বাংলাদেশে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা
শিক্ষাব্যবস্থা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হয়। কারণ সময়ের আবর্তে বেশকিছু বিষয়ের চাহিদা বাড়ে এবং কিছু বিষয়ের চাহিদা কমে যায়। বিশ্বজুড়ে প্রচলিত আছে নানা ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা। অনেক দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকেই আমরা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে থাকি। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে একটু চেষ্টা করলেই উন্নত করতে পারি, আবার সবার জন্য অনুকরণীয়ও করতে পারি।
দেশের বাইরে পড়াশোনা করার সুবাদে বেশকিছু দেশ এবং তাদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্ক জানার বেশকিছু সুযোগ হয়েছিল। আমার স্বল্প জ্ঞানের আলোকে যে বিষয়টি মনে হয়েছে তা হলো আমাদের দেশের একদম স্কুল পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার দরকার।
১.স্কুল পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার
স্কুল পর্যায়ে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের ক্ষেত্রে আমাদের মূলত দেশের প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকে শুরু হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে সংস্কার করতে হবে। প্রথমেই শুরু করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা স্তর থেকে। কারণ প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে মূলভিত্তি যার উপর নির্ভর করেই পরিবর্তে শিক্ষার শাখা-প্রশাখা প্রসারিত হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা স্তর বলতে একদম কিন্ডারগার্টেন কিংবা প্রাইমারি স্কুল শুরু করে এসএসসি পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারকে বোঝানো হয়েছে। এক্ষেত্রে নির্ধারিত ক্লাসগুলো একত্র করে মোট তিনটি স্তরে ভাগ করা হবে— প্রি-হাইস্কুল স্তর, হাইস্কুল স্তর এবং প্রি-কলেজ স্তর।
প্রি-হাইস্কুল স্তর (কিন্ডারগার্টেন থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত):
কিন্ডারগার্টেন কিংবা প্রাইমারি স্কুল থেকে ক্লাস ফোর পর্যন্ত স্তর হবে প্রি-হাইস্কুল। আর এই স্তরে কেবল ছাত্র-ছাত্রীরা কেবল স্কুলে আসা-যাওয়া করবে। কোনো রকম পরীক্ষা এই স্তরে থাকবে না। আর ক্লাসগুলোও নেয়া হবে ভিন্নরকমভাবে। সিচুয়েশন নির্ভর ক্লাস করানো হবে। মূলত এই স্তরে ছাত্র-ছাত্রীদের সামাজিক জ্ঞান, ভাষাভিত্তিক জ্ঞান, পারিবারিক জ্ঞান এবং মৌলিক বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান এই চারটি স্তরের জ্ঞান দেয়া হবে।
এই স্তরে মূলত অডিও-ভিডিও মাধ্যমে পড়ানোর উপর বেশি জোর দেয়া হবে। দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে এই চারটি জ্ঞানের পাশাপাশি ধর্মীয়ও জ্ঞানও দেয়া হবে।
হাইস্কুল স্তর (পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণী):
পঞ্চম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত হবে হাইস্কুল স্তর। এই স্তরে বাৎসরিক কেবল দুইটি পরীক্ষা থাকবে। বিদ্যালয়গুলোতে এই স্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যবোধ, নৈতিকথা এবং বিষয়ভিত্তিক এই তিনটি স্তরের জ্ঞান দেয়া হবে। বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের কাউন্সেলিংও করা হবে। তাদের সমস্যার কথা শুনে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হবে চেষ্টার উপর ভিত্তি করে। এই চেষ্টাকে ৩০-১০০% এর মধ্যে প্রকাশ করা হবে। কেউ যদি প্রচেষ্টায় বার্থ হন, তাহলে তার জন্য তাকে স্পেশাল কাউন্সেলিং এবং কোচ করানো হবে।
প্রি-কলেজ স্তর (নবম থেকে দশম বা এসএসসি):
নবম শ্রেণী থেকে এসএসসি পর্যন্ত হলো প্রি-কলেজ স্তর। এই স্তরে মূলত দুইটি ধরনের জ্ঞান দেয়া হবে— বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান এবং কৌশলগত জ্ঞান। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান দেয়া হবে সিলেবাসে বর্ণিত নির্দিষ্ট বিষয়গুলোর উপর। এই স্তরে থাকবে না কোনো নিৰ্দিষ্ট বিভাগ। ছাত্র-ছাত্রীদের মৈলিক বিষয় এবং বিষয়ভিত্তিক সমাজ, বিজ্ঞান, ব্যবসায় এসবের উপর জ্ঞান দেয়া হবে। আর কৌশলগত জ্ঞান হচ্ছে মূলত ফ্রি বিষয়গুলো এই বিষয়গুলোর ক্লাস হবে কিন্তু কোনো পরীক্ষা হবে না।
এই বিষয়গুলো রাখা হবে যেন ছাত্র-ছাত্রীদের যোগ্যতা বাড়ে এবং তারা নিজের ইচ্ছেমতো কিছু শিখতে পারে। এই জ্ঞানের বিষয়গুলো মূলত ভাষা, প্রযুক্তি ইত্যাদি হবে।
প্রি-কলেজ স্তরের পরীক্ষা পদ্ধতি:
এই স্তরে বাৎসরিক তিনটি পরীক্ষা থাকবে। এসএসসি পরীক্ষা হবে দুই স্তরে। প্রথম স্তরে বিষয় ভিত্তিক জ্ঞানের উপর পরীক্ষা হবে। তারপর সবাইকে একটি করে নিজের একটি করে প্রকল্প জমা দিতে হবে। এই প্রকল্পের জন্য দেশের মধ্যে থেকে বেশ কিছু সমস্যা বের করা হবে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের এইসব ভিন্ন ভিন্ন সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য নিজেরদের মতো করে সল্যুশন দিতে হবে।
ফলাফল ব্যবস্থার পরিবর্তন:
তথাকথিত সিজিপিএ ব্যবস্থার বদলে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হবে চেষ্টার উপর ভিত্তি করে। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান এবং কৌশলগত জ্ঞান—এই দুই স্তরের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের চেষ্টাকে ৩০-১০০% এর মধ্যে প্রকাশ করা হবে।
নকল ও প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করার জন্য পদ্ধতি:
পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া বন্ধ করতে রিভার্স সাপ্লাই চেইনের প্রয়োগ করা হবে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র অসদুপায়ে কি করে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পৌঁছে তার উপর পূর্ণ গবেষণা করা হবে এবং প্রশ্নফাঁস বন্ধ করার জন্য ক্লোজড সাপ্লাই চেইন ব্যবহার করা হবে।প্রশ্নপত্র বানানো হবে চার সেট করে। এই চারটি সেটই পাঠানো হবে পরীক্ষার কেন্দ্রগুলোতে। প্রতিটি সেট প্রশ্নপত্র একটি করে বিশেষ বক্সে থাকবে যেগুলো খোলা হবে স্ব স্ব পরীক্ষা কেন্দ্রে কেবল পরীক্ষা শুরুর ২০ মিনিট আগে বিশেষ কোড ব্যবহার করে।
আর পুরো প্রশ্নপত্র প্রিন্টিংয়ের এবং কেন্দ্রে পৌঁছানোর কাজ করা হবে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে। নকলের জন্য জিরো টলারেন্স নীতি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হবে। দেশের প্রতিটি পরীক্ষা কেন্দ্র সম্পূর্ণ হঠাৎ করে পরিদর্শন করা হবে এবং নকল পাওয়া মাত্র কঠোর বহিষ্কার এবং চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে।
২। কলেজ পর্যায়ে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার:
আমাদের বর্তমান কলেজ শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীরা মূলত তিনটি গ্রুপে— বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা এবং মানবিক পড়াশোনা করে থাকে যার সংস্কার দরকার। আর এই জন্য কলেজ শিক্ষা ব্যবস্থার দুই বছরকে সাজানো হবে ভিন্ন আঙিকে। আর এই দুই বছরে জ্ঞান দেয়া হবে তিনটি স্তরের— সাধারণ, বিষয়ভিত্তিক এবং প্রায়োগিক।
কলেজের প্রথম ও দ্বিতীয় বছর:
কলেজের প্রথম বছর সাধারণ ও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান দেয়া হবে ক্লাসের মাধ্যমে। ক্লাসগুলোতে পড়ানোর জন্য অডিও-ভিডিও ব্যবহার করা হবে। কলেজের শেষ বছর হবে প্রায়োগিক জ্ঞান। এই পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করতে হবে। গ্রুপে ভাগ করার পর ছাত্র-ছাত্রীদের একজন করে নিৰ্দিষ্ট সুপারভাইজারের তত্ত্বাবধানে রাখা হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রুপ অনুযায়ী সুপারভাইজার দেয়া হবে এবং সুপারভাইজারদের কাজ হবে প্রতিটি গ্রুপে ওদের মেজর অনুযায়ী কাজ দেয়া।
বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীদের দেয়া হবে স্থানীয় এলাকা সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান বিষয়ক কাজ। যেমন— এলাকার মানুষের মধ্যে কি করে স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি করা যায়, এলাকার চিকিৎসার কি করে উন্নয়ন করা যায়। এই রকম বিষয়গুলো নিয়ে কাজ দিতে হবে।
আবার ব্যবসায় শিক্ষা শাখার জন্য বিষয় ঠিক করা যেতে পারে এমন— আমাদের দেশের সব এলাকারই মোটামুটি নিৰ্দিষ্ট ১-২টি ব্যবসায় আছে। ছাত্র-ছাত্রীদের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ের সমস্যা সমাধানকল্পে কী কী করা যেতে পারে তা নিয়ে কাজ দেয়া যেতে পারে।
মানবিক শাখার ছাত্র-ছাত্রীদের কাজ দেয়া যেতে পারে এলাকার ঐতিহাসিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে দিতে হবে। তাদের কাজ দিতে হবে এলাকার সবমানুষের কাছে এলাকার অতীতের গৌরবান্বিত বিষয়গুলো কী করে পৌঁছানো যায় তা নিয়ে।
প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের কাজ:
প্রায়োগিক জ্ঞানের মূলত দুইটি স্তর— প্রথম স্তরে ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রুপের কাজ শেষ করার পর দ্বিতীয় স্তরের কাজ শেষ হবে। দ্বিতীয় স্তরের কাজ হবে মূলত এক সপ্তহের। এজন্য আগে থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট থেকে তাদের পছন্দের পেশাগুলোর রাঙ্কিং নিতে হবে। তারপর একদম প্রথম ১-২ এর মধ্যে থাকা পেশাগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের এক সপ্তহের জন্য অবজার্ভার/ট্রেইনি হিসেবে পাঠানো হবে। যেমন— যার ডাক্তার হবার ইচ্ছে, তাকে হসপিটালে একজন ডক্টরের সাথে, যার ব্যাংকার হবে ইচ্ছে তাকে ব্যাংকের সাথে ইত্যাদি। সবশেষে কলেজের কেবল প্রথম বছরই পরীক্ষা থাকবে।
দ্বিতীয় বছর থাকবে প্রয়োগ স্তরের কাজ। আর সবশেষে এইচএসসি পরীক্ষা।
ক্লাস পদ্ধতি:
একাডেমিক ইংরেজিতে ছাত্র-ছাত্রীদের দক্ষ করা গড়ে তোলা এবং উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতকল্পে একাডেমিক ইংরেজি নামে একটি আবশ্যক বিষয় চালু করা হবে। এই কোর্স হবে পুরো কলেজ জীবনের দুই বছর ধরে এবং এতে একাডেমিক রিডিং, রাইটিং, প্রেসেন্টেশন ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর জোর দেয়া হবে বেশি। এই কোর্সের জন্য ক্লাস টেস্ট হবে কিন্তু এইচএসসিতে কোনো পরীক্ষা হবে না।
আর এই কোর্স করার পর ছাত্র-ছাত্রীদের এই কোর্সের জন্য একটি বিশেষ সার্টিফিকেট দেয়া হবে যা ছাত্র-ছাত্রীরা পরবর্তীতে দেশ এবং দেশের বাহিরে পড়াশোনার কিংবা যে কোনো ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারবে। এছাড়াও এই ছাত্র-ছাত্রীদের বেসিক প্রোগ্রামিং সম্পর্কে ধারণা দেয়া হবে পুরো দুই বছর ধরে যাতে করে ছাত্র-ছাত্রীরা সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কে আগেই দক্ষ হয়ে উঠে। এই কোর্সের জন্যও অনুরূপ সার্টিফিকেট দেয়া হবে যা ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনা কিংবা চাকরির ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারবে।
আবার কলেজগুলোতে টেকনোলজি ফেস্ট এবং এন্ট্রেপ্রেনিউরশিপ ফেস্ট হবে এবং তার মধ্যে থেকে সবচাইতে ভালো এবং কার্যকরি প্ল্যানগুলো বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য যাবতীয় সাহায্য করা হবে।
এইচএসসি পরীক্ষার ধরণ:
এইচএসসি পরীক্ষা হবে দুই ধাপ করে। প্রথম ধাপে সাধারণ এবং বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা হবে। দ্বিতীয় ধাপে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রায়োগিক স্তরে করা কাজের উপর একটি প্রেসেন্টেশন দিতে হবে এবং একটি রিপোর্ট জমা দিতে হবে। কলেজের জীবন হওয়া উচিত জীবনের ভিত্তি।
কিন্তু আমাদের বর্তমানের ব্যবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীরা জীবনের তেমন কিছুই অনুধাবন পারে না কলেজ জীবনের শিক্ষা থেকে। এই সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি হয় যারা ছোট শহরগুলো থেকে আসে তাদের। আর কলেজ জীবন থেকেই সবার মোটামুটি পেশা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা উচিত। তাই কলেজ জীবনে প্রায়োগিক জ্ঞানের দরকার রয়েছে।
৩। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার:
দেশের বেকার সমস্যার মূলে অনেক কারণের মধ্যে আমাদের প্রচলিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থাও রয়েছে। বর্তমানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চার বছর মেয়াদি অনার্স/আন্ডারগ্রাডুয়েট ডিগ্রি এবং এক থেকে দুই বছর মেয়াদি মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু রয়েছে।সবচেয়ে বেশি দেখার বিষয় হচ্ছে, অন্য যেকোনো বিষয় কিংবা মেজরের তুলনায় একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ব্যবসায় প্রশাসন সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে পড়ে বেশি।
চার বছর মেয়াদি একটি ডিগ্রি প্রোগ্রামে চার বছরই ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস, পরীক্ষা, প্রেসেন্টেশন, ইত্যাদি দিয়ে শেষ হয়। দিন শেষে চাকরি পাবার আসায় বাজারে প্রচলিত গাইডবইগুলো কিনে পড়তে হয় আরো ১-২ বছর কিংবা আরো বেশ কিছুদিন অনেকের ক্ষেত্রে। অনেকে আবার চার বছরের পড়াশোনার মধ্যেই চাকরির জন্য পড়াশোনা করেন আজকাল। আসলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চার বছর মেয়াদি অনার্স কিংবা বিবিএ ডিগ্রি প্রোগ্রামের সিলেবাসে পরিবর্তন আনা প্ৰয়োজন। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার ডিগ্রি প্রোগ্রামগুলো হওয়া উচিত দেশের অর্থনীতি এবং চাকরির বাজার বিবেচনা করে।
আর এই জন্য ৪ বছরের ডিগ্রি প্রোগ্রামে এমন করে সাজাতে হবে যাতে করে যারা কেবল চার বছর পরেই চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে আগ্রহী তাদের জন্য মঙ্গলজনক হয়। আবার মাস্টার্স প্রোগ্রাম থাকবে যারা পিএইচডি কিংবা গবেষণা করবেন কিংবা শিক্ষক হবেন তাদের জন্য। আবার প্রফেশনাল মাস্টার্স রাখতে হবে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা যারা নিজেদের স্কিল ডেভেলপ করতে চান তাদের জন্য।
উদাহরণ হিসেবে আমাদের দেশের চার বছরের বিবিএ প্রোগ্রামকে ধরা যেতে পারে। একটি চার বছরের বিবিএতে বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক বিষয় পড়তে হয় কিন্তু চাকরি পেতে হলে পড়তে হয় অন্য জিনিস। তাই চার বছরের বিবিএ এর সিলেবাস সাজাতে হবে একদম ভিন্ন রকম করে। চার বছরের বিবিএতে আট সেমিস্টার থাকবে এবং ক্লাস, পরীক্ষা ইত্যাদি মিলে মোট দশ মাস মেয়াদি হবে প্রতিবছর। বাকি দুই মাসকে ভাগ করা হবে সামার ভ্যাকেশন এবং উইন্টার ভ্যাকেশনে।
চার বছরে বিবিএতে প্রতিবছরই সামার এবং উইন্টার ভ্যাকেশন থাকবে। এর মধ্যে প্রথম তিন বছর সামার এবং উইন্টার ভ্যাকেশনে ছাত্র-ছাত্রীদের বিশেষ ট্রেনিং দেয়া হবে। সামার ভ্যাকেশনগুলো হবে ইন্টার্নশীপ করার জন্য এবং উইন্টার ভেকেশনগুলো হবে নতুন মার্কেটে ডিমান্ড আছে এমন স্কিলসের ট্রেনিংয়ের জন্য। সামার ভ্যাকেশনে প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে দুই সপ্তাহের ইন্টার্নশীপ করতে কোম্পানিগুলোতে পাঠানো হবে। আর উইন্টারে ছাত্র-ছাত্রীদের বিশেষ স্কিলস যেমন বিভিন্ন প্রফেশনাল সফটওয়্যার, কর্পোরেট স্কিল, কোম্পানি কালচার ইত্যাদি নিয়ে দুই সপ্তাহের ট্রেনিং দেয়া হবে।
আর শেষের বছর মানে চার বছর হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর। এই বছর সামার ভ্যাকেশনে চাকরি খোঁজা, আবেদন করা, সিভি তৈরি, ইন্টারভিউ দেয়া ইত্যাদি নিয়ে পুরো বছরব্যাপী ট্রেনিং দেয়া হবে পাশাপাশি। এছাড়াও এই বছরই ছাত্র-ছাত্রীদের বিশেষ ইন্টারভিউ নেয়া হবে এবং ওদের কোন সেক্টরে চাকরি করার ইচ্ছে জানার জন্য। তারপর সেই অনুযায়ী তাদের ভাগ করা হবে গ্রুপে এবং প্রতিটি গ্রুপের মেন্টর করবেন একজন ডাইনামিক শিক্ষক।
সব শেষে বিবিএয়ের ফাইনাল পরীক্ষার আগে মানে উইন্টার ভ্যাকেশনে দেশি এবং বিদেশী কোম্পানিগুলোকে আনা হবে ক্যাম্পাস রিক্রুটমেন্টের জন্য। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রোফাইল এবং ইন্টারভিউয়ের উপর ভিত্তি করে ইন্টারভিউ প্লেসমেন্ট করা হবে। তার মানে ফাইনাল পরীক্ষার আগেই ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে চাকরি থাকবে। এতে করে সরকারি চাকরি নিয়ে যে পরিমান ফ্যান্টাসি তা পুরোপুরি কমে যাবে। এতো গেলো ব্যবসায় প্রশাসনের ডিগ্রিগুলোর কথা।
এখন কথা বলা যাক, আমাদের দেশের বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে অনার্স করার বিষয় নিয়ে। ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া বিজ্ঞানের অন্য বিষয়গুলোতে অনার্স করার জন্য আজকাল কেউ তেমন একটা আগ্রহী হন না। কিন্তু ব্যাপারটি মোটেও ভালো না। বিশেষ করে আমাদের দেশে আজও বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে ভালো শিক্ষকের অভাব রয়েছে বিশেষ করে বড় শহরগুলোর বাইরে আজও ভালো শিক্ষকের অভাব রয়েছে।
তারপর রয়েছে মানবিক কিংবা সমাজ বিজ্ঞানের বিষয়গুলো যেমন বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, রাষ্টবিজ্ঞান ইত্যাদি। এসব বিষয়গুলোর জন্যও কিন্তু ভালো শিক্ষক কিংবা ভালো গবেষকের দরকার রয়েছে।
যারা ব্যবসায় প্ৰশাসনে পড়ছেন কিংবা পড়ছেন তাদের নিকট একটি অতি পরিচিত টপিকের নাম হচ্ছে blue ocean এবং red blue। Red ocean হচ্ছে এমন একটি মার্কেট যেখানে আর কোনো অপর্চুনিটি কিংবা চাহিদা নেই। আর blue ocean হচ্ছে এমন একটি মার্কেট যেখানে অপর্চুনিটি কিংবা চাহিদা আছে। ব্যবসায় প্ৰশাসনের ডিগ্রীগুলো আজকাল red ocean হয়ে গিয়েছে আমাদের দেশে কিছু কিছু মেজর ছাড়া। তাই এখন ব্যবসায় প্ৰশাসনের ডিগ্রীগুলোর সংস্কার প্রয়োজন বেশি।
আবার বিজ্ঞানের এবং মানবিকের বিষয়গুলোর মার্কেট হচ্ছে blue ocean তাই এই সব ফিল্ডে আগামী দিনগুলোতে অনেক দক্ষ লোকের দরকার পড়বে। যদিও বিষয়গুলো ব্যবসায় প্রশাসনের উপর লিখা কিন্তু যে কোনো বিষয়ের সিলেবাসকে সংস্কার করতে এইরকম ডাইনামিক কিছু করা সম্ভব। কারণ একটু চেষ্টা আর সদিচ্ছা থাকার কারণেই মানুষ এই অনেক কিছুকে জয় করতে পেরেছে।
লেখক: নূর-আল-আহাদ
বিবিএ (ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা) ১৪তম ব্যাচ
এমবিএ (ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়া)
মাস্টার অব ইঞ্জিনিয়ারিং (ফিনান্সিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং, জাপান)
ফিনান্সিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষক (জাপান)