আরব আমিরাত ও ইসরাইল সম্পর্ক: মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির ভবিষ্যৎ
মধ্যপ্রাচ্যের “বিষফোঁড়া” হিসেবে খ্যাত ইসরাইলের সাথে সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের আরেক মুসলিম দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রকাশ্যে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সূচনা করে। এর মাধ্যমে এখন থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, দুইদেশের মধ্যে এমন সম্পর্ক স্থাপন বদলে দিতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপথ।
১৯৪৮ সালে আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরাইল রাষ্ট্র। ফিলিস্তিনদের অবৈধভাবে উচ্ছেদ করে সারাবিশ্ব থেকে ইহুদিদের নিয়ে এনে বসতি স্থাপন করানো হয় নবপ্রতিষ্ঠিত ইসরাইল রাষ্ট্রে। ইসরাইলের সূচনালগ্ন থেকে আরববিশ্বের সাথে ৪ টি যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধজয়, অবৈধ বসতিস্থাপন, ফিলিস্তিনিদের উপর মানবাধিকার বর্হিভূত আক্রমণের মাধ্যমে দিন দিন আকারে বড় হয়েছে ইসরাইল রাষ্ট্র। ১৯৬৭ সালের ৩য় আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের মাধ্যমে পবিত্র মসজিদ বায়তুল আকসার দখল হারায় আরব মুসলিম দেশগুলো।
ইহুদিদের দ্বারা পবিত্র মসজিদ বায়তুল আকসাতে অগ্নিসংযোগকে কেন্দ্র করে ১৯৬৯ সালের ২১ আগষ্ট ২৪ টি মুসলিম দেশ নিয়ে গঠিত হয় অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কনফারেন্স ( ওআইসি) । ওআইসির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন, ইসরাইলে আগ্রাসী ভূমিকা থেকে মুসলিম বিশ্বকে রক্ষা ও মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব রক্ষায় কাজ করে আসছে । ওআইসিভুক্ত ও বিশ্বের অধিকাংশ দেশ মনে করে, ইসরাইল একটি আগ্রাসী ও অবৈধ রাষ্ট্র। ফিলিস্তিনদের নিজস্ব ভূমিতে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে নীতিগত সমর্থন করে অধিকাংশ দেশ। সেহেতু, অধিকাংশ মুসলিম দেশের সাথে কোন প্রকার প্রকাশ্য সম্পর্ক নেই ইসরাইলের সাথে।
একদিকে, ইসরাইলের সাথে নতুন সম্পর্ককে কেন্দ্র করে নিন্দা ও ক্ষোভের মুখে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এর নিন্দা করে বলেছেন, “এটি জেরুজালেম, বায়তুল আকসা এবং ফিলিস্তিনদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা”। অন্যদিকে, ইরান ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আরব আমিরাতের এমন সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।
মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিভিন্ন সংগঠনও এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। আবার, মধ্যপ্রাচ্যের তিনদেশ মিশর, বাহরাইন ও জর্ডান সংযুক্ত আরব আমিরাতের এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, মুসলিম বিশ্বের ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের বিরুদ্ধে গিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের এমন সিদ্ধান্ত কেনো?
সংযুক্ত আরব আমিরাতের এমন সিদ্ধান্তের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে বেশকিছু বিষয় সামনে চলে আসে। প্রথমত, সৌদি নেতৃত্বের জোটের অন্যান্য দেশের মতো সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যতম প্রতিপক্ষ ইরান। বিগত ২ দশকে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান তার প্রভাবপ্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেছে বহুগুণ। পরমাণু ইস্যুতে দীর্ঘ মার্কিন জোটের অবরোধের পরও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সফলভাবে ইরান তার মিত্রদের ক্ষমতার বসিয়ে রাখতে পেরেছে। যা, সৌদি নেতৃত্বের জোটভুক্ত দেশগুলোর জন্য বড় চিন্তার কারণ।
ইরান নিয়ন্ত্রিত হরমুজ প্রণালি ব্যবহার করে সংযুক্ত আরব আমিরাত সহ অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলো জ্বালানি তেল বহিঃবিশ্বে রপ্তানি করে। উপসাগরীয় অন্যান্য দেশগুলোর মতো সংযুক্ত আরব আমিরাতও নিজস্ব জ্বালানি তেল পরিবহন নিয়ে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে। অন্যদিকে, ইসরাইলের সাথে ইরানের রয়েছে দীর্ঘদিনের শত্রুতা। ফলশ্রুতিতে, ইরানের বড় শত্রু ইসরাইলের সাথে মিত্রতা তৈরি করে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব কমানোর চেষ্টা করতে পারে সংযুক্ত আরব আমিরাত।
দ্বিতীয়ত, ২০১১ সালের আরব বসন্তে হাওয়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের গায়েও লেগেছিলো। গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা ও শাসনব্যবস্থা পরির্বতনের দাবি উঠেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত সহ আরববিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে। ফলে, আরব আমিরাতভুক্ত শাসক রাজপরিবারগুলোর মধ্যে নিজেদের ক্ষমতা ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে এক ধরণের ভয়ের সৃষ্টি হয়। যার ফলশ্রুতিতে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক আরো বৃদ্ধি করতে থাকে আরব আমিরাত।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে রয়েছে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি এবং দেশটি পশ্চিমা দেশগুলোর অন্যতম বৃহৎ অস্ত্রক্রেতা। পশ্চিমা দেশগুলোর অন্যতম বড় মিত্র ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে পশ্চিমাদের সাথে নিজেদের সম্পর্ককে আরো বৃদ্ধি করতে পারবে সংযুক্ত আরব আমিরাত।
তৃতীয়ত্ব, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন পরাশক্তি হিসেবে তুরস্ক তার প্রভাবপ্রতিপত্তি বৃদ্ধি করছে খুব দ্রুতগতিতে। লিবিয়া সরকারব্যবস্থা, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ও ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ ইস্যুগুলোতে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও তুরস্কের অবস্থান ছিলো পরস্পর বিরোধী। অন্যদিকে, তুরস্কের সাথে ইরানের মিত্রতার সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে বিগত বছরগুলোর থেকে বহুগুণ। ফলশ্রুতিতে, আরব আমিরাতের শাসকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তুরস্ক ভীতি। অন্যদিকে, ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে তুরস্কের সাথে ইসরাইলের বর্তমান সম্পর্ক বেশ শীতল। ফলশ্রুতিতে, তুরস্কের প্রভাব বলয় থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে ইসরাইল ছাড়া অন্যকোন বিকল্প নেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের শাসকদের সামনে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইলের এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ হিসেবে উভয় দেশের পক্ষ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্য বলে প্রচার করা হলেও বাস্তবে কতটুকু শান্তি বয়ে আনবে তা নিয়ে বেশ সন্দেহ রয়েছ। প্রথমত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের সম্পর্ক স্থাপনের যুক্তি হিসেবে ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীরে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপন বন্ধের কথা বলা হলেও ইসরাইলের তরফ থেকে পরিষ্কার করে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন," তারা পশ্চিমতীর দখলের আপাদত স্থগিত রাখবেন, তবে তা বাতিল করা হবে না। "
ফলশ্রুতিতে, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইলের মধ্যকার শান্তিচুক্তি কেবলই দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের জন্য। এতে ফিলিস্তিনদের কোন লাভই হবে না। বরং ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আরবদেশগুলোর সমর্থন আরো দুর্বল হলো। ইসরাইল এ দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ফিলিস্তিনের উপর চড়াও হতে পারে। ভণ্ডুল হতে পারে স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন।
দ্বিতীয়ত, ইরান ও তুরস্ক সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইসরাইলের মধ্যকার সম্পর্ক মেনে নিতে চাইবে না। সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপর তুরস্ক ও ইরানের যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ইসরাইল, সৌদি জোট এবং পশ্চিমা দেশগুলো মোটেই বসে থাকবে না। ফলশ্রুতিতে যেকোনো সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।
অন্যদিকে, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইলের নয়া বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন সৌদি জোটভুক্ত অন্যান্যদেশগুলোর উপর প্রভাব ফেলবে। অন্যান্য দেশগুলোও চাইবে ইসরাইলে সাথে কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে। এতে করে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের প্রভাবপ্রতিপত্তি আরো বৃদ্ধি পাবে। ইসরাইলের এমন প্রভাবপ্রতিপত্তি বৃদ্ধি মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি আলোচনা ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
তৃতীয়ত্ব, মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও তুরস্কের প্রভাব কমানোর জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের এমন সিদ্ধান্ত হলেও তাতে তারা কতটুকু সফল হবে সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। প্রথমত, সংযুক্ত আরব আমিরাতের এমন সিদ্ধান্তের কারণে মুসলিম বিশ্বে তুরস্ক ও ইরানের প্রভাব আরো বৃদ্ধি করবে। ফিলিস্তিন, কাতার, ইয়েমেন, সিরিয়া, লেবানন মতো ইসরাইল বিরোধী দেশগুলো আরো বেশি তুরস্ক ও ইরানের বলয়ে চলে আসবে। তাছাড়া, দেশের শাসকগোষ্ঠীর এমন সিদ্ধান্ত আরব আমিরাতের সাধারণ মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের কাছে সৌদি আরব নেতৃত্বের জোটের গ্রহণযোগ্যতা কমে আসবে। ফিলিস্তিনদের কাছে তুরস্ক ও ইরানের গ্রহণযোগ্যতা এ পরিস্থিতিতে আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।
চতুর্থত, মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিশাল একটি প্রভাব রয়েছে। কিন্তু দেশটির এ সিদ্ধান্ত অধিকাংশ মুসলিম দেশ ভালোভাবে নিবে না। এতে করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রভাব মুসলিম বিশ্বের মধ্যে কমে আসতে পারে। মুসলিম বিশ্বের মধ্যকার ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের উপর সংযুক্ত আরব আমিরাতের এমন সিদ্ধান্ত বিরাট প্রভাব ফেলবে মনে করেন অধিকাংশ আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক।
লেখক: শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।