বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান বিতর্ক: কিছু প্রাসঙ্গিক কথা
বৈশ্বিক র্যাংকিং-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থার ক্রম অবনমন আবারো বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে এ নিয়ে চলছে বিভিন্ন মহলের আলোচনা-সমালোচনা। অবশ্য এ বিতর্ক ও সমালোচনা নতুন কিছু নয়। গত কয়েক বছর ধরেই তা অবিরতভাবে চলছে এবং সেখানে যুক্ত হচ্ছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ বিতর্ক ও আলোচনা আবার নতুন মাত্রা পেয়েছে গত ২ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে ব্রিটেনভিত্তিক Times Higher Education (THE) এর “বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিং ২০২১” প্রকাশের পর। এ বছর সংগঠনটি বিশ্বের ৯২টি দেশের ১৫০০ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের র্যাংকিং প্রকাশ করে। প্রকাশিত এ তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক অবস্থানের কিছুটা অবনমন হয়েছে এবং এটি স্থান পেয়েছে ১০০০+তম বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, টাইমস হায়ার এডুকেশন ছাড়াও বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংগঠন বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং নিয়ে কাজ করে। এর মধ্যে চীনের সাংহাই জিয়াওটং বিশ্ববিদ্যালয়ের Academic Ranking of World Universities (ARWU), যুক্তরাজ্যের Quacquarelli Symonds World University Rankings (QS), তুরস্কের Middle East Technical University পরিচালিত University Ranking by Academic Performance (URAP), The Guardian Higher Education Network ও UNESCO Ranking and Accountability in Higher education ইত্যাদি। এ ছাড়াও রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন উপস্থিতিভিত্তিক Spanish National Research Council (CSIC) পরিচালিত Webometrics Ranking এবং আমেরিকার US News and World Report র্যাংকিং এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ভিত্তিক The Center for World University Rankings (CWUR) ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠানেরই পরিচালিত গত কয়েক বছরের বৈশ্বিক র্যাংকিংয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান সন্তোষজনক নয়।
টাইমস হায়ার এডুকেশন নামক সংগঠনটির পৃথিবীজুড়ে বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। বিশ্ব র্যাংকিং ছাড়াও এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের র্যাংকিংও করে এ প্রতিষ্ঠানটি। গত জুন মাসে প্রকাশিত এ সংগঠনের র্যাংকিং অনুযায়ী এশিয়া মহাদেশের সেরা চারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম নেই। সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশিত তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৪০১ তম। অতীতের বিবেচনায় এখানেও বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থানের অবনতি হয়েছে।
কীভাবে করা হয় এ র্যাংকিং
র্যাংকিং এর নিয়ামক ও মানদন্ডে প্রতিষ্ঠান ভেদে ভিন্নতা রয়েছে। সাধারণত র্যাংকিং করার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। এগুলো হলো টিচিং বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠদান, গবেষণার সংখ্যা ও সুনাম, সাইটেশন বা গবেষণার উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিক্ষার্থীরা কি রকম উপার্জন করে থাকে ইত্যাদি। শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণা ও এ খাত থেকে আয়, পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক-কর্মকর্তার সংখ্যা, দেশি-বিদেশি শিক্ষকদের অনুপাত, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনুপাত, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাফল্য, দেশি-বিদেশি ছাত্রদের অনুপাত, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী বিনিময়ের হার এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বা সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদিও র্যাংকিং তালিক প্রণয়নে গুরুত্ব পায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক অবস্থান
আগেই বলা হয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব র্যাংকিং প্রণয়নকারী কোনো প্রতিষ্ঠানের তালিকাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান সন্তোষজনক নয়। সর্বশেষ টাইমস হায়ার এডুকেশন এর প্রকাশিত জরিপে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১০০০+ এর তালিকায়। প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত তালিকাতে দেখা যায় যে, টিচিং এ ১০০ এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে মাত্র ১৫.৩ ( গত বছর এ স্কোর ছিল ১৭.০০)। গবেষণায় ১০০ এর মধ্যে স্কোর ৭.৭ (গত বছর ছিল ৮.৮)। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি বা আউটলুকসহ অন্য তিনটি ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কোর সমান্য বাড়লেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক অবস্থানের উন্নতি হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অবস্থানের কারণ কি?
বৈশ্বিক র্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অবস্থানের কারণ সম্পর্কে রয়েছে নানা মুনীর নানা মত। আলোচিত এসব মতের মধ্যে অন্যতম হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে র্যাংকিং প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে তথ্যের অভাব। বলা হয় যে, টাইমস হায়ার এডুকেশনসহ অন্য সব প্রতিষ্ঠানের র্যাংকিং এ স্থান পেতে হলে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য পাঠাতে হয়। কখনো কখনো সেসব সংস্থা থেকেও যোগাযোগ করে তথ্য চাওয়া হয়। উভয় ক্ষেত্রেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রেরণের যে ঘাটতি থাকে এবং আছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিতীয়ত: র্যাংকিং করার ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। অভিযোগ রয়েছে যে, টিএইচইসহ নানা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে র্যাংকিং এর ক্ষেত্রে মান বিবেচনার চেয়ে শিক্ষা বা বা গবেষণার কোয়ান্টেটিভ বা সংখ্যাভিত্তিক তথ্য এবং প্রতিষ্ঠানের বৈশ্বিক সুনাম কে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। এসব বিষয়কে উপক্ষো করার অবকাশ নেই। তবে কেবল এসব যুক্তি দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈশ্বিক র্যাংকিং এ ক্রমশ পিছিয়ে পড়াকে যুক্তিগ্রাহ্য করা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব র্যাংকিং এ ক্রমশ পিছিয়ে পড়ার কারণ নিদের্শ করতে গিয়ে সমালোচকদের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়ী করেন। বলা হয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষকই অযোগ্য। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এখানে মেধাবীরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং তুলনামূলকভাবে কম মেধাবীরা রাজনৈতিক খুঁটির জোড়ে শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন। এসব শিক্ষকগণ পাঠদান ও গবেষণা অপেক্ষা দলীয় রাজনীতিতে বেশি সক্রিয় থাকেন। পদোন্নতি ও পেশাগত সুযোগ-সুবিধা লাভে মেধা, যোগ্যতা ও গবেষণা অপেক্ষা রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রাধান্য থাকায় শিক্ষকগণ পাঠদান ও গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এসব অভিযোগ সর্বাংশে সত্য না হলেও তা যে একেবারেই অমূলক নয় তা বলা বাহুল্য।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় কেবল শিক্ষক নয় শিক্ষার্থীদেরও ভূমিকা থাকে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অল্প-বিস্তর যে রকমই হোক কিছু অবদান অবশ্যই আছে। কিন্তু কাঠামোগত কারণে এখানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তার পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সনদ লাভের জন্য শ্রেণিকক্ষে সিলেবাস নির্ভর শিক্ষা গ্রহণের বাইরে মৌলিক গবেষণায় অবদান রাখার বলতে গেলে কোনো সুযোগই নেই। আর শিক্ষকদের গবেষণার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে অপর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ, গবেষণার অনুক‚ল পরিবেশের অভাব ও অবকাঠামোসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়। বলা বাহুল্য যে, এর প্রতিটি কথাই সত্য। গত কয়েক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটের চিত্র পর্যালোচনা করা হলে গবেষণা ক্ষেত্রে বরাদ্দের চিত্র পাওয়া যাবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, টাকার অংকে প্রতি বছরই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে মজার ব্যাপার হলো গবেষণা খাতে শতকরা হিসেবে বরাদ্দ বৃদ্ধি না হয়ে বরং হ্রাস পাচ্ছে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার জন্য একটি বড় রকমের অন্তরায়। তবে একথাও এখন প্রকাশিত হচ্ছে যে, গবেষণা খাতের এ স্বল্প পরিমাণ টাকাও নাকি প্রতি বছর ব্যয় করা যাচ্ছে না। এটি যদি সত্য হয় তবে স্বল্প বরাদ্দের দোহাই দিয়ে শিক্ষকদের গবেষণা বিমুখতাকে যুক্তিগ্রাহ্য করা যাবে কি?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের গবেষণার মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠছে। পিএইচডি অভিসন্দর্ভ প্রণয়নসহ গবেষণাপত্র রচনা ও প্রকাশের ক্ষেত্রে প্ল্যাজারিজমসহ নানা অনিয়ম এবং অনৈতিকপন্থা অবলম্বনের অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। বৈশ্বিক র্যাংকিং তো পরের কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম, ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই এ বিষয়ে এখনই কার্যকর ব্যাবস্থা নিতে হবে।
‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা না করে আমাদের উচিৎ সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার এবং শিক্ষা ও গবেষণার মান বৃদ্ধিতে বিশেষ যত্নবান হওয়া।’
বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানের ক্রম অধোগতি নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রথমে এসব র্যাংকিংকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয় বলে অভিহিত করে বলেছিলেন যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এমন বাণিজ্যিক র্যাংকিংয়ে বিশ্বাস করে না। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মান আগের থেকে বেড়েছে বলেও তিনি দাবি করেছিলেন। র্যাংকিং প্রক্রিয়ার সাথে হয়ত বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে, তারপরও বর্তমানে এর ক্রম গুরুত্ব বৃদ্ধি এবং এর বহুমাত্রিক প্রয়োগের কারণে একে উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। কারণ এখন বিশ্বের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে কোলাবোরেশনের সময় এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উচ্চতরশিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় এ র্যাংকিং বিবেচনায় নেয়া হয়। এদিক থেকে এখন র্যাংকিং এর গুরুত্ব ও প্রভাব কোনোভাবেই উপেক্ষো করা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মানের অবনমন ঘটেছে। এর পিছনে কি কি কারণ রয়েছে, সে সম্পর্কে মত ভিন্নতা থাকতে পারে। তবে সত্যকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা না করে আমাদের উচিৎ সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার এবং শিক্ষা ও গবেষণার মান বৃদ্ধিতে বিশেষ যত্নবান হওয়া। সম্প্রতি এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান গবেষণা সেক্টর উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচেষ্টার কথা বলেছেন। বৈশ্বিক র্যাংকিং এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান উন্নতির ব্যাপারেও চেষ্টা করা হচ্ছে বলে তিনি গণমাধ্যমের সাথে বলেছেন। অবশ্য রাতারাতি কোন কিছুই পরিবর্তন সম্ভব নয় বলেও তিনি মনে করেন। খুব দ্রুত অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন হবে বলে আমরাও মনে করি না। তবে অবস্থার পরিবর্তনে এখনই আমাদের স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার গুণগত মান বৃদ্ধি এবং র্যাংকিংয়ে এর অবস্থান উন্নতির জন্য কিছু কাজ করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। যেমন:
ক. শিক্ষা ও গবেষণা: শিক্ষা ও গবেষণা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ। এজন্য সকল সংস্থার র্যাংকিংয়েও এর ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে বিশেষ জোর দিতে হবে। এক্ষত্রে যা করা যেতে পারে-
* বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষকদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধকরণ।
* শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা, ভালো রেজাল্টসহ পিএইচডি ডিগ্রি ও উচ্চতর গবেবষণাকে প্রাধ্যান্য দেয়া।
* নবীন শিক্ষকগণ যেন দলীয় রাজনীতি ও প্রশাসনিক কাজে নিযুক্তি লাভ অপেক্ষা শিক্ষা ও গবেষণা কাজে অনুপ্রাণিত হন সে ব্যবস্থা করা। উচ্চতর পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি লাভে দক্ষতা ও গবেষণাকে একমাত্র বিবেচ্য করা হলেই শিক্ষকগণ গবেষণায় আরো বেশি আগ্রহী হবেন।
* শিক্ষকগণ যেন মৌলিক গবেষণা, দেশি-বিদেশি স্বীকৃত ও ইম্পেক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশের ব্যাপারে আগ্রহী হন, সে বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা। এর জন্য সংশ্লিষ্ট গবেষক এমনকি বিভাগকে প্রণোদনা প্রদান করা যেতে পারে।
* পুরস্কার, স্বীকৃতি ও আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে গবেষণা ও এর বাজারজাতকরণ সংস্কৃতি ত্বরান্বিত করতে হবে।
* শিক্ষকগণ যেন সবাই উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা শেষে দেশে ফিরে এসে তাঁদের লব্ধজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান ও গবেষণায় কাজে লাগাতে পারেন, এর অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
* অভিযোগ রয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকই পদোন্নতির শর্ত পূরণের জন্য গবেষণা ও গবেষণাপত্র রচনা করে থাকেন। ফলে পদোন্নতির শেষ ধাপে উন্নীত হওয়ার পর অনেকেই আর এসব কাজ করেন না। এটি অনেকাংশে সত্য। তাই এমন কর্মকৌশল উদ্ভাবন করতে হবে যে, একজন শিক্ষক যেন তাঁর কর্মজীবনের শেষ সময় পর্যন্ত পাঠদানের পাশাপাশি, গবেষণা ও মানসম্মত গবেষণাপত্র রচনা ও তা মানসম্মত জার্নালে প্রকাশে নিয়োজিত থাকেন।
* শুধু শিক্ষক নয়; স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের জন্যও গবেষণার সুযোগ তৈরি করতে হবে। গবেষণা ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থার উন্নতি এবং বিশ্ব র্যাংকিং এ ভালো স্কোর নিশ্চিত করতে হলে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গবেষণা কাজে যুক্ত করতে হবে।
* এমফিল ও পিএইচডি গবেষণার মানোন্নয়ন করতে হবে। বিদ্যমান বিধি পরিবর্তন করে অভিসর্ন্দভ জমা দানের পূর্বেই গবেষকদের স্বীকৃতমানের জার্নালে এক বা একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশের শর্তারোপ করা যেতে পারে।
* বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্যে নির্দিষ্ট বরাদ্দকৃত তহবিলের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি নানা উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার চাহিদা অনুৃযায়ী প্রকল্প প্রস্তাব তৈরিসহ নানা কাজের জন্য স্বতন্ত্র দফতর রয়েছে। তাছাড়াও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আন্তদেশীয় গবেষণা প্রকল্পও বাস্তবায়ণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও এরূপ দপ্তর প্রতিষ্ঠা ও গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে।
* ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান গবেষণা কেন্দ্রসমূহকে অধিক পরিমাণে সক্রিয় ও কর্মচঞ্চল করা।
* বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক গবেষণা জার্নালসমুহকে আন্তজাতিক মানের গবেষণা জার্নালে রূপান্তরিত করার ব্যবস্থা করা।
* শুধু গবেষণা নয়, মানসম্পন্ন পাঠদান, শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিক্ষকদের জন্য ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
* একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী এবং বৈশ্বিক চাহিদা মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমের পুনর্বিন্যাস, পাঠদান পদ্ধতির আধুনিকায়ন ও উদ্ভাবনমূলক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনায় গুরুত্ব প্রদান করা।
* অনুষদভিত্তিক ও বিভাগওয়ারি শিক্ষা ও গবেষণাকর্মের মূল্যায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ র্যাংকিং পদ্ধতি প্রবর্তন করা যেতে পারে। এ ধরনের র্যাংকিং অনুষদ ও বিভাগগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি এবং স্ব স্ব অনুষদ ও বিভাগের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা রাখবে।
খ. ওয়েবসাইটের উন্নয়ন ও যথা সময়ে তথ্য প্রদান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয ওয়েবসাইট এবং বিভাগওয়ারি ওয়েবপাতার উন্নয়ন এবং এতে শিক্ষক, গবেষক ও বিভাগ সমূহের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমের তথ্যাদি নিয়মিত আপডেটের ব্যবস্থা করা। দেশের বাইরে থেকে চাইলেই যেন সহজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারে, সে ব্যবস্থা করা। তাছাড়া র্যাংকিং প্রণয়নকারী সংস্থাসমূহকে চাহিদা অনুযায়ী যথাসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য ও অর্জন সম্পর্কিত তথ্য প্রদানের ব্যবস্থা করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের অহংকার ও গৌরবের প্রতিষ্ঠান। শতবর্ষী এ প্রতিষ্ঠানটির সাথে শুধু আমাদের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ঐতিহ্য জড়িত নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে বাঙালি জাতিসত্বার বিকাশ এবং সর্বোপরি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস। বাঙালি জাতির প্রতিটি গৌরবময় অর্জনে নেতৃত্ব দেয়ার বিরল কৃতিত্ব রয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের। সত্যেনবসু ও ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ বিশ্বনন্দিত শিক্ষক এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মহানস্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস প্রমুখ বিশ্বখ্যাত গ্রাজুয়েটদের স্মৃতিধন্য এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা ও গবেষণার ঐতিহ্যের অবনমন বিষয়ে সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আর এ অবনমনের জন্য কেবল শিক্ষকদের দায় অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে কেবল তাদের অদক্ষতা ও রাজনীতি সংশ্লিষ্টতাই এর জন্য দায়ী এমন বক্তব্যও যুক্তিসঙ্গত নয়। এর সাথে অনেক বিষয় জড়িত আছে এবং সেদিকেও নজর দিতে হবে। আর ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পাশাপাশি, বিশ্ববিদ্রালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সরকারসহ সংশ্লিষ্টকলকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমাদের সমন্বিত উদ্যোগই এই প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়কে তাঁর অতীত গৌরব ও ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি বৈশ্বিক র্যাংকিং এ সম্মানজনক অবস্থানে উন্নীত করতে পারে।
লেখক: ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান
অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।