এই অবস্থা আকাশ থেকে পড়েনি, ক্ষমতাসীনরা তৈরি করেছে

ইনসেটে অধ্যাপক আলী রীয়াজ
ইনসেটে অধ্যাপক আলী রীয়াজ  © প্রতিকী ছবি

গত কয়েকদিনে ধর্ষণের অডিও-ভিডিও-খবর দেখে যদি মনে হয় দেশে এটাই একমাত্র মহামারি তাহলে বুঝতে হবে, আমি/আপনি আছি মুর্খের স্বর্গে। মহামারি তো একটা হচ্ছে না যে, একটার বিরুদ্ধে কথা বলবো/বলবেন। সবগুলো মহামারি যদি না বুঝতে পারেন তবে এই সব প্রতিবাদের ফল কি হবে সেটা আমরা জানি।

গত কয়েকদিনে কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনার পরে আবারও ধর্ষণের ঘটনার বিবিধ রকমের ব্যাখ্যা শোনা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন এর বিরুদ্ধে ‘সামাজিক আন্দোলন করতে হবে’। ‘সামাজিক আন্দোলনের’ এই সব বায়বীয় কথাবার্তার অর্থ একটাই আপনি এর দায়িত্ব যে ক্ষমতাসীনদের, সেটা বলতে চাইছেন না। এটা যে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরাই করছে, আশ্রয়ে প্রশ্রয়েই ঘটছে তা বলতে চাইছেন না।

এ নিয়ে প্রশ্ন করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, ‘সারা বিশ্বের দিকে তাকিয়ে দেখেন? কোন জায়গায় ধর্ষণ নেই? এমন কোনও দেশ নেই ধর্ষণ হয় না!’ তা হলে বলুন, ছাত্রলীগের ছেলেদের দোষ কোথায়? তাঁরা তো আর বিশ্বের বাইরে না। একেই বলে অপরাধের যৌক্তিকতা তৈরি করা; বৈধতা দেয়া কিনা সেটা আপনার বিবেচ্য।

‘ধর্ষণ হচ্ছে পিতৃতন্ত্রের হাতিয়ার’ একথা ততক্ষণ পর্যন্ত বহাল যতক্ষন আপনি একে কেবলমাত্র একমাত্রিকে বিবেচনা করবেন, কনটেক্সটকে বিবেচনায় নেবেন না। বাংলাদেশে এটা বোঝার জন্যে আপনার তত্ত্বগতভাবে বিবেচনা করতে হবে না, দেশের ‘নারী অধিকার’ বলে পরিচিত কর্মীদের এক বিরাট অংশের নিরবতা থেকেই বুঝবেন। তাঁরা পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয় এমন মনে করার কারণ নেই, কিন্ত ক্ষমতার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের কারণেই এখন তাঁদের নিরবতা। আমি যদি আগ বাড়িয়ে বলি, নিরবতা নয়, এ হচ্ছে মৌনতা। ‘মৌনতা সম্মতির লক্ষণ?’

কিন্ত এই যে ধর্ষণের মহামারি সেটা চলছে আরো অনেক মহামারির মধ্যে, করোনভাইরাসের মহামারি তো সারা পৃথিবী জুড়ে, কিন্ত সম্ভবত বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র দেশ যেখানে একটি প্রতিষ্ঠান আলাদা করে উপসর্গে মৃত্যুর হিসেব দিচ্ছে। সংবাদপত্রগুলো সেগুলো ছাপছে, কিন্ত এই নিয়ে বিকার নেই। নিপীড়নের যে মহামারি তার কী হবে? আইনের নামে যে মুখে তালা লেগেছে সেটা কি আজকের ঘটনা?

মুখে তালা দেয়ার এটাই একমাত্র উপায় নয়। আদালত বলছে ফোনে বে-আইনি আড়িপাতা বন্ধ করুন; তার মানে এই অবস্থা চলছে, সরকার না চাইলেও চলছে এমন মনে করার কারণ নেই। একটা বিচার বহির্ভূত হত্যার ঘটনার পরে একটা জেলার সব পুলিশকে বদলি করে দেয়া হয়েছে, কিন্ত বাংলাদেশ তো ৬৪ জেলা তার কি হয়েছে সেই প্রশ্ন তুলতে চান কিনা সেটাই নিজেকেই প্রশ্ন করুন। ওই ঘটনার পরে ‘ক্রসফায়ার বন্ধ হয়েছে’ এই নিয়ে যারা আনন্দিত তারাই আবার আরো অনেক ক্ষেত্রেই বিচারের আগে ‘ফাঁসি’ চান। আইনের শাসন চান না।

চাইলেই বা কী হবে – বিচার বিভাগের অবস্থা তো আমরা জানি। কথা বললে আদালত অবমাননার ঝুঁকি যে কত তা কে না জানে, এমন কি একজন আইনজীবীর ফেসবুক একাউন্ট বন্ধ করে দিতে বলেছে আদালত। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে এরকম নির্দেশ অভূতপূর্ব বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত কারও ফেসবুক একাউন্ট আদালত ব্লক করে দিতে বলেছে, এমন নজির নেই।’ (বিবিসি বাংলা, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০)।

প্রযুক্তিগত বিবেচনায় বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ সেটা পারবেন কিনা সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। আদালতের রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়? আদালতের রায়ে যখন আইন নয় নৈতিকতার প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে, তখন প্রশ্ন ওঠে আইনের কাজ কী? আদালত বলেছে, ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে, অন্য নারীরা বিপথগামী হবেন।’

আদালতের আরেক রায়ের খবর পড়বার পরে কিছুই বলবার মতো ভাষা খুঁজতে হয়েছে। একটি রিট মামলার রায়ে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের হাই কোর্ট বেঞ্চ যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে তা এই রকম - ‘মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে বিচার বিভাগ। যখন এই শেষ আশ্রয়স্থলের বিচারকরা দুর্নীতির মাধ্যমে রায় বিক্রি করেন, তখন সাধারণ মানুষের আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। ... ‘তারা হতাশ হন, ক্ষুব্ধ হন, ক্রুদ্ধ হন, বিক্ষুব্ধ হন এবং বিকল্প খুঁজতে থাকেন। তখনি জনগণ মাস্তান, সন্ত্রাসী এবং বিভিন্ন মাফিয়া নেতাদের আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং তাদের বিচার সেখানে চান।’ (বিডিনিউজ২৪, ৩ অক্টোবর ২০২০)।

এখন বলতে পারেন ধর্ষণের সঙ্গে এইসবের সম্পর্ক কি, আমি কেন ধান ভানতে শীবের গীত গাইছি। কেননা এগুলো হচ্ছে দেশের আইনের শাসনের অবস্থা। এই অবস্থা আকাশ থেকে পড়েনি, এটা তৈরি করা হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা তৈরি করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো চূর্ণ করে দেয়া হয়েছে, যার পরিণতি হচ্ছে দেশে ধর্ষণের হোতারা বুক চিতিয়ে চলতে পারেন, লুটেরার বুক চিতিয়ে চলতে পারেন, আপনার অধিকার যারা লুট করেছে তাঁরা ক্ষমতার দম্ভ দেখাতে পারেন।

বাকি সব চলবে আর ‘সামজিক আন্দোলনের’ মাধ্যমে ধর্ষণের মোকাবেলা করবেন এটা বলতেই পারেন, কিন্ত আপনিও জানেন এগুলো কথার কথা। পরিবার নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া হয় না বলে পিতা-মাতাকে অভিযুক্ত করবেন, কিন্ত যাদের কারণে এই অবস্থার তৈরি তাঁদেরকে কিছুই বলবেন না, যে জবাবদিহির অভাবে এই অবস্থার তৈরি সেই বিষয়ে বলবেন না- তাতে আত্মতৃপ্তি আছে। কিন্ত দায়িত্ব পালনের কোনও ইঙ্গিত নেই।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর

(ফেসবুক থেকে নেওয়া)


সর্বশেষ সংবাদ