হাইব্রিড লার্নিং মডেল

সংকটকালীন সময়ে উচ্চশিক্ষায় একটি কার্যকর বিকল্প!

লেখক ও মডেল
লেখক ও মডেল  © টিডিসি ফটো

করোনাভাইরাস নামক এক অতিক্ষুদ্র অস্তিত্ব পুরো বিশ্বকে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। সাত মাস পরে স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি স্থবিরতা থেকে কিছুটা বের হয়ে আসলেও শিক্ষাখাত কার্যত এখনো স্থবির। বিভিন্ন পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১.৩ বিলিয়ন শিক্ষার্থী স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূরে অবস্থান করছেন। কিছু দেশ ইতোমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিলেও নানা বাস্তবতায় তা মুখ থুবড়ে পড়ছে।

কখন এই সংকট কেটে যাবে, তা বলা এখনো অনিশ্চত। তবে এটাই সত্য একদিন এই সংকট কেটে যাবে। আমাদের বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিও পুনরায় চালু হবে; শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদচারনায় আবার মুখরিত হবে প্রিয় ক্যাম্পাস। যদি সংকটের সময়কাল আরও দীর্ঘায়িত হয় তবে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা জীবনের ভবিষ্যত কী হবে? তাই এমন এক বাস্তবতায় শিক্ষাব্যবস্থার একাডেমিক ক্যালেন্ডার বাস্তবায়নে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবা উচিত বলে আমি মনে করি।

ইতোমধ্যে এই মহামারী পরিস্থিতিতেও জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর এমনকি বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অনলাইনে সিমেস্টার সম্পন্ন করেছে। বিশেষ করে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ভূমিকা এই ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য।

বর্তমানে কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও অনলাইনে পাঠদান শুরু করেছে- যা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। এই প্রচেষ্টাকে কিভাবে আরও বেশি কার্যকর বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায় সেটা নিয়েই এখন আমাদের ভাবতে হবে। হাইব্রিড টিচিং এবং লার্নিং মডেল -এখানে উত্তম বিকল্প হতে পারে বলে আমার মনে হয়। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণা ও পরিসংখ্যানে এটাও উঠে এসেছে, উচ্চ শিক্ষায় অনলাইন শিক্ষাগ্রহণ-পাঠদান-কার্য সম্পাদন আগামীতে নিয়মিত বিষয় হিসেবে অর্ন্তভূক্ত থাকবে।

যেহেতু হাইব্রিড লার্নিং মডেল-এ শ্রেণিকক্ষে লাইভ অংশগ্রহণের পাশাপাশি দুরপ্রান্তে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরাও ক্লাস এবং ক্লাসের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিতে পারে তাই চলমান সংকটে এই মডেলকে বেছে নেয়া যেতে পারে। এই মডেল মুলত মুখোমুখি ক্লাসরুম এবং অনলাইন ক্লাশ দুটির সমন্বয় নির্দেশ করে। এটি এমন একটি শিক্ষামূলক মডেল যেখানে কিছু শিক্ষার্থী, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশে পাশে অবস্থান করে, তারা সরাসরি ক্লাসে যোগ দিবেন; আর যেসব শিক্ষার্থী দূরবর্তী জায়গায় অবস্থান করেন তার অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে ক্লাশে যোগ দিবেন। ফলশ্রুতিতে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে ক্লাশে অংশগ্রহণ এবং কার্যক্রমগুলো সম্পাদন করা যাবে।  

এই হাইব্রিড লার্নিং মডেলের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের ইন্টারেক্টিভ লার্নিং এবং প্রশিক্ষণ কৌশলকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়। এর মাধ্যমে গতানুগতিক শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ, পরীক্ষামূলক শিক্ষা এবং পাঠ্যক্রমের ইন্টারেক্টিভ অবস্থানকে একত্রিত করা যায়। আরেকটি সুবিধা হল, বর্তমান পরিবেশে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্ব গতিতে কাজ করতে পারবে।  তবে এটা ঠিক যে, হাইব্রিড লার্নিং মডেল-এ একটি প্রচলিত প্রোগ্রামের চেয়ে স্পষ্টতই বেশি পরিকল্পনা ও শ্রমের প্রয়োজন হয়। একটি সফল মডেলিং কোর্সের পদ্ধতির জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ, সিঙ্ক্রোনাস এবং অ্যাসিনক্রোনাস উপাদান ঠিক করা, সময়সূচি তৈরি করা এবং সেমিস্টার বা ক্লাস শুরুর আগেই অনলাইন ম্যাটিরিয়ালস প্রস্তুত রাখতে হয়।

এই মডেল অনুসরণে ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও উপকৃত হয়। এই পদ্ধতি অনুসরণের মা্ধ্যমে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ, অনুশীলন নিশ্চিত করা যায় যা তাদের কার্যক্রমের মূল্যায়নকে অর্থবহ করে তোলে। এছাড়া শিক্ষার্থীরা সহজে কোর্স সামগ্রী, কোর্সের সামগ্রীতে অ্যাক্সেস অর্জন, অনলাইন প্র্যাকটিস, রেকর্ডকৃত অডিও-ভিডিও অনুশীলন এবং পিয়ার আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। একইভাবে, শ্রেণিকক্ষের কাজ প্রতিদিন আদায়, অনলাইন অভিজ্ঞতা অর্জন এবং দক্ষতার মাধ্যমে "শেখার বিষয়গুলি" পুনঃব্যবহার করে সমস্যা সমাধান, কার্য সম্পাদন করা যায়- এই মডেলে।

এতোসব সুবিধার মধ্যেও এই মডেলের যে চ্যালেঞ্জটা মাথায় রাখতে হবে তা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাতে অনলাইন শিক্ষা নিয়ে কোন ধরেনর বিরক্তি তৈরি না হয়। এছাড়া বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে প্রযুক্তি সহজলভ্য হলেও পুরোপুরি বিকশিত হয়নি সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি জ্ঞান নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায়, হাইব্রিড লার্নিং মডেল-এর কার্যকারিতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। এছাড়া প্রযুক্তির সাথে এডাপট্যাবিলিটি তৈরি করা এবং শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট অ্যাক্সেস নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

আমি মনে করি, উন্নত দেশের মতো স্বীকৃত অনলাইন পদ্ধতিতে বাংলাদেশেও অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম, ফ্লেক্সিবল মোডে কোর্স অফার, পরীক্ষার মূল্যায়ন ও গ্রেড রিপোর্ট জমা প্রদানসহ অন্য সব কার্যক্রম পরিচালনা করা অতি জরুরি। তাই হাইব্রিড লার্নিং মডেল-এর সার্বিক বিষয় বিবেচনায় এনে এই মডেলকে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মহামারীতে বা সংকটকালীন সময়ে নতুন নতুন সমস্যার যেমন উদ্ভব হবে, তেমনি এই সমস্যগুলো কাটিয়ে উঠার বিকল্প পন্থাও বের করে নিতে হবে।

তাই বর্তমান চলমান সংকটে হাইব্রিড লার্নিং মডেল একটি সফল বিকল্প উদ্যোগ হতে পারে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করলে শিক্ষাব্যবস্থার চলমান সংকটের অনেকাংশে সমাধান সম্ভব। এজন্য আমাদের সবাইকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে এবং অনলাইন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন দিগন্তে উন্মোচন করতে হবে।

লেখক: সিনিয়র লেকচারার, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি


সর্বশেষ সংবাদ