আব্রাহাম চুক্তি ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি
- মোঃ হাসান তারেক
- প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৫৯ AM , আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:৫৯ AM
ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের ‘আব্রাহাম অ্যাকডে’ স্বাক্ষরকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ১৫ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বহুল আলোচিত এই চুক্তিতে পৃথক পৃথকভাবে দেশগুলো স্বাক্ষর করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ফিলিস্তিনিগণ।
ইতিমধ্যে, এই চুক্তির প্রতিবাদে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা থেকে রকেট হামলা চালানো হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরের প্রাক্কালে এই রকেট হামলা হয়। যদিও এতে কেউ হতাহত হয়নি। চুক্তিকারীপক্ষ ও মধ্যস্হতাকারীপক্ষ যদিও বলছে আব্যাহাম অ্যাকড মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পথ দেখাবে। কিন্তু, আপাতদৃষ্টিতে তা মনে হচ্ছে না। বরং, এই চুক্তির ফলে লাভবান হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলি নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তিকে তার সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বড় সাফল্য হিসাবে দেখছে। এই সাফল্যের ফল আসন্ন নির্বাচনে কাজে লাগাতে চাইবে ডোনাল্ড ট্রাম্প। অপরদিকে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যিনি দুর্নীতির দায়ে রাজনীতিতে কিছুটা ব্যাকফুটে আছেন, তিনি এই সাফল্যকে তার দুর্নীতি আড়াল করতে কাজে লাগাতে চাইবেন।
এখন আসা যাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের লাভের হিসাবে। সংযুক্ত আরব আমিরাত দীর্ঘদিন যাবত নিজেকে এই অঞ্চলে সামরিক শক্তিতে শক্তিশালী করতে চাইছে। পাশাপাশি, সংযুক্ত আরব আমিরাত এই অঞ্চলের ভৌগোলিক রাজনীতিতে ইরানকে নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে আছে।
একারণে, মনে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমরাস্ত্র দেয়ার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে আব্রাহাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্য রাজি করেছে। এধরণের সমরাস্ত্রের তালিকায় আছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান এবং ইএ-১৮জি গ্রোলার ইলেকট্রনিক যুদ্ধবিমানের নাম। পূর্বে এই অস্ত্রগুলোর স্বপ্ন দেখতো সংযুক্ত আরব আমিরাত। অর্থনীতির পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা সাধনের লক্ষ্যও ইসরায়েলের সঙ্গে সর্ম্পক উন্নয়ন করতে চাইছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের মত ইরানকে নিয়ে ভৌগলিকভাবে অস্বস্তিতে রয়েছে বাহরাইনও। বাহরাইন শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি রাষ্ট্র হলেও এখানকার শাসকগণ হচ্ছেন সুন্নি। একারণে, পাশ্ববর্তী শিয়া রাষ্ট্র ইরানকে নিয়ে বেশ অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চাপে থাকতে হয় বাহরাইনের শাসকগোষ্ঠীকে। আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে তাই বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত চাইছে ইরান, সিরিয়াকে ভৌগোলিকভাবে চাপে ফেলতে।
তবে, সর্বোপরি আব্রাহাম চুক্তির বড় ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করেছে ডোনাল্ড ট্রাম্প। ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পরোক্ষভাবে সৌদি শাসকদের মধ্যস্হতায় বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত আব্রাহাম চুক্তিতে সম্মত হয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক বলছেন।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্য আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। ইরানের অব্যাহতভাবে সামরিক শক্তিবৃদ্ধিসহ ধর্মীয় আর্দশগত পার্থক্য সৌদি আরবের চিন্তার মূল কারণ। একারণে, সৌদি আরব তার মিত্র রাষ্ট্র বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাতকে সঙ্গে নিয়ে আঞ্চলিক রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করতে চাইছে। আব্রাহাম চুক্তির পর সৌদি আরব এখন কোন পথ অনুসরণ করে তা এখন দেখবার বিষয়।
যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলছেন, আব্রাহাম চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সম্পাদন করা হয়েছে। কিন্তু, শান্তির আড়ালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইছেন বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী করতে ও ইরানকে শায়েস্তা করতে।
ফিলিস্তিনি নেতৃবৃন্দ এতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তারা বলছেন, ‘এটা ফিলিস্তিনি জনগণের জাতীয় অধিকার এবং অখণ্ড আরব অবস্থানের জন্য বিশাল ক্ষতি’। আব্রাহাম চুক্তির ফলে সাময়িকভাবে হয়ত ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধ হবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে আগ্রাসন বন্ধ হওয়ার কোন প্রবণতা নাই। অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমনটা প্রতীয়মান হয়। মধ্যপ্রাচ্যে কার্যকরভাবে শান্তি ও শক্তির ভারসাম্য করতে হলে ফিলিস্তিনিদের সাথে নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ভূমিসহ সকল বিরোধ মেটাতে হবে।
নয়তো সাধারণ ফিলিস্তিন জনগণের কান্নার রোল বন্ধ হবে না। এই উদ্দেশ্যে ও.আই.সিসহ জাতিসংঘকে সঙ্গে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নাহলে, বার বার ষড়যন্ত্রের রাজনীতির শিকার হবে ফিলিস্তিনি জনগণ এবং বাধাগ্রস্ত হবে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়া।
লেখকঃ প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা।