূর্ববর্তী পরীক্ষা খারাপ করারা এইচএসসিতে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষায় হোঁচট খেলেও জনস্বার্থে সর্বজনীন পাসের সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি প্রক্রিয়া কী হবে তা নির্ধারণ করা। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে পরিস্থিতির উন্নতি হলে সারাদেশে অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমেই এ বিষয়ে সুষ্ঠু নিষ্পত্তি হতে পারে। এতে আমরা ভারতসহ অন্যান্য দেশের অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষার বস্তুনিষ্ঠতায় যুক্ত হতে পারব। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ২০১৬ সাল থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ইউজিসি ও অন্যান্য সংস্থাকে অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষার তাগিদ দিয়ে আসছেন। এবারের ধাক্কায় আশা করি, মহলবিশেষের প্রতিরোধ ভেঙে যাবে।
যদি অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষার পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দিকনির্দেশনায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ভর্তি পরীক্ষা ও এসএসসির ফলের সমন্বয়ে ভর্তি যোগ্যতা নির্ধারণ করবে ২০২১ সালের বসন্তকালীন সেমিস্টারের জন্য। এ ছাড়া মেধাবৃত্তি, উপবৃত্তি এবং অন্যান্য অর্থ সুবিধা ও রেয়াত প্রদানের প্রশ্নে সুরাহা করতে হবে। আশা করা যায়, প্রস্তাবিত বিশেষজ্ঞ কমিটি বর্ণিত বিষয়গুলোর নানা দিক বিশ্নেষণ করে একটি বস্তুনিষ্ঠ নীতিমালা সুপারিশ করবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ; বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
(সূত্র: সমকাল)