বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড: চাই জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তি
আব্বু তুমি কাঁদতেছো যে! বাবা ও মেয়ের কথা হচ্ছে মোবাইল ফোনে। হঠাৎ দু'টি গুলির আওয়াজ। তাজা প্রাণটি ঢলে পড়লো মৃত্যুর বুকে। কাউন্সিলর একরামুল বাড়ি ফিরলো লাশ হয়ে। একরামুলকে যে বাড়ি ফিরতেই হতো! একরামুল যে তার মেয়েকে কথা দিয়েছে সে বাড়ি ফিরবে। সত্যি একরাম তার কথা রেখেছে! সে বাড়ি ফিরেছে ঠিকই! বাচ্চা মেয়েরা দেখলো তাদের প্রিয় বাবার নিস্তেজ, নিথর দেহটি পড়ে আছে। বাচ্চা মেয়েদের সেদিনের কাঁন্না সারা দেশের মানুষের বিবেককে নাড়া দিলেও এর বিচার পায় নি একরামের পরিবার। এই ঘটনাটি ২০১৮ সালের।
নিহত একরামুলের স্ত্রী আয়শা বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাদের মামলা নেওয়া হয়নি উল্টো তাদেরকে নানান ধরনের হুমকি দেওয়া হয়েছে। কেস করা হয় নি। আমাদের এখানে র্যাব আসছিল। আপনিও তো মেয়েদের নিয়ে স্কুলে যান একা। যেকোন মুহূর্তে মৃত্যু হতে পারে।
বাহ্ কি চমৎকারভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে একরামুলের স্ত্রী আয়শা ও তার পরিবারকে। অবশ্য আমরা এতে অবাক হচ্ছি না। কারণ বর্তমানে এসব বিষয় বাংলাদেশের প্রতিদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডকে রাষ্ট্র অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা এসব হত্যাকান্ডের ঘটনায় রাষ্ট্রের ভূমিকা দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যায়। সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ যাদেরকে জনগণ পয়সা দেয় নিজেদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য অথচ তারাই জনগণের সামনে হন্তারক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এই লেখাটি যখন লিখতে শুরু করেছি তার কিছুক্ষণ আগে একটা সংবাদে পড়লাম- জয়নুল নামের এক স্কুল ছাত্রকে আসামী জয়নাল মনে করে হত্যা করেছে পুলিশ। পুলিশ এই হত্যাকে বন্দুক যুদ্ধের নামে জায়েজ করার চেষ্টা করে।
অর্থাৎ পুলিশের সকল বেআইনি হত্যাকান্ডের জায়েজিকরণ প্রক্রিয়ার নাম হচ্ছে বন্দুক যুদ্ধ। আসামী জয়নালকেও কেন হত্যা করা হবে? সে অপরাধী হলে প্রচলিত আইন অনুসারে তার বিচার হওয়াটাই ন্যায্য। তবে পুলিশের বন্দুক যুদ্ধের ফাঁদে আসামী জয়নালের পরিবর্তে আরো একজন নিরীহ স্কুল ছাত্র প্রাণ হারালো। মৃত্যু হলো একটা সম্ভাবনাময় স্বপ্নের।
আমরা যদি প্রশ্ন তুলি একজন নিরপরাধ স্কুল ছাত্র হত্যার দায় রাষ্ট্র কি এড়াতে পারবে?
পারবে না, আবার নিশ্চই পারবে! এর দায় রাষ্ট্র এড়িয়ে যাবে নিছক হত্যাকান্ড অথবা পুলিশ বুঝতে না পেরে হত্যা করেছে এমন অযৌক্তিক বুলির মাধ্যমে।
সম্প্রতি মেজর সিনহা হত্যাকান্ড বেশ আলোচিত ঘটনা। মেজর সিনহা হত্যার ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির সাথে ওসি প্রদীপের কথোপকথনের কিছু অংশ সোস্যাল মিডিয়ায় বেশ প্রচারিত হচ্ছে। ওসি প্রদীপের সময়ে ১০৬ টি বন্দুকযুদ্ধে ১৭৪ জন নিহত হয়। যার বেশি ভাগই প্রদীপ সাহেব নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সে ২০-৩০ বার নিজে গুলি করেছে। এক্ষেত্রে অনেক সময় সে নিজের ব্যক্তিগত পিস্তল ব্যবহার করেছে। আচ্ছা পুলিশি অপারেশনে ব্যক্তিগত পিস্তল বা অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি আছে কী? এসব নানান প্রশ্ন আমাদের সামনে আসলেও সেসবের উত্তর আশা করা বৃথা।
সংবিধান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ফৌজদারি অপরাধ। কিন্তু আমাদের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সেই অপরাধ নিয়মিতভাবেই করে চলেছে। তাদের আচরণ দেখে মনে হয় এদের জন্য কোনো আইন নেই। এরা সকল আইনের উর্ধ্বে! সত্যি কি ওসি প্রদীপের শাস্তি হবে! কিংবা শুধু ওসি প্রদীপের শাস্তি হলেই কি ঘটনার কাহিনী শেষ? তার সাথে জড়িত রাঘব-বোয়ালরা পর্দার আড়ালেই থাকবে? যারা আরেকজন ওসি প্রদীপকে তৈরি করবে। হাজার হাজার সিনহাকে হত্যা করবে। শুধু ওসি প্রদীপই নয় এরকম হাজার হাজার প্রদীপ ছড়িয়ে আছে সারা দেশজুড়ে। আর যারা এদের মদদ দিচ্ছে তারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতা কাঠামোর সাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। যারা সব সময় আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে পর্দার অন্তরালেই থেকে যায়। যার ফলে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড।
মানবাধিকার সংস্থার তথ্যানুযায়ী ২০০১-২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ২০ বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে ৪০০২ জন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেব মতে, ২০২০ সালের প্রথম সাত মাসেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড হয়েছে ২০৭ টি। (বিবিসি বাংলা)
দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায় মাদক বিরোধী অভিযানের নামে ২০১৯ সালের জানুয়ারি-নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ৩৬২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়। আসক জানায় ২০১৮ সালে ৪৩৭ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়।
এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড যে শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ঘটছে তা নয়, বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলেও এমন খুনচিত্র দেখেছি। অর্থাৎ বিনাবিচারে মানুষ হত্যার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াত জোটের নীতি অভিন্ন!
২০০৫ সালে প্রবীণ বামপন্থী নেতা মোফাখ্খারুল ইসলাম চৌধুরী র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন। এ ঘটনায় র্যাব বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়লেও তা ধামাচাপা পড়ে যায়। বিএনপি শাসনামলে ২০০৫ সালে ৩৭৭ জন এবং ২০০৬ সালে ৩৬২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়।
বিএনপি সরকারের সময় আওয়ামী লীগ বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় এসে তারা ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডকে জিইয়ে রাখে। আর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এই মানুষ হত্যার রাজনীতির কবলে পড়ে প্রাণ দিচ্ছে এদেশে সাধারণ জনগণ।
দেশে আইন আদালত সংবিধান থাকার পরও কেন এদেশের জনগণ বিনা বিচারে প্রাণ হারাচ্ছেন। আর কেনইবা সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডকে জিইয়ে রেখেছে?
এর পিছনের কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে দেখা যায় এদেশে কোনো সরকারই জনগণের স্বার্থের সরকার ছিল না। যখন যারাই ক্ষমতায় এসেছে তারাই নিজেদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত ও গদি দীর্ঘায়িত করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা দিয়ে তাদেরকে নিজেদের অনুকূলে রাখার চেষ্টা করেছে।
আর এই ক্ষমতাবলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগণের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে এবং সর্বদা জনগণের মধ্যে একটা ভয়ের আবহ তৈরি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। বিনাবিচারে হত্যার ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ছে। অর্থাৎ সরকার জনগণের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চূড়ান্ত ভাবে ব্যর্থ।
আমরা যতদিন জনগণের সরকার ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারবো না ততোদিন এ সমস্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও গুম-খুনের রাজত্ব চলতেই থাকবে।
ফলে আমাদের মুক্তভাবে বেঁচে থাকার জন্য, নিজেদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেই ঐক্যবদ্ধ শক্তি চলমান কাঠামোকে ভেঙ্গে সম্ভাবনাময় মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবে। প্রতিষ্ঠা করবে জনগনের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা। মনে রাখতে হবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মাধ্যমেই পরিবর্তন সম্ভব, আমরা সেই পরিবর্তন চাই।
লেখক: সম্পাদক, উত্তরণ সাহিত্যের ছোটকাগজ, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়