২১ আগস্ট ২০২০, ১১:৪৮

ভালোবাসার জন্য আত্মহত্যা ভালোবাসারই অপমান

  © টিডিসি ফটো

মানবজীবন অনেকগুলো মানবীয় সম্পর্কের ধারায় প্রবাহিত হয়। জীবনের অনেক সম্পর্কের মধ্যে নারী-পুরুষের প্রেমের সম্পর্ক অন্যতম। একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর প্রতিটি মানুষ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রবল আকর্ষণের অধ্যায়ে উপনীত হয়। এতে যৌনতা যেমন বিদ্যমান থাকে তেমনি বিভিন্ন মানসিক চাওয়া-পাওয়ার প্রভাবও থাকে। তবে সকল স্বাভাবিক প্রেমের সম্পর্কে একটি পর্যায়ে যৌনতা গৌণ হয়ে পড়ে এবং ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে সমগ্র জীবন অতিবাহিত করার ইচ্ছে মূখ্য হয়ে যায়, যার সমাজ স্বীকৃত নাম বিবাহ।

সম্পর্ক যেভাবেই শুরু হোক না কেনো, আপাতদৃষ্টিতে যতই অসম মনে হোক সম্পর্কের একটি পর্যায়ে দুইজনেই একে অপরের উপর মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একজনের সুখের বেলায় অপরজনের উপস্থিতি কামনা করে, বিরহ বেলাতেও আরেকজনকে পাশে রেখে লড়তে চায়, স্বপ্ন দেখে দ্বৈত জীবনের। এই চাওয়াগুলো নিঃসন্দেহে পবিত্র। তবে এসব পূরণের ব্যর্থতাই জীবনের পরাজয় নয়।  

বিশ্বায়নের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে পশ্চিমা অনুকরণে আমাদের অনেক আচার-ব্যবহারে পরিবর্তন আসলেও আমাদের সামাজিক-সংস্কৃতির অনেক কিছুই এখনো অটল এবং অভেদ্য। ব্যক্তিজীবনে চাহিদা-যোগানের নানামুখী পরিবর্তনের রেশ দেখা গেলেও এখনো পরিবারকে সহজেই অতিক্রম করা যায় না। আর পারিবারিকভাবে বিয়ে মানে দুইটি পরিবারের বিভিন্ন ধরনের আলাপ, আকাঙ্ক্ষা, অনুমান এবং হিসেবের মিশেল। যেকারণেই হোক অভিভাবকেরা প্রেমের বিয়েকে স্বাচ্ছন্দ্যে মানে না। এর সাথে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বিয়েতে পাত্রের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং সামাজিক অবস্থান প্রধানতম বিবেচনার বিষয় হিসেবে যোগ হয়।

কিন্তু প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষাজীবন শেষ করে, উপার্জনের পথ তৈরী করে বিয়ে করতে একজন পুরুষের গড়ে ২৮-৩৫ বছর সময় লাগে। ফলে বর হিসেবে প্রেমিক এবং বেকার কোনোটিই পারিবারিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয় না। অথচ বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতার গুরুত্ব থাকলেও তার উপার্জনক্ষম হওয়াটা জরুরী নয়। আর দেশে ধর্ষণ, ইভটিজিং এবং নারী নির্যাতনের মত ঘৃণ্য ঘটনার যে ব্যাপকতা তাতে সকল বাবা-মা যত দ্রুত সম্ভব মেয়ের বিয়ে দিতে চায়। তাই অনেক বছর প্রেমের সম্পর্কে থাকলেও প্রেমিকের চাকরীপ্রাপ্তির জন্য অতিরিক্ত দুই বছর অপেক্ষা করা মেয়েদের জন্য অনেকটা অসম্ভবই। 

বিগত বছরগুলোতে যতো ছেলে আত্মহত্যা করেছে তার পিছে চাকরী না পাবার হতাশার চেয়ে প্রেমে অসফলতার ঘটনাই বেশি দেখা যায়। অথচ এই ছেলেগুলোর জীবনের সাথে জড়িয়ে ছিলো তাদের পরিবার এবং অসংখ্য আত্মীয়-বন্ধুদের ভালোবাসা। বৃদ্ধ পিতামাতার শেষ ভরসা হয়েও কোন যৌক্তিকতায় কেউ নিজেকে মেরে ফেলে আমার জানা নেই। সুখী-সুন্দর দাম্পত্যের জন্য মনের মানুষকে ঘরের মানুষ করার প্রচেষ্টা থাকা অবশ্যই ভালো। কিন্তু কোনো কারণে তা সম্ভব না হলেই কি ভালোবাসারও মৃত্যু হয়ে যায়! হারিয়ে যায় মনের সকল পবিত্র অনুভব! জীবন কী এতোটাই অর্থহীন হয়ে পড়ে যে নিজেকে খুন করে দিতে হয়! আত্মহত্যাকারী ভাবে যে সে শুধু নিজেকেই খুন করছে।

কিন্তু প্রকৃত বিচারে সে তার পরিবারের স্বপ্ন, প্রিয় মানুষদেরও খুন করে। সারাজীবনের জন্য অপরাধবোধে ফেলে যায় ভালোবাসার মানুষটিকে। অনেক সময় আত্মপীড়ন এবং সমাজের অভিযোগে দ্বিতীয়জনও একই পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। সত্যিকারের প্রেমিক কখনো তার ভালোবাসার মানুষকে জীবন্মৃত করে রেখে যেতে পারে না। এতে প্রেমের মহত্ব নষ্ট হয়।

প্রেমের জন্য এই আত্মহত্যা প্রকারান্তরে প্রেমেরই হত্যা করা, প্রেমকে অপমান করা। প্রেমতো সেটা যা প্রেমিকাকে ঘরের বউ করার একমাত্র উদ্দেশ্যের চেয়ে মনকেই ঘর করে আজীবন ভালোবাসাকে লালন করে যায়, পরিস্থিতিকে অতিক্রম করে স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যায় সামনে, যে প্রেমে কোনোদিন মানসিক বিচ্ছেদ আসে না। 

 

লেখকঃ থিসিস শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।