১৯ আগস্ট ২০২০, ১৮:১৪

শ্রিংলার ঢাকা সফর কী বার্তা দেয়

  © টিডিসি ফটো

এক.
হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। ভারতের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্র সচিব। আমেরিকা, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশে পর্যাক্রমে তিনি রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন। সার্ক, জাতিসংঘ এবং ইসরায়েলের সাথেও ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশে ভারতের সদ্য সাবেক এই হাইকমিশনার মোদির বিদেশ নীতির বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডিপ্লোমেট।

বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার হিসাবে অতীতে কাজ করায় বাংলাদেশের রাজনীতিও তার নখদর্পনে।এদেশের রাজনৈতিক জটিল হিসাবের সাথে মি. শ্রিংলা খুব ভালো ভাবেই পরিচিত। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার যখন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হন তাতে একটা বিষয় তো স্পষ্ট করেই যে এদেশে দায়িত্ব পালন করা ভারতীয় আমলাদের বিশেষ যোগ্যতা হিসাবেই বিবেচিত হয়। বাংলাদেশে এখন টক অফ দি কান্ট্রি ভারতের এই পররাষ্ট্র সচিবের (১৮ অগাস্ট ২০২০) বাংলাদেশ সফর।

এমন কী হলো যে করোনা মহামারীতেও ভারতীয় বিশেষ বিমানে মি শ্রিংলা নরেন্দ্র মোদির বিশেষ বার্তা নিয়ে ঢাকায় আসলেন? অথচ গত মার্চেও তিনি পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। পাঁচ মাসের ব্যবধানে দুই বার ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফর খুব স্বাভাবিক বিষয় নয়। এবারের সফরটি হঠাৎ করেই।

ভারতীয় গণমাধ্যমের ভাষ্য মতে, সম্প্রতি বাংলাদেশের চীনের প্রতি অধিক ঝুকে পড়ায় ভারত এক ধরনের আতংক ও আস্থাহীনতায় ভোগছে। মোদি শ্রিংলার মাধ্যমে সরকারকে মূলত চীনের কাছ থেকে দূরে থাকার বার্তাই দিচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের সম্পর্ক বরাবরই ভালো। যদিও সে সম্পর্কে সমতার স্বার্থের ভারসাম্য নেই।সেই আওয়ামী লীগ একাধারে তিন মেয়াদে ক্ষমতায় তবুও কেন ভারত সরকারকে বিশ্বাস করতে পারছে না?ঝামেলাটা মনে হয় খুব ছোট নয়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক কোনো পালাবদল আগামী দিনে ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের খুব বড় ধরনের পরিবর্তন করতে পারে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সাথেই যেহেতু সমস্যা হচ্ছে অন্যদের সাথে তো হবেই। মোদি সরকার দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে এখন একেবারেই একা হয়ে গেলেন যার জন্য দায়ী তার উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক এজেন্ডা। বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের যে টানাপোড়েন চলছে এটা এখন আর লুকানো কিছু নয়।

সব প্রতিবেশিরা যখন দূরে চলে যাচ্ছে শেষ ভরসা বাংলাদেশকে যেকোনো ভাবেই হোক কাছে রাখার চেষ্টা মোদি করবেই। বলা হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করতেই ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের হঠাৎ এই বাংলাদেশ সফর। সম্পর্ক খুব স্বাভাবিক আছে উভয় পক্ষের প্রতিনিধিরাই বলছেন। তবে পারস্পরিক অনাস্থা, অবিশ্বাস আর দ্বন্দ্বের জায়গাটাও আর খুব ছোট নেই, বাড়ছে।

দুই.
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল ভারত। সেটা যদি শুধুই বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্যই হয়ে থাকে অর্থাৎ তারা যদি স্বাধীনতাকে এতই সম্মান ও শ্রদ্ধা করে তাহলে ভারত তার ঘরের ভেতর কাশ্মীরের স্বাধীনতাকমীদের কেন নিষ্ঠুরভাবে দমন করছে? বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়াটা এদেশের সাতকোটি মানুষের প্রাণের দাবী ছিল এটা যেমন সত্য। এখান থেকে ভারতের ‘সহযোগিতার বিনিময়ে সুযোগ নেওয়ার কৌশল’ এটাও চিরন্তন সত্য।

অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সময়ে সময়ে এখানের দুর্বল রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই দেশকে কি দিল্লির কাছে ভারতের কোনো প্রদেশের চাইতে খুব গুরুত্বপূর্ণ এটা বুঝাতে সক্ষম হয়েছে? এখন সময় এসেছে।পুরনো হিসাবের খাতায় ঋণ কিংবা গোলামির ইতিহাস জানতে চাচ্ছে বাংলাদেশের তরুণরা। যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসে তারা নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায়ও খুব জোড়ালো উচ্চারণেই এখন প্রশ্ন তুলছে-আমার স্বাধীন বাংলাদেশে তুমি কে? ভারতকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া এই প্রশ্নের আওয়াজ দিনকে দিন বাড়ছেই। ভারতের আতংকের জায়গা মনে হয় এটাও।

সম্প্রতি ভারত চীন সীমান্ত-লাদাখের গালওয়ান ভ্যালিতে চীনের সাথে ভারতের যে খন্ড যুদ্ধ হয়ে গেল খুব সহজ করে বললে সেই যুদ্ধে ভারতের শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। কুড়ি খানেক জওয়ান হারানোর পরেও চীনের বিষয়ে ভারতকে যথেষ্ট সাবধানী আচরণ করতেই দেখা গেছে। অথচ চীনের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট আগ্রাসী।

সাম্প্রতিক এই ঘটনায় চীন মূলত এই অঞ্চলে ভারত ও তার মিত্র আমেরিকাকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে- আমি তোমাদের খুব একটা হিসাব করিনা, তুমি কে? একটা ডেম কেয়ার অবস্থা!

নেপাল নতুন মানচিত্র তৈরি করে ভারতের সাথে বিতর্কিত জায়গাও সেখানে যুক্ত করে সংসদে সর্ব সম্মত আইন পাস করেছে। এখন সেই মানচিত্র জাতিসংঘ ও গুগুলের অফিসে পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। নেপাল সীমান্তে ভারতীয় মারখাচ্ছে! এমনকি একজন সম্প্রতি নিহতও হয়েছে। ভারত বলছে এগুলোর সব হচ্ছে চীনের ইন্ধনে। কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্ক এই উপমহাদেশের এক পরিচিত উপাখ্যান।

মালদ্বীপ, ভুটান, শ্রীলঙ্কার সাথেও ভারতের সময় ভালো যাচ্ছে না। আফগানিস্তানের তালেবানদের কাছে পরাজিত হয়ে মার্কিন বাহিনী এখন পর্যুদস্তু। সুতরাং আমেরিকার মিত্র ভারতের আফগানিস্তান নিয়েও আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই! ভারত দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে বিগত কয়েক দশকে সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ সময় অতিক্রম করছে এখন।

বাংলাদেশ ছাড়া এই মুহূর্তে ভারতের পাশে কেউ নেই! বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক কিছুটা হলেও যে সমস্যায় পড়েছে সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে মোমেনের ‘ভারতের সাথে সম্পর্ক রক্তের, চীনের সাথে অর্থনীতির’ এই মন্তব্য থেকেও বুঝা যায়।

তিন.
পাঁচ জানুয়ারি ও ত্রিশ ডিসেম্বরের দুটি বিতর্কিত নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ তাদের ভোটাধিকার হারিয়েছে। জনগণ ভোট দিতে পারেনি। দিনের ভোট রাতে হয়েছে কিন্তু দুটি নির্বাচন নিয়েই ভারতের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককেই চরমভাবে হতাশ ও বিরক্ত করেছে। ভারত বাংলাদেশের এমন একটা সরকারকে কূটনৈতিক সাপোর্ট দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে জনগণের যেখানে নুন্যতম কোনো অংশ গ্রহণ নেই। ভারত চায় না বলেই বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে এক ধরনের সম্পর্কের ইতি টেনে রেখেছে!

নিকট অতীতে ভারতের সাথে মধুর সম্পর্কের মাঝেও চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন কিনে বাংলাদেশ!বিষয়টা ভালো ভাবে নেয়নি ভারত। ভারতের এনআরসি, সিএএ, কাশ্মীর ও বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির বানানোর রাজনীতি বাংলাদেশের মানুষকেও ভাবিয়ে তুলছে। বিষয়গুলো নিয়ে কিছুটা হলেও যে বাংলাদেশ সরকারের সাথে ভারতের টানাপোড়েন চলছে এটা এখন দিবারাত্রির মত স্পষ্ট।

বাংলাদেশ ভারতকে এত পরিমাণই দিয়েছে যে ভারত বাংলাদেশকে এখন আর পাত্তাই দেয়না। এমনি এক পরিস্থিতিতে চীন আরো পাকিস্তানের কাছে যাচ্ছে। সমগ্র কাশ্মীরকে পাকিস্তানের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করে নেপালের মত পাকিস্তানও নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেছে। বিষয়গুলো ভারতকে মারাত্মকভাবে ভাবাচ্ছে।

পেছনে যে চীন কলকাঠি নাড়ছে সেটা বুঝতে খুব বেশি কিছু হওয়ার প্রয়োজন নেই। এমনি এক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাথে শেখ হাসিনার ফোনালাপ বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের সন্দেহের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। চীনে সম্প্রতি একটা বড় অংকের পণ্যের শুল্কমূক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে বাংলাদেশকে।

ভারত ২০১১ ও ২০১৫ সালে পরপর দুই বার আশ্বাস দিয়েও তিস্তার পানি বন্টনের সমস্যার এ যাবত কোনো সমাধান করেনি। এখন তিস্তার পানির সমস্যার সমাধানে ড্রেজিং ও জলাশয়ের জন্য চীন সরকার বাংলাদেশকে একশো কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে, এতেই টনক নড়েছে ভারতের! সিলেটের ওসমানী বিমান বন্দরের একটি বড় কাজ পাওয়ার জন্য ভারত ও চীনা কোম্পানি প্রতিযোগীতা করলে বাংলাদেশ সরকার কাজটি চীনা কোম্পানিকে দিয়ে দেয়।

এগুলোই মূলত ভারতের সর্বশেষ অস্বস্তির কারণ। ভারত বুঝতে পেরেছে খুব বেশি হয়ে গেল তাই একটু থামা দরকার। মোদি তাই জরুরী পররাষ্ট্র সচিব শ্রিংলাকেই বিশেষ বার্তা দিয়ে শেখ হাসিনার কাছে ঢাকায় পাঠালেন। ঘটনাটি খুব ছোট নয়। সারা বিশ্বে মহামারী চলাকালীন সময়ে এই প্রথম শেখ হাসিনা কোনো বাইরের প্রতিনিধির সাথে দেখা করলেন। বাংলাদেশ যেন চীনা করোনা ভ্যাকসিনের পরিবর্তনে ভারতের অংশীদারত্বে তৈরি অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন নেয় সেই পরামর্শও দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে।

চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভও ভারতের আতংকের নাম। ভারত চায়না বাংলাদেশ এই প্রজেক্টে যুক্ত হোক কিন্তু বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য এই প্রজেক্টের বাস্তবতা রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশ সিরিয়াসলি চীনের দিকে ঝুকে যাচ্ছে এই রকম একটা ভয়ানক আতংক ভারতের রয়েছে। ভারত বলছে মুজিববর্ষ উপলক্ষে তারা একটি স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করবে। অনেক বড় শুকানোর জন্য হালকা বেন্ডেজই কি যথেষ্ট?

মূল কথা হচ্ছে ভারত এ অঞ্চলে এক ধরনের চীন আতংকে ভোগছে। বাংলাদেশ যদি চীনা ব্লকে চলে যায় তাহলে তো ভারতের বন্ধু বলতে এ অঞ্চলে আর কিছুই থাকে না! তবে আওয়ামী লীগ সরকার অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অধিকতর চীনমুখী। এটা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান জনগণের সামনে হালকা করে দেওয়ারই হয়ত সরকারি কৌশল! সরকার জনগণকে এটাই বুঝাতে চায় যে আমরাও চীন মুখী, আমরাও কিছুটা ভারত বিরোধী! এমন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিরোধী দলগুলোর জন্য নতুন করে রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করাও একটা বড় চ্যালেঞ্জিং বিষয়।

চার.
ভারত দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এখন চীন ফোবিয়ায় (আতংক) ভোগছে। মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার দুইবার ঢাকা সফর দুটি দেশের সম্পর্কের খুব কি একটা ইতিবাচক বার্তা দেয়? এই সফর অনেক উদ্ধেগ-উৎকন্ঠার। সম্পর্কের ফাটল জোড়া লাগানোর। আমি তোমার পাশেই তো আছি সুতরাং তুমি অন্য কোথায় যাচ্ছো কেন- বাংলাদেশের প্রতি ভারতের এমন একটি মধুর বার্তা।

তবে সরকার যে তার নানামুখী টানাপোড়েনে খুব ভালো নেই ভারতের হঠাৎ তৎপর হয়ে এটাও প্রমাণ করে।বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভারত যখনই নড়াচড়া শুরু করে তখনই বুঝতে হবে সময় ও পরিস্থিতি খুব একটা স্বাভাবিক নেই। ভারতের উচিত হবে বিশেষ রাজনৈতিক দলের চেয়ে বাংলাদেশের জনগণের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগ দেয়া। বাংলাদেশে এন্টি ইন্ডিয়ান সেন্টিমেন্টকে থামাতে চাইলে ভারতকে এখনই ভাবতে হবে; না হয় অদূর ভবিষ্যতে এই দেশ নেপালের ভূমিকায় চীনের দিকে সিরিয়াসলি চলে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।