এমসি কলেজে ধর্ষণ: এ দায় আমারও!
বাসার (খরাদিপাড়া) কাছেই এমসি কলেজ মাঠ। ছাত্রজীবনে প্রায়ই বিকেল হলে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলেছি। বিশাল খোলা মাঠ। কত দল, কত টিম একসঙ্গে এক মাঠে খেলছে! যেন এক মাঠের মধ্যে অনেক মাঠ। অধুনা সীমানা প্রাচীর হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন গেইটও হয়েছে। আমিও বিয়ে করেছি। ছেলেমেয়ে হয়েছে। ওরাও বড় হচ্ছে। আমার ছোটো ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে এখনও প্রায় ওই মাঠে যাই। একটি বল নিয়ে ওরা দৌড়াও। আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখি, কখনও নিজেও ওদের সঙ্গে দৌড়াই। এই তো দুইদিন আগে ছেলেমেয়ের বায়না শোধাতে মাঠে নিয়ে গিয়েছিলাম। পরন্ত বিকেল। দিনশেষের হলদে আলো পড়েছে মাঠে। মাঠজুড়ে দলে দলে খেলছে কত তরুণ ও কিশোর। খালি জায়গা নেই। গেইটের পাশের অল্প খালি যায়গায় ওরা দৌড়াদৌড়ি করল কিছু সময়। সন্ধ্যা হতেই সবাই ফিরে যাচ্ছে। আমরাও গেইটের সামনে আসলে দেখি প্রতিদিনের মতো কিছু পুলিশ অটোরিক্সা চেক করছে। কোন কোন অটোকে কিছুক্ষণ আটকেও রাখছে। অনেক দিন থেকে এখানে নিয়মিত পুলিশের উপস্থিতি দেখে আসছি।
কয়েকফুট সামনেই বালুচর পয়েন্ট। জন্ম থেকে দেখে আসছি এই পয়েন্ট কখনও জনশূন্য হয় না। এমনকি করোনাকালেও হয়নি। এমসি কলেজ মাঠের গেইটের ঠিক উল্টো গেইটটি হলো কলেজ ছাত্রাবাস গেইট। ১৯২০ সালে ব্রিটিশ আমলে আসাম ঘরানার স্থাপত্যরীতির এই ছাত্রাবাস ও আশপাশের পরিবেশ বেশ মনোরম। পূর্বে অনেক খোলামেলা থাকলেও এখন বেশ সুরক্ষিত। করোনা সময় থেকে মূল ফটক তালা দেয়া দেখে আসছি। তাই আর হাঁটার জন্যও কখনও ওইমুখী হইনি। তবে রাস্তা থেকেই দেখা যায় শুনশান নীরব একসময়ের মুখরিত ক্যাম্পাস। নিজে যদিও থাকিনি কিন্তু বন্ধুদের কল্যাণে কতদিন রাত, কত স্মৃতির সাক্ষী হয়ে আছে ওই ছাত্রাবাস। সেই সোনালি দিনের স্মৃতিচিহ্নিত ছাত্রাবাসে সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তাই চোখে পড়ে, ভালোলাগা বোধ জেগে ওঠে।
আজ আমাদের ওই প্রিয় প্রতিষ্ঠান কলঙ্কিত। লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। এমন তো হবার কথা ছিলো না!
বিভিন্ন মাধ্যমের খবরে জানা যায়, শুক্রবার রাতে এক তরুণী স্বামীর সঙ্গে নিজেদের গাড়িতে করে বিকেলে এমসি কলেজ এলাকায় বেড়াতে যান। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন তার স্বামী। সন্ধ্যার পর কলেজের প্রধান ফটকের সামনে গাড়িটি রেখে একটি দোকান থেকে তারা কেনাকাটা করেন। পরে ফিরে গাড়িতে বসে গল্প করছিলেন তারা। রাত ৮টার দিকে পাঁচজন যুবক তাদের গাড়িটি ঘিরে ধরে স্বামী ও স্ত্রীকে জোর করে গাড়ি থেকে নামান। তিনজন যুবক তরুণীকে টেনে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে নিয়ে যান। স্বামীকে তখন গাড়িতে আটকে রেখেছিলেন দুজন যুবক। ঘণ্টাখানেক পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হলে তিনি এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষের সামনে গিয়ে স্ত্রীকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখতে পান। বিভিন্ন খবরে আরও জানা যাচ্ছে যে, এর সঙ্গে কলেজের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্ররাও জড়িত এরা ছাত্রলীগের কর্মীও। এখন কথা হলো ছাত্রলীগ কর্মীরা করোনার এই ছুটির সময় ছাত্রাবাসে থাকে কি করে? এদের আনাগোনা কি কর্তৃপক্ষের চোখে পড়ে না! না কোনও যোগসূত্র। সেও ভাবার বিষয়।
ছাত্রাবাস এলাকায় কোনও ঘটনায় লোকারণ্য আশপাশের অনেকেরই দেখার কথা। যে সময়ের ঘটনা ওইসময় ওই এলাকা জনশূন্য থাকার কথা না। মূল কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রাবাস অনেক পথ। মদিনা ঈদগাহের সামনে তো সবসময় পুলিশও থাকে। তারপরও কীভাবে সম্ভব হলো বা সাহস পেল এমন ঘটনা ঘটানোর।
না, আমার সবাই চোখ বন্ধ করে আছি। মুখও বন্ধ। না দেখছি, না কিছু বলছি। আর আমাদের চারপাশে একের পর ঘটে যাচ্ছে সভ্যতার নিকৃষ্টতম সব নির্মমতা। আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের আগামী চলে যাচ্ছে অতল গ্বহরে। আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি!
এখনই যদি সামাজিক প্রতিরোধের দেয়াল তৈরী করা না যায়, সামনেই বিপদ। ওই মাঠ, ওই কলেজ, সুন্দর বিকেল, শিশুর দৌড়াদৌড়ি, পায়ে হাটার রাস্তা সব চলে যাবে নষ্টদের দখলে। আমি এর দায় কোনওভাবেই এড়িয়ে যেতে পারি না।।
লেখক : শিক্ষক, কবি