‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’ এবং আইনের চোখ
মেয়েদের উচিত মামলা-মোকাদ্দমার ক্ষেত্রে এই টার্ম থেকে অন্তত বের হয়ে আসা। আমার ধারণা, এই টার্মটা বাংলাদেশী মেয়েদের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির মুখে ফেলে দিবে। একসময় দেখা যাবে, ‘ধর্ষণ’ শব্দটাই হাস্যরসাত্মক কৌতুকে পরিণত হয়েছে। (অলরেডি কিছুটা হয়েছেও)
এর ফলে প্রকৃত ভিক্টিমরা তাদের নায্য বিচার থেকে বঞ্চিত হবে।
আমি বুঝি না, ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’—এমন স্পষ্ট প্রবঞ্চনামূলক মামলা প্রশাসন কীভাবে আমলে নেয়! আর সাংবাদিকরাই বা কীভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে নাম-ধামসহ সংবাদ প্রচার করে!
এটা ভাবার কোনো দরকার নেই যে, পুরুষ বলে আমি পুরুষদের পক্ষ নিচ্ছি; যুক্তিগতভাবে আমি নারীদের পক্ষ নিয়েই কথা বলছি। কারণ, আমি চাই না ধর্ষণের মতো ভয়াবহ শব্দটা কতিপয় কিছু স্বার্থেন্বেষী নারীর জন্য সমাজের কাছে তুচ্ছ হয়ে উঠুক।
এটা তো স্পষ্ট যে, ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’—এই বাক্যটা আপাদমস্তক মিথ্যা এবং শঠতায় পরিপূর্ণ। প্রলোভন দেখিয়ে আবার ধর্ষণ হয় কীভাবে! পুরো ব্যাপারটাই তো একটা প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে ঘটে থাকে।
বিবাহবহির্ভূত দুটি নারী-পুরুষের সম্পর্ক, তারপর একটি সময়ে মনের গণ্ডি পেড়িয়ে সেটা শরীরে গিয়ে পৌঁছায়। মন থেকে শরীরে যেতে কোনো জুটির লাগতে পারে একঘন্টা, কারো একদিন, কারো একসপ্তাহ, একবছর কিংবা তারচেয়েও বেশি। অনেকক্ষেত্রেই সময়ের এই তারতম্য ডিপেন্ড করে মেয়েটার উপর।
এটা সূর্যের মতো সত্য যে, একটা মেয়ে না চাইলে পৃথিবীর কোনো পুরুষের সাধ্য নেই মিউচুয়ালি তার কাছে ঘেঁষার। এই জন্যই রেপ আর নরমাল রিলেশনের পার্থক্য।
যখন আপনি আইনের সুযোগ নিয়ে নরমাল রিলেশনকে রেপ বলে চালিয়ে দিবেন, তখন রিয়েল রেপটাও পর্যায়ক্রমে নরমালাইজ হয়ে যাবে। এই দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিটা বহন করতে হবে মূলত ভুক্তভোগী নারীদেরকেই।
বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে যে ধর্ষণ হয় না, এটা তো আমরা সবাই বুঝি। যা হয় দুজনের সম্মতিতেই হয়। দুজনেই উপভোগ করে। প্রথমবারের পর বহুবার হয়। তারপর কোনো কারণে সম্পর্কের অবনতি হলে, ব্যস নারী নির্যাতন মামলা ঠুকে দাও।
রেপই যদি হবে তাহলে ঐ যে প্রথমবার হয়েছিল, তখনই তো মামলা করে দেওয়ার কথা ছিল।
বছরখানিক আগের কখা, আমার ভার্সিটির এক সিনিয়র আপু তার দুই ব্যাচ জুনিয়র এক ছেলের বিরুদ্ধে ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’—এই ওয়েতে মামলা করে বসল। ছেলেটা কলকাতার একটি কমিডি শো'তে পারফরমেন্স করে বেশ পরিচিতি পেয়েছিল। নিজ প্রতিভাগুণে সেলিব্রেটিতে পরিণত হয়েছিল অল্পদিনেই। নাম বললে অনেকেই চিনে ফেলবেন।
যাইহোক, ছেলেটির সেলিব্রেটি ইমেজ আর ফেস ভ্যালুর কারণে জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও সিনিয়র মেয়েটি তাকে সুযোগ দিয়েছে। চুটিয়ে প্রেম করেছে। পাবলিক ফিগার বফকে নিয়ে বান্ধবীমহলে গর্ব করেছে। তারপর যখন স্বার্থে আঘাত লেগেছে তখন ধর্ষণের মামলা দিয়ে বেচারাকে নাস্তানাবুদ করেছে।
হলগেটে ওই ভাইয়ের সাথে একদিন আমার দেখা হয়ে গেল, কুশলাদি বিনিময়ের পর মামলার ব্যাপারে জানতে চাইলাম। বললেন, উক্ত মেয়েকে বিয়ে করে এই ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি পেয়েছেন তিনি। ভার্সিটির সিনিয়র বোন এখন সিনিয়র বউতে রুপান্তরিত হয়েছে। এই যে জবরদস্তিমমূলক সংসার কায়েম করা—এটা কি আদৌ সংসার থাকে?
মেয়েদের পক্ষ থেকে নানান অজুহাতে সম্পর্ক ভাঙার নজির কী আমাদের সমাজে কম? একটি ছেলের সাথে দৈহিক সম্পর্কের সব স্টেজ পার করার পর একটি মেয়ে যখন নিজ থেকে সম্পর্কের ইতি ঘটিয়ে অন্য ছেলের সয্যাসঙ্গিনী হয়—স্বামীর সাথে হোক বা নতুন প্রেমিকের সাথে। তখন এই প্রতারিত ছেলেটি যদি সাবেক প্রেমিকার বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের মামলা দায়ের করে, তখন আপনি দাঁত কেলিয়ে হাসবেন কিনা? অবশ্যই হাসবেন। আমিও হাসব। কারণ, এটা হাস্যকর।
‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’—এই টার্মটি ছেলেটির ক্ষেত্রে যেমন হাস্যকর শোনায়, তেমনি আমার নিকট হাস্যকর শোনায় মেয়েটির ক্ষেত্রেও।
এটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই যে, ধর্ষণ শুধু ছেলেরাই করতে পারে; মেয়েরা না। বৈদেশিক গবেষণায় প্রমাণিত, ছেলেরাও মেয়ে কর্তৃক ধর্ষিত হয়।
কবি আখতারুজ্জামান আজাদের একটি বিরহপূর্ণ বিচ্ছেদকাতর পঙক্তি আছে,
‘‘নষ্ট হব, নষ্ট রবো; নষ্ট দেহের কোমায়—
যাবজ্জীবন ভালো থাকার দণ্ড দিলাম তোমায়।’’
‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’—এই ধারায় মামলাকারী ললনাগণ বিচ্ছেদ পরবর্তী সময়ে পঙক্তিটাকে একটু মোডিফাই করে আওড়াতে পারেন,
‘‘নষ্ট হব, নষ্ট রবো; নষ্ট দেহের কোমায়—
যাবজ্জীবন ধর্ষণের মামলা দিলাম তোমায়।’’
সর্বশেষ কথা হলো, আমাদের এই মিথ্যা-মামলা সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আইন প্রণয়নকারী সংস্থার উচিত, হয়রানি করার এসব ফাঁকফোকর বন্ধ করে দেওয়া।
বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার পিছনে অহেতুক মামলা-মোকাদ্দমার দায়ভার কম নয়। মিথ্যা মামলার অতল স্তুপে চাপা পড়ে যায় সত্য মামলার হার্দিক হাহাকার।
মেয়েদের বলব, তুমি যখন নিজের হীন স্বার্থ উদ্ধারে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করো, তখন সত্যি সত্যি ধর্ষিতা হওয়া তোমার অন্য কোনো বোনের ফাইলটি নিচে পড়ে যায়। লম্বা সময়ের জন্য পিছিয়ে যায় তার বিচারের কার্যক্রম। এভাবে একদিন হয়তো সে ন্যায়বিচার থেকেই বঞ্চিত হয়ে পড়ে...
লেখক: রহমাতুল্লাহ রাফি, শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।