শিক্ষক: সংকটে নেতৃত্বদাতা, ভবিষ্যতের রূপদর্শী
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে একটি। সামাজিক ও মানবিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষা একটি জরুরি বিষয়। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়, স্বনির্ভরতা অর্জনে সুখী ও সুন্দর জীবনে ব্রতী হয়। দেশের জন্মহার হ্রাস পায়, স্বাস্থ্য ও মানবাধিকার সূচকের উন্নয়ন ঘটে, গড় আয়ু বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে। সর্বোপরি সমাজ, দেশ তথা পৃথিবীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই। আধুনিক পরিবর্তশীল বিশ্বে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষা অত্যন্ত জরুরি। ইন্টারনেট ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সারা বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রক্ষা সর্বোপরি বৃহত্তর ও সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণে শিক্ষা কার্যকরি। মানব সভ্যতার সূচনা লঘ্ন থেকেই মানুষ গড়ার এই গুরুত্বপূর্ণ কর্মটি শিক্ষাগুরু দ্বারা পরিচালিত হত। কালের বিবর্তনে আধুনিক সভ্যতায় শিক্ষাকার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিক রুপ লাভ করে। সমাজের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পেশার মধ্যে শিক্ষকতা পেশাটি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। এতদসত্তে¡ও কতিপয় উন্নয়নশীল দেশ সমূহে শিক্ষকের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ভুলণ্ঠিত হচ্ছে।
গত ২০১৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২০৩০ সালকে সামনে রেখে লক্ষ্য ২০৩০: শিক্ষার নতুন রূপকল্প গৃহীত হয়। এজেন্ডা ৪-সি অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ, বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে শিক্ষক প্রশিক্ষণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী শিক্ষার লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষদের যে সমস্ত অর্জন রয়েছে তা জানানো এবং যে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সে সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করা হয়। এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো: “Teachers: Leading in crisis, reimagining the future” প্রতিপাদ্যের ভাষান্তর করা হয়েছে- “শিক্ষক: সংকটে নেতৃত্বদাতা, ভবিষ্যতের রূপদর্শী”।
কোভিড-১৯ মহামারি সংকট একটি অভূতপূর্ব ঘটনা,যা ইতোমধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে এর ফলে শিক্ষকরা কীভাবে পাঠদান করবেন সে বিষয়ে পুনর্বিবেচনার ফলে নতুন নতুন উপায় বের হয়েছে। শিক্ষকতার পেশা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে এবং এসডিজি ৪ ও শিক্ষা ২০৩০ লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের নেতৃত্বের বিষয়টি কিছুটা অবহেলিত হয়েছে। সংকট প্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত শিক্ষক নেতৃত্বের বিষয়টি কেবল সময়োচিত নয় বরং বর্তমান সংকটকালীন দূরবর্তী শিক্ষা, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করা, পুনরায় বিদ্যালয় খোলা এবং পাঠ্যক্রমে শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণের জন্য শিক্ষকদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। শিক্ষাক্ষেত্রে স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করা এবং শিক্ষার ভবিষ্যতের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংকটকালে নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা এবং ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণে শিক্ষকদের রূপদর্শী ভূমিকা বিবেচনায় রেখে এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
মানসম্মত শিক্ষার জন্য মানসম্মত শিক্ষক যেমন প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষকের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও তেমন প্রয়োজন।মানসম্মত শিক্ষক হিসেবে সেইসব ব্যক্তিকেই গ্রহন করা হয় যাদের শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূল্যবোধ ও আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি তৈরি হয়। আর এই মূল্যবোধ ও আত্মবিশ্বাসই গড়ে তোলে দেশপ্রেম, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ইতিবাচক সম্পর্ক, পরিপূর্ণ আস্থা এবং পেশার উচ্চ আদর্শ। বৈশ্বিক পরিবর্তন ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের ফলে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষণ-শিখনেও পরিবর্তন-পরিবর্ধন সাধিত হচ্ছে। এইসব পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও আধুনিক শিক্ষণ-শিখনের সাথে শিক্ষকদের অভিযোজনের বিষয়টিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিগত কয়েক দশক ধরে সবার জন্য শিক্ষা অর্জনে অনেক ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তবে ২০৩০ সালের মাধ্যে মানসম্মত শিক্ষা অর্জনে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছে। এসডিজি-৪ মানসম্মত শিক্ষণ-শিখনের জন্য যোগ্য শিক্ষক নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এসকল প্রেক্ষাপটে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি জাতিকে সুশিক্ষিত করে সঠিক পথপ্রদর্শনের মাধ্যমে প্রত্যাশিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারেন শুধু শিক্ষকরাই। আর এজন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত এবং নিবেদিত শিক্ষক।
শিক্ষকের দক্ষতা ও মর্যাদার পাশাপাশি ক্ষমতার সম্প্রসারণ ও এখন বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কারণ ২১ শতকের প্রথম দিকটা শিক্ষকতা পেশার জন্য খুব সহজতর নয়। এক সময় শিক্ষকতা পেশা উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ও বিশ্বস্ততায় পূর্ণ ছিল। কিন্তু বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে শিক্ষকগণ খুব সহজে তাদের শিখন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন না। এহেন অবস্থা মোকাবেলায় দরকার দক্ষ ও ক্ষমতাধর তরুণ প্রজন্মের শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষকতা পেশায় ক্ষমতা ও মর্যাদা না থাকার কারণে শিক্ষিত তরুণ সমাজ শিক্ষকতা পেশায় আশার আগ্রহ হারাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে সেলিব্রেটিদের জয়গান করতে সমাজের ঝোক এখন বেড়ে গেছে। এক্ষেত্রে চিত্রকর, খেলোয়াড়, অভিনেতা, রাজনীতিবিদ ও কমেডিয়ানদের জয়গান করতে সমাজ এখন মুখরিত। যেহেতু শিক্ষকতা পেশায় সেলিব্র্রেটি হওয়া যায় না সে কারণেও এ পেশা এখন তরুণ সমাজের জন্য আকর্ষনীয় নয়। অন্য দিকের শিক্ষকগণ তাদের শিক্ষার্থী এবং পরিবারের সদস্যদের দ্বারা হুমকির শিকার হচ্ছেন। এছাড়া সমাজের বখাটে কিংবা ক্ষমতাসীন দুশকৃতীকারীদর দ্বারা সন্ত্রাসের স্বীকার হচ্ছেন। এমতাবস্থায় শিক্ষকতার পেশা ক্ষমতার সম্প্রসারণ ছাড়া হুমকির সম্মুখীন। এ উপলব্দি থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ইউনেস্কোর উদ্যোগে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শিক্ষা সম্মেলনের ঘোষণা অনুযায়ী ২০১৯ সালের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল “Young Teachers : The Future of the Profession.”
শিক্ষকতা পেশাটি বাংলাদেশেও তেমন জনপ্রিয় না হওয়ায় অনেক কৃতি শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করে এই পেশায় আসতে চায় না। অথচ মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান ও আলোকিত মানুষ গড়ার লক্ষ্যে পেশাগত দক্ষতা সম্পন্ন বিপুল সংখ্যক শিক্ষক প্রয়োজন। ইউনেস্কো ইন্সিষ্টিটিউট ফর স্টেটিসটিকস্্ অনুসারে মানসম্মত শিক্ষকের স্বল্পতার কারণে অনেক দেশে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা ব্যহত হচ্ছে। বিশ্ব শিক্ষক দিবস শুধুমাত্র শিক্ষকদের ন্যায্য স্বার্থ সংরক্ষণের কথাই বলে না, বরং আগামী প্রজন্মের মানসম্মত শিক্ষার কথা চিন্তা করে শিক্ষকতা পেশাকে আরও আকর্ষণীয় এবং শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের কথাও বলে। শিক্ষকদের মূল্যায়ন ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে সময়োপযোগী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে শিক্ষার মানন্নোয়ন ঘটবে শিক্ষাবিদগণ মনে করেন।
বাংলাদেশে গণসাক্ষরতা অভিযান ২০০৭ সাল থেকে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন এবং সহযোগী সংগঠনসমুহের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন করে আসছে। এ বছরও এসময়ে দিবসটি উদযাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ উপলক্ষে গণসাক্ষরতা অভিযান সমন্বয়ক হিসেবে সারা দেশে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি ও অন্যান্য পেশাজীবী সংস্থার সাথে সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে আলোচনা সভা, মতবিনিময় সভা, সংবাদপত্রে গণআহবান প্রকাশ, র্যালী, মানববন্ধন ও উপকরণ তৈরি ইত্যাদি কর্মসূচি আয়োজন করছে। কিন্তু জাতীয় ভাবে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন না হওয়ায় এ দিবসের তাৎপর্য মিডিয়াগুলোতে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হচ্ছে না।
শিক্ষকতা পেশা আর দশটা পেশার চেয়ে আলাদা। শিক্ষকরা সকল প্রকার প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে শ্রেণীকক্ষে পাঠ পরিচলনা করবেন। শিক্ষকের মর্যাদা ছাত্রদের মধ্যে হবে সঞ্চারিত। এই লক্ষ্যে ইউনেস্কোর উদ্যোগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত শিক্ষকের মর্যাদা সংক্রান্ত আন্তঃসরকার সম্মেলনে ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর একটি সুপারিশমালা গৃহীত হয়।
শিক্ষকের মর্যাদা সংক্রান্ত বিশেষ আন্তঃসরকার সম্মেলনে ১৩টি পরিচ্ছেদে মোট ১৪৬টি সুপারিশ রয়েছে। এসব সুপারিশে শিক্ষকের মর্যাদার সামগ্রিক দিক পরিষ্ফুট হয়েছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশে এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এর অনেকটাই এখনো অধরা রয়ে গেছে। শিক্ষকদের মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে এসব সুপারিশের বাস্তবায়ন খূবই জরুরি।
নিম্নে ইউনেসকো প্রদত্ত কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে সুশীল সমাজ ও সরকারি নীতি নির্ধারকগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য উল্লেখ করা হল-
*১. শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষকের মর্যাদা ও শিক্ষকদের পেশার প্রতি শ্রদ্বার স্বীকৃতি থাকতে হবে।
*২. শিক্ষকদের প্রস্তুতি ও চাকরির যাবতীয় বিষয় সকল প্রকার বৈষম্যমুক্ত হবে।
*৩. শিক্ষকগণ কর্মসম্পাদনের সহায়ক পরিবেশে পেশাগত দায়িত্ব পালন করবেন।
*৪. শিক্ষক সংগঠনগুলোকে শিক্ষার প্রসারে অবদান রাখতে সক্ষম একটি শক্তি হিসেবে স্বীকৃত দিতে হবে এবং এ কারণে ঐসব সংগঠন শিক্ষানীতি নির্ধারণের সঙ্গে যুক্ত হবে।
*৫. শিক্ষা পরিকল্পনার প্রতিটি স্তরে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
*৬. শিক্ষকদের প্রস্তুতি কোর্স হবে পূর্ণকালীন, তবে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য খন্ডকালীন বা আংশিক
কোর্সের ব্যবস্থা করা যেতে পারে যা সমাপনান্তে পূর্ণকালীন কোর্সের সমমানসম্পন্ন হবে।
*৭. প্রশিক্ষণ কোর্সকে শিক্ষকদের পদোন্নতি লাভের সুযোগ হিসাবে নির্ধারণ করে শিক্ষা পদ্ধতিকে যুগোযযোগী
করতে হবে।
৮. স্কুলে পদ্ধতি ব্যবহার করার জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
৯. দলগত বা এককভাবে দেশ ও দেশের বাইরে ভ্রমণের সুযোগ তৈরি করতে হবে।
১০. চাকুরীকালীন শিক্ষকদের প্রস্তুতিতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর্থিক ও কারিগরি সুবিধার ব্যবস্থা
থাকা উচিত।
*১১. প্রয়োজনীয় যোগ্যতা সাপেক্ষে চাকুরিকালীন শিক্ষককে সমপর্যায়ের অন্য স্কুলে যাওয়ার অধিকার দিতে
হবে।
*১২. পরিদর্শক, শিক্ষাব্যবস্থাপক বা পরিচালকের পদ যথাসম্ভব অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দ্বারা পূরণ করতে হবে।
১৩. শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে পরামর্শ করে পেশাগত মাপকাঠির আলোকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে পদোন্নতির ব্যবস্থা
থাকবে।
১৪. চাকুরির স্থিতিশীলতার জন্য চাকুরীকালীন নিরাপত্তা বিধান থাকতে হবে।
১৫. শিক্ষকদের চাকুরিকালীন নিরাপত্তা বিঘ্ন করে এমন যে কোনো স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপ থেকে শিক্ষকদের দূরে রাখতে
হবে।
১৬. নিজ এলাকায় নিয়োগও স্বামী-স্ত্রী দু’জনই শিক্ষক হলে তাদের কাছাকাছি নিয়োগ দেওয়ার উপর গুরুত্ব দিতে
হবে।
১৭. অবসর গ্রহণের পূর্বে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন এমন নারী শিক্ষককে পুনরায় এই পেশায় ফিরে আসতে দিতে
হবে।
১৮. শিক্ষক সংগঠনের সহায়তায় নিয়োগসংক্রান্ত নীতিতে শিক্ষকদের অধিকারের প্রতিফলন থাকবে।
১৯. শাস্তির বিষয় প্রয়োগের সময় শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।
২০. পূর্ণকালীন চাকুরি করতে সমর্থ নন এমন যোগ্য শিক্ষক খন্ডকালীন চাকরি করবে।
২১. সামাজিক ও সার্বজনীন কাজে অংশগ্রহণ, নাগরিক অধিকার চর্চা ও যোগ্য পদে নির্বাচন করার সুযোগ
দেওয়া।
২২. শর্তাবলির প্রশ্নে সৃষ্ট বিরোধ-প্রতিনিধিত্বমূলকভাবে নিষ্পত্তি বা আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ।
*২৩. সকল শিক্ষক পূর্ণ বেতনসহ বার্ষিক অবকাশের অধিকার ভোগ করবেন।
*২৪. সবেতনে অসুস্থতাজনিত ছুটি এবং পূর্ণ/আংশিক বেতনে দীর্ঘদিন ছুটি ভোগ করবেন।
২৫. পেশাগত ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের আওতায় বিদেশ ভ্রমণের গুরুত্ব স্বীকার এবং বিদেশের জ্ঞানকে
অর্জিত অভিজ্ঞতা হিসাবে গণ্য করা।
২৬. শিক্ষকদের পেশাগত কাজে নিবিষ্ট থাকার স্বার্থে শিক্ষাদান বহির্ভূত কাজে সহায়ক কর্মী নিয়োগ করতে হবে।
২৭. কর্তৃপক্ষ শিখন সহায়ক উপকরণ সরবরাহ করবেন, তবে তা শিক্ষকের বিকল্প বলে বিবেচিত হবে না।
*২৯. পূর্ণ ও আংশিক বেতনে শিক্ষা ছুটির অধিকার এবং নারী শিক্ষকগণ প্রয়োজনে অতিরিক্ত ছুটি ভোগ
করবেন।
*৩০. প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মরত শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত শিক্ষা ছুটির ব্যবস্থা করা।
৩১. নিজেদের সংগঠনের কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের জন্য সবেতন ছুটি প্রদান করা।
*৩২. শিক্ষক সংগঠনের পদবী অনুযায়ী সংগঠনের অফিসে কাজের অধিকার দেওয়া।
*৩৩. প্রত্যন্ত অঞ্চলেল শিক্ষকদের নিখরচা/ভর্তুকিভিত্তিক আবাসস্থলের ব্যবস্থা করা।
*৩৪. নিয়োগ/বদলিতে পরিবারের সদস্যদের স্থানান্তর ও ভ্রমণ খরচ প্রদান।
*৩৫. যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে বেতন স্কেল এমনভাবে নির্ধারিত হবে যেন শিক্ষকদের কোনো অংশের মধ্যে বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ সৃষ্টি না হয়।
৩৬. একটি সাধারণ প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষকদের সামাজিক নিরাপত্তা সুরক্ষা করতে হবে।
৩৭. তহবিল গঠনসহ প্রকল্প পরিকল্পনায় শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধিত্বের সংশ্লিষ্টতাকে বিবেচনায় রাখতে হবে।
৩৮. নিয়মিত কর্মঘন্টার বাইরে সময়ের জন্য শিক্ষক অতিরিক্ত পারিশ্রমিক পাবেন।
৩৯. যোগ্যতার স্তর অভিজ্ঞতা ও দায়িত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রেড নির্ধারিত হলেও এক গ্রেড থেকে অন্য গ্রেডের
পার্থক্য হবে স্বাভাবিক ও যৌক্তিক।
৪০. ধরণ নির্বিশেষে সকল শিক্ষক সমরূপ সামাজিক নিরাপত্তা পাবেন।
৪১. আইএলও কনভেনশন ১৯৫২-এর শর্ত অনুযায়ী শিক্ষকগণ চিকিৎসা সেবা, অসুস্থতাজিনত ভাতা, বেকারত্ব
ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, কর্মাবস্থায় আঘাতজনিত ভাতা, পারিবারিক ভাতা, মাতৃত্বজনিত ভাতা, অক্ষমতাজনিত
ভাতা এবং জীবিত নির্ভরশীলদের জন্য ভাতা পাবেন।
৪২. শিক্ষকদের সামাজিক নিরাপত্তা সুরক্ষার বিষয়টি তাদের নিয়োগের বিশেষ শর্তাবলী অনুযায়ী বিবেচিত হতে
হবে।
৪৩. কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, উপযুক্ত কর্ম পরিবেশ সৃষ্টিই শিক্ষকতা পেশায় পরিপূর্ণ
যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে আকৃষ্ট করা ও ধরে রাখার প্রকৃষ্ট উপায়।
৪৪. এই সুপারিশে উল্লিখিত সুবিধাদির তুলনায় শিক্ষকেরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অধিকতর অনুকূল সুবিধা ভোগ
করলে সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের ইতোমধ্যে প্রাপ্ত মর্যাদা হ্রাসের ব্যবস্থা হিসেবে এসব সৃপারিশের আশ্রয় নেওয়া
যাবে না।
৪৫. উপরোল্লিখিত বিষয়াবলি প্যারিসে অনুষ্ঠিত এবং ১৯৬৬ সালের ৫ই অক্টোবর তারিখে ঘোষিত (এ সুপারিশগুলো শিক্ষকের মর্যাদা সংক্রান্ত বিশেষ অন্তঃসরকার সম্মেলন কর্তৃক যথাযথভাবে গৃহীত সুপারিশের প্রকৃত সংস্করণ।)
আধুনিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত, বিজ্ঞানমনস্ক ও তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ মানুষের দেশ হিসেবে যদি আমরা বাংলাদেশকে দেখতে চাই তবে সেক্ষেত্রে শিক্ষাই হলো প্রধান ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এডুকেশন ওয়াচ-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় সরকারি ব্যয় অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অনেক কম, যা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট নয়। জিডিপি’তে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের দিক দিয়ে বিশ্বের ১৬১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৫তম। এমনকি সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে তুলনামূলকভাবে কম বরাদ্দ দেওয়া হয়। জাতীয় আয়ের মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশ আমরা শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করছি। এছাড়া বাজেটে বিগত অর্থ বছরগুলিতে শিক্ষায় বরাদ্দ কমে যাওয়ার একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যা আমাদের জন্য চিন্তার বিষয়। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল এমনিক আফগানিস্তানও শিক্ষায় আমাদের চেয়ে বেশি ব্যয় করছে। এহেন অবস্থায় আমাদের দেশের শিক্ষকের নিম্ন বেতন বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের মধ্যে বেতন বৈষম্য, কর্মপরিবেশে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব এবং যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষকদের জন্য পদোন্নতির ব্যবস্থ না থাকা ইত্যাদি কারণে মানসম্মত শিক্ষা ব্যহত হচ্ছে।
তাই বিশ্ব শিক্ষক দিবসের আলোকে ১৯৬৬ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্ত:সরকার সম্মেলনে ইউনেস্কো প্রণীত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই কেবল মান সম্মত শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব। অন্যথায় নয়।
লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতি