আন্দোলন হওয়া উচিত, ১৫-১৮ বছরেই কর্মে যুক্ত হতে চাই
বিগত প্রায় ছ’বছর ধরে সাধারণ ছাত্র পরিষদ নামের একটি সংগঠন আন্দোলন করে আসছে সরকারি চাকরি শুরুর বয়স-সীমা বাড়ানোর। তাদের দাবি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছর থেকে ৩৫ বছর করতে হবে। দাবির পক্ষে-বিপক্ষে অনেক আলোচনা।
বয়সসীমা বৃদ্ধির প্রধান কারণ সমূহ
কেন চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হবে তার অনেক কারণ উল্লেখ হয়েছে। যেমন, দেশের গড় আয়ু বেড়েছে, পৃথিবীর অনেক দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বেশি, বাংলাদেশে আবেদন করা থেকে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশে ২-৩ বছর সময় লাগে। কোনো দেশে যখন কোনো একটি নিয়ম তৈরি হয় তখন তার বিশেষ প্রেক্ষাপট থাকে। ওই প্রেক্ষাপট উল্লেখ না করে অন্য দেশের কোনো একটি নিয়মকে নিজের দেশের জন্য অনুকরণীয় করতে যাওয়া বিপদজনক হতে পারে। অথবা বাস্তবসন্মত নাও হতে পারে।
আবার গড় আয়ু বেড়েছে বলে একজন তরুণের কর্মে প্রবেশের জন্য অপেক্ষমান সময় দীর্ঘ (৩৫ বছর পর্যন্ত চাকরির জন্য অপেক্ষা করা) করতে হবে এটা কোনো সুখকর যুক্তি হতে পারেনা ওই তরুণের জন্য। গড় আয়ু বেড়েছে, সুতরাং লক্ষ্য হওয়া উচিত যে, কত দ্রুত দক্ষতা অর্জন করবে, আয় করবে, স্বাবলম্বী হবে নিজের জীবনকে সাজাবে, দেশের উৎপাদনের সহযোগী হবে, জীবন উপভোগ করবে।
দেশের বাস্তবতা
দেশের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। যদি, দেশে চাকরিতে প্রবেশের কোনো বয়সসীমা না থাকে তাহলে কী হবে? তাহলে কি দেশের সকল বা অধিকাংশ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী চাকরি পাবেন? নাকি তাদের অপেক্ষার পালা বাড়বে? উত্তর হচ্ছে, সবাই সরকারি চাকরি পাবেন না এবং অপেক্ষার পালা বাড়বে। কারণ, প্রতিবছর দেশের ১৯-২০ লাখ তরুণকে বেসরকারি চাকরির মাধ্যমে জীবিকার সন্ধানে করতে হচ্ছে।
আমরা জানি দেশে প্রতি বছর প্রায় ২০-২২ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। এর মধ্যে মাত্র ১০-১১ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান করা সম্ভব হয়। এই মধ্যে সকল গ্রেড মিলে সরকারি চাকরির পদ মাত্র আনুমানিক ৩২-৩৮ হাজার। এ বিষয়ে আমাদের মনজগতে পরিবর্তন আনতে হবে। এ পরিবর্তন আনতে নীচের বিষয়গুলো জানতে হবে-
- শ্রমবাজারে কর্মক্ষম কত মানুষ আছে,
- কোন কোন সেক্টরে কি পরিমাণ চাকরি আছে;
- নিয়োগকর্তা কে এবং
- বিশেষ করে সরকারি খাতে কতজন নিয়োগ হয় প্রতি বছর;
উপরের বিষয়গুলোর একটা খসড়া হিসাব তরুণদের জানা খুবই জরুরি। একজন তরুণ সেরকম প্রস্তুতি নেবেনভ হিসেবে ভুল হলে অপেক্ষার পালা বাড়বে, সময় নষ্ট হবে, হতাশা বাড়বে। দেশের উৎপাদন নষ্ট হবে, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (সহজভাবে বললে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কর্মে নিয়োজিত হবেন, অধিক আয় হবে, দেশের সঞ্চয় বাড়বে) এর যে সুযোগ দেশ তা হারাবে।
গবেষণা বলছে, পড়াশোনা শেষ করার ছয় মাসের মধ্যে চাকরি পেয়েছেন অর্ধেক তরুণ (৫০.৭৪)। ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে ৩১ শতাংশকে। আর ১৮ শতাংশ তরুণকে দুই বছরের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।
সমাজে সেবার ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, প্রযুক্তি যোগ হয়েছে জীবনে ও অফিসে, ব্যাবসা বাণিজ্য গ্লোবাল হয়েছে, অন-লাইন বাবস্থায় প্রদত্ত সেবা জীবনের অনেক চাহিদা পূরণ করছে। সরকারি অফিসও অনেকাংশে অনলাইনে চলছে। ফলে আগে শ্রমনিবিড় যে অফিস ছিল তা দিন দিন কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ, দেশে আনুষ্ঠানিক চাকরির (লিখিত নিয়োগপত্র, নিয়মিত বেতন, স্থায়ী পদ, ইত্যাদিকে বুঝায়) সংখ্যা কমে যাচ্ছে দিন দিন।
কোভিড-১৯ প্রভাবে বর্তমানে যে ধাঁচের কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং চাকুরি আছে তার সবই বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে এবং ধাক্কা খেয়েছে। যেমন, বড় বড় বিপনণ কেন্দ্র, রেস্টুরেন্ট, ট্যুরিজম, ডেভেলপার, খাবারের হোটেল, পার্লার, কমিউনিটি সেন্টার, উবারসহ আর অনেক ব্যবসার গতি আগের মত নেই। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কিন্ডার গার্ডেন স্কুল সহ সংশ্লিষ্ট অনেক খাত স্থবির।
এ পরিস্থিতে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ালে আপাতত তরুণদের আশা বাড়বে কিন্তু সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তাদের জীবনে। অর্থাৎ অপেক্ষার পালা বাড়বে, বেকারেত্বের নাম ঘুচাতেই চলে যাবে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। অভিভাবকদের অপেক্ষার পালা বাড়বে, ব্যয় ভার বাড়বে।
একজন ছাত্র-ছাত্রী যখন ৪-৫ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তখনই তো চাকরির প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হওয়া উচিত। এর পরে আরও ৩-৪ বছর সময় পায়। তারপর আরও সময় প্রয়োজন! বাস্তবতা হওয়া উচিত, পড়াশুনা এবং চাকরির অপেক্ষা থেকে যত দ্রুত সম্ভব বের হয়ে কর্মে লিপ্ত হওয়া। দেশে এ মুহূর্তে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ/অপরিহার্য কর্ম খাত আছে যেখানে সেবা দান করতে উচ্চ মাধ্যমিক এর বেশি শিক্ষার প্রয়োজন নেই।
অনেক তরুণ ৩০ বসর পর্যন্ত অপেক্ষা করে আশাহত হয়ে পরে ওই সেবা খাতে হতাশাসহ কাজ করছে জীবন যাপন করছে । চাকরির বয়স বাড়ালে ওই সকল তরুণকে ৩০ বা ৩৫ বসর পর্যন্ত আশায় আশায় অপেক্ষমাণ থাকতে হবে। বিষয়টি যৌক্তিক হবে না। ভারতে সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়স ৬০ বছর। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের ক্ষেত্রে তা পাঁচ বছর বেশি, অর্থাৎ ৬৫ বছর।
চাকরিতে অবসরের বয়স বাড়ানোও এক জটিল প্রশ্ন। সকল কর্মকর্তা কর্মচারি কি দক্ষ বা উচ্চ প্রেষণা সম্পূর্ণ? যদি সবাই দক্ষ ও উচ্চ প্রেষণার না হয় তাহলে সবার চাকরির বয়স বাড়ানো কি যৌক্তিক হবে? বা বাড়ালে দেশ কি উপকৃত হবে? বরং অনেক কর্মকর্তা কর্মচারি আছেন যারা বিভিন্ন কারণে (পারিবারিক, বর্তমানে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল, ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা) অল্প বয়সেই স্বেছায় অবসরে যেতে চান।
তাদের সামান্য বা চাকরি আনুপাতিক সুবিধা দিয়ে অবসরে যেতে সুযোগ করে পদ খালি করা এবং দক্ষ-মেধাবী তরুণদের নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে। দক্ষ ও কল্যাণধর্মী কর্মকর্তা কর্মচারির বয়স সীমা বাড়ানো দেশের জন্য অবশ্যই মঙ্গলজনক।
৩.২ কোটি তরুণের এই দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা নিতে সচেষ্ট এবং সার্বিক পরিকল্পনা করেছে। ১৫ বছর বয়স থেক একজনকে কর্মক্ষম বলে পরিসংখ্যান তৈরি করছি। কিন্তু বাস্তবে, ওই তরুণ জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে কর্মক্ষম সময় ১৫-৩০ বা দাবীকৃত ১৫-৩৫ বছর পর্যন্ত কর্মহীন রেখে দিচ্ছি চাকরির আশায়। এ বৈপরীত্য ভাঙতে হবে। ১৫ থেকে কর্মক্ষম বললে তার কাছাকাছি বয়সে কর্ম প্রদানের বাবস্থা করতে হবে।
বাক্তি, পরিবার,সমাজ, রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে এবং কর্মক্ষম তরুণকে যত দ্রুত কর্মে যুক্ত করা সম্ভব তা করতে হবে। গ্রামের একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরছি, একই সঙ্গে পড়াশুনা করে কিছু তরুণ কৃষি, খামার, ব্যবসা শুরু করেছিল। তারা ৩০-৩২ বছরের মধ্যে সংসার, পাকাবাড়ি সহ ১০-১৫ লক্ষ টাকা সঞ্চয় করেছে। অথচ, তার সঙ্গের যে তরুণটি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে চাকরির অপেক্ষায় সময় পার করেছে, সে এখনও বাবার ওপর নির্ভরশীল অথবা সব কিছু শুরু করতে হচ্ছে মাত্র।
আমরা দেখি বিসিএস-এর চাকরিতে আবেদন করেন চার লক্ষাধিক ছাত্র-ছাত্রী। কিন্তু সাধারণ পদ ১,০০০-১,৫০০ মাত্র বা তারও কম। অথচ, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর থেকে একজন ছাত্রছাত্রী আশায় থাকেন এই অসম্ভব বাস্তবতার দিকে। শেষ পর্যন্ত আশাভঙ্গ হয়, জীবন থেকে মূল্যবান স্বর্ণালী সময় নষ্ট হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে প্রতিবছর বাংলাদেশের মোট কর্মসংস্থানের মাত্র ৩.৮% সরকারি চাকরি, বেসরকারি ১৪.২%, বাক্তিমালিকাধীন ৬০.৯% এবং অন্যান্য ২১.১%। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ২০৪১ এর মধ্যে উন্নত দেশ হতে গেলে এ বিশাল তরুণ প্রজন্মকে কর্মে নিয়োজিত করতেই হবে। ভবিষ্যতে তারা কি ধরনের কর্মে নিয়োজিত হবে, কি সুযোগ আছে তরুণদের জন্য এবং তরুণরা কি করতে চান, কিভাবে কর্মে যুক্ত হবেন সে চিন্তা এবং কর্মপরিকল্পনা সকল ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাওয়া খুবই জরুরি।
আগামী দিনগুলোতে রাষ্ট্র তরুণদের দ্রুত কর্মে যুক্ত হওয়ার জন্য কি ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করছে বা করবে তার প্রতি জোরালো দৃষ্টিপাত জরুরি। আগেও বলেছি, দেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর ২০-২২ লাখ তরুণ যুক্ত হচ্ছে ৷ সরকারি ও বেসরকারি খাত, ব্যক্তি মালিকানাধীন খাত, উদ্যোক্তা-উন্নয়ন এবং বিদেশে শ্রমবাজার মিলিয়ে প্রায় ১০-১১ লাখের মতো নতুন কর্ম সংস্থান সম্ভব হয় ৷ বাকি ৯-১০ লাখ তরুণ কর্মহীন ৷ এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে কর্মে যুক্ত করার বাস্তবসম্মত মহাপরিকল্পনার জন্য আন্দোলন দরকার।
- এ আন্দোলন রাস্তা বন্ধ করে জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন না
- এ আন্দোলন হলো কর্মে যুক্ত হবার আন্দোলন,
- উদ্যোক্তা হয়ে গড়ে উঠার আন্দোলন,
- দেশের উৎপাদনে সহযোগী হবার আন্দোলন,
- স্বনির্ভর হবার আন্দোলন,
- জীবন থেকে উৎপাদনক্ষম সময় নষ্ট কমাবার আন্দোলন৷
আন্দোলন হওয়া উচিত যে, আমি তরুণ আমি ১৫-১৮ বছরের পরেই কর্মে যুক্ত হতে চাই।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে