বঙ্গবন্ধু ও তাঁর বৈদেশিক নীতি
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে জেল খেটেছেন, জুলুমের শিকার হয়েছেন, ফাঁসির আদেশ মাথা পেতে নিয়েছেন কিন্তু কখনো অধিকার আদায়ের পথে দমে যাননি। তাঁর সুদক্ষ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে আমরা অর্জন করেছি আমাদের প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু একজন সফল রাষ্ট্রনায়কের মতো গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি। ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ এ নীতির উপর বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি পরিচালিত করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, কখনো যুদ্ধ ও বৈরিতা দিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তৎকালীন সময়ের দুই পরাশক্তি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার বৈরিতা গোটা পৃথিবীকে দুইভাগে বিভক্ত করেছিলো। বিভক্ত পৃথিবীর সামনে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুই পরাশক্তির অধীনের জোটে অংশ না দিয়ে যোগ দেন জোট নিরেপক্ষ আন্দোলনে (NAM)। স্বাধীনতার দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ যোগ দেয় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা (IMF), জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থায় (UNESCO)। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৫তম সদস্যদেশ হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে গোটা পৃথিবীর সামনে বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুর চিন্তাভাবনা ছিল সূদূরপ্রসারী। ১৯৭২ সালে জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেন। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা পরিচালিত করেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৭২ সালের মধ্যে ৬০টিও বেশি দেশের স্বীকৃতি এবং ১৯৭৫ সালে মর্মান্তিক মৃত্যুর আগে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের পাশাপাশি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা ও ঋণ সংগ্রহের চেষ্টা চালান। স্বল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর পরাশক্তিশালী দেশগুলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা ও ঋণ নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ায়। যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৈদেশিক নীতির অন্যতম বড় সাফল্য।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সরকার ও ভারতীয় জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং অসহায় বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। অকৃত্রিম ও উদার বন্ধুত্বের পরিচয় দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের এ অবদানকে মনে রেখেছিলেন। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানি জেলখানা থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই তিনি ভারত সফর করেন। এ সফর বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিকভাবে সূদূরপ্রসারী ছিলো। বঙ্গবন্ধু এ সফরের মাধ্যমে ভারতকে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহায্যদানের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গঠনে ভারতের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন।
১৯৭২ সালে ১৯ শে মার্চ দুইদেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে স্বাক্ষরিত হয় ২৫ বছর মেয়াদি ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী ও শান্তি চুক্তি’। ১২টি অনুচ্ছেদ বিশিষ্ট চুক্তিপত্রে বাংলাদেশের পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের পক্ষে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী স্বাক্ষর করেন। চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের নতুন যুগের সূচনা হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী মিত্রবাহিনীর অধীনে দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের ভিতরে অবস্থান করছিলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থানকে কেন্দ্র করে স্বাধীন দেশ হিসেবে বহিঃবিশ্বে স্বীকৃতি আদায়ের পথে বাধা ও বিভিন্ন গুজব সৃষ্টির কারণ হিসেবে বিবেচিত করেন। সেজন্য তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনা করে ১৯৭২ সালের ২৬ শে মার্চের পূর্বেই ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশ ত্যাগ নিশ্চিত করেন। ভারতীয় বাহিনীর শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ ত্যাগ ছিলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বৈদেশিক নীতির অন্যতম বড় বিজয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে বেশকিছু মুসলিম ও আরবদেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং পাকিস্তানকে সাহায্য- সহযোগিতা প্রদান করে। যার ফলে, মুসলিম বিশ্বের মধ্যে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি ও সমর্থন আদায় বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাঈল যুদ্ধে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে আরবদেশগুলোর পক্ষে অবস্থান করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ নির্দেশে সিনাই উপত্যকায় মিশরীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যে একটি মেডিকেল টিম ও ঔষুধ এবং চা উপহার হিসেবে প্রেরণ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও বন্ধুত্বসুলভ মনোভাবের জন্যই পরর্বতীতে মিশর, সিরিয়া, জর্ডান, আলজেরিয়া, ইরাক বাংলাদেশকে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসির) সদস্যলাভের সাহায্য করেছিল। ১৯৭৪ সালে ১৫ ফ্রেবুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ওআইসির দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ ৩২তম সদস্য দেশ হিসেবে অংশ নেয়। বিভিন্ন মুসলিম দেশের চাপে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। পাশাপাশি, বঙ্গবন্ধু ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও ইসরাইলের সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক না রাখার সিদ্ধান্ত মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থানকে করেছিল উজ্জল।
কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ব্যাহত হয় বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলাদেশ গড়ার পথচলা। কতিপয় বিপদগামী সদস্যের গুলিতে প্রাণ হারান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিউবান অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় পর্বতমালা দেখিনি, কিন্তু আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি’।
লেখক: শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেল: fahad.hossain.ridoy@gmail.com