করোনায় ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের হালচাল
বর্তমান সময়ে চ্যালেঞ্জিং আর সম্মানজনক পেশার মধ্যে সাংবাদিকতা অন্যতম। বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের জানার আগ্রহ আর কৌতুহলী মনোভাবের কারণে দিনকে দিন সাংবাদিকতার পরিধি ব্যাপক আকারে বিস্তৃত হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছেও সমানতালে বৃদ্ধি পেয়েছে সাংবাদিকতা বা রিপোর্টিং কার্যক্রম। যার অধিকাংশেরই হাতেখড়ি হচ্ছে স্ব স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তথা ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার মাধ্যমে।
ক্যাম্পাস সাংবাদিকতাকে বলা হয় সাংবাদিকতার আঁতুড়ঘর। ক্যাম্পাসে নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের অঙ্গনে ঘটে যাওয়া ঘটনা বা ঘটনা প্রবাহ বস্তুনিষ্ঠতার সাথে জাতির সম্মুখে তুলে ধরেন ক্যাম্পাস সাংবাদিকরা। ক্যাম্পাসের প্রত্যহ নানাবিধ কার্যক্রমের রিপোর্ট তৈরি করা, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার, ফিচার লেখা, প্রশিক্ষণ কর্মশালা কিংবা সাংগঠনিক কার্যক্রম সহ নানাবিধ ব্যস্ততায় মুখরিত সময় কাটান ক্যাম্পাসে দায়িত্বরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিগণ। এমন ব্যস্ততা মুখর দিনই দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবেই গন্য করেন ক্যাম্পাস সাংবাদিকেরা।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি অন্য সময়ের চেয়ে ঢের আলাদা। যেখানে ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের প্রতিটি দিন কাটতো ব্যস্ততা আর কর্মমুখরতায় সেখানে এখন বাঁধ সেধেছে করোনা ভাইরাস। করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে গত প্রায় পাঁচ মাস ধরেই বন্ধ রয়েছে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিশ্বিবদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্যাম্পাস সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী। যারা প্রত্যহ ক্যাম্পাসের নানান খবর তুলে ধরছেন গণ মানুষের চোখের সামনে। করোনাকালে ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের হালচাল জানাচ্ছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি মো. রাকিবুল হাসান তামিম—
মহিউদ্দিন মাহি
ঢাবি প্রতিনিধি, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)
সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি
যারা ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা করেন তাদের আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারণী জায়গাগুলোতে শিক্ষার্থীদের অধিকার এবং সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে লেখালেখির মাধ্যমে অনেক অবদান রাখার সুযোগ থাকে। অর্থ্যাৎ যখনই বিশ্ববিদ্যালয় কোন বিষয় নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে অথবা কোনো সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সাথে তখন যদি শিক্ষার্থীদের মতামত বা বাস্তব চিত্রটা সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরা হয় তাহলে উভয় পক্ষের জন্যই ভালো হয়।
কিন্তু এই করোনাকালে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা অনেকটাই প্রেসরিলিজ এবং বাইট নির্ভর হয়ে যাওয়াতে অনলাইন ক্লাস নিয়ে বৈষম্যসহ অনেক অসংগতি দেখা গেলেও সেগুলো যথাযথভাবে গণমাধ্যমে তুলে ধরা যাচ্ছে না। ক্যাম্পাসের ব্যস্ত সময়গুলোকে অনেক মিস করি। বেলা শেষে সবার একটু বিশ্রামের সুযোগ থাকলেও আমরা ক্যাম্পাস সাংবাদিকরা ছুটতাম খবরের পেছনের খবর বের করতে। কিন্তু এখন সময়টা একটু ভিন্নভাবেই কাটছে। তবে প্রত্যাশা করি, সহসাই ফিরে আসুক স্বস্তির নিঃশ্বাস। আবার একত্রিত হই প্রাণের প্রাঙ্গনে। কর্মব্যস্ততায় মুখরিত হোক প্রতিটি ক্ষণ।
জান্নাতুল ফেরদৌস
কুবি প্রতিনিধি, দৈনিক ইত্তেফাক
কার্যনির্বাহী সদস্য, কুুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি
একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার সুবাদে সচরাচর ব্যস্ত থাকতে হয়। করোনা সংকটের ফলে ক্যাম্পাস প্রায় পাঁচমাস ধরে বন্ধ। ক্যাম্পাসে ক্লাসের ফাঁকে সময় করে নিতাম সংবাদ সংগ্রহ কিংবা তা যাচাই-বাছাই আর পরিমার্জনের পর প্রস্তুত করে পাঠানোর জন্য। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন নিউজ থাকতো। আবার ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের কিছু সাংগঠনিক ব্যস্ততাও থাকে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালা, দক্ষতা উন্নয়ন মূলক ওয়ার্কশপ, আলোচনা সভায় প্রায়শই অংশগ্রহণ করা হতো। যা একপ্রকার দৈনন্দিক কাজই ছিলো।
কিন্তু এখন ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় সেসব হচ্ছেনা, সরাসরি সংবাদ সংগ্রহও করতে পারছি না। তবে এখনো যে আমরা হাতগুটিয়ে বসে আছি তা নয়! ক্যাম্পাসের যেকোন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঘরে বসেই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পৌঁছে দিচ্ছি পাঠকের দোরগোড়ায়। এক্ষেত্রে ফোনে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বারবার তথ্যের সঠিকতা যাচাই করে নিতে হচ্ছে।
এছাড়াও করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখছে ক্যাম্পাস সাংবাদিকরা। পরিস্থিতি কখন স্বাভাবিক হবে সেটা কেউ বলতে পারছে না। অবসর এই সময়ে নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ে দেশের ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছি। এত দীর্ঘ সময় ক্যাম্পাস কখনোই বন্ধ থাকেনা। এই সময়টাতে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছি। অনলাইনে বিভিন্ন কোর্সের মাধ্যমে জানা ও শেখার চর্চা অব্যাহত রাখছি।
এছাড়া অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়েছে। বাস্তবিক অর্থে ক্যাম্পাসের ব্যস্ত দিনগুলোতেই খুব তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে। খুব দ্রুত সবকিছু ঠিক হোক এটাই চাওয়া। আবার ক্যাম্পাসে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করতে চাই। সাংগঠনিক ব্যস্ততায় বিভোর থাকতে চাই। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে নেমে আসুক শান্তির সুবাতাস। আবারো ফিরে আসি প্রিয় ক্যাম্পাসে।
নাহিদ সাব্বির
ডিসি প্রতিনিধি, জাগো নিউজ
সহ প্রচার সম্পাদক, ঢাকা কলেজ সাংবাদিক সমিতি
উচ্চশিক্ষার এই জীবনে এত দীর্ঘ সময় পরিবারের সাথে থাকা এটাই প্রথম। করোনার এই সময়ে গোটা বিশ্ব থমকে আছে, বন্ধ রয়েছে দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ও। ক্যাম্পাসে প্রবেশের পর থেকেই যুক্ত হই সাংবাদিকতার সাথে। নিয়মিত ক্লাস, পরীক্ষার পাশাপাশি খরবের পেছনে প্রতিনিয়ত ছুটে চলছি। মোটকথা ক্যাম্পাসে থাকাকালীন সময়টা কাটতো বেশ ব্যস্ততায়।
করোনার প্রভাবে সেই ব্যস্ততা এখন আর নেই। তবে ক্যাম্পাসে না থাকলেও সাংবাদিকতা থেমে নেই। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি চলছেই। এক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতার গুরুত্ব অনেক বেশী৷ করেনা আমাদের শিখিয়েছে ক্যাম্পাসে না থেকেও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ কিভাবে প্রচার কারা যায়। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছি ঢাকা কলেজ সাংবাদিক সমিতির যারা এখনো ক্যাম্পাসের আশেপাশে আছেন তাদের।
করোনাকালীন এই সময়ে ঘরে বসেই সময় কাটছে৷ নিয়মিত বই পড়া, টেলিভিশন দেখা আর অনলাইনে পত্রিকা পড়া এভাবেই কাটে সারাটা দিন। তবে আশাবাদী এই অন্ধকার একদিন কেটে যাবে, আলো আসবে ৷ প্রানের স্পন্দনে প্রস্ফুটিত হবে প্রতিটি ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাস সাংবাদিকতাও ফিরে পাবে তার প্রান ৷ আবারো ক্যাম্পাসে পার করবো ব্যস্ত সময়। সেই প্রত্যাশায় অপেক্ষার প্রহর গুনে চলেছি অবিরাম।
তিতলি দাস
জাককানইবি প্রতিনিধি, দৈনিক খোলা কাগজ
সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাব
সকল ক্যাম্পাসে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত ক্যাম্পাস সাংবাদিকরা গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে অনিবার্য একটি দায়িত্বশীলতার পরিচয় বহন করে, সেটি ক্যাম্পাসে থাকাকালে তো বটেই ছুটিতে থাকলেও নিজের ভূমিকা পালন করতে মোটেও অসুবিধা নেই।
এই করোনা মহামারিতে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, অস্বচ্ছলদের সুবিধা আদায় হতে কলম ধরা ও আহবান করা এসকল বার্তা কর্তৃপক্ষকে অবহিতকরণ কাজগুলো ক্যাম্পাস সাংবাদিক যেখানেই থাকুক দায়িত্বের জায়গা থেকে করতে বদ্ধপরিকর থাকে। প্রতিনিয়ত আমরাও সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাওয়া থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টিগোচরে আনার চেষ্টা করি।
নিত্যদিনের ক্লাস, পরীক্ষা, টিউশনি, নিজের পড়াশোনার পরও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভাবনা নিয়ে কাজ করাটা দারুণভাবে উপভোগ করি। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় যদিও থেমে নেই কাজ তবুও ক্যাম্পাসের ব্যস্ত সে সময়গুলো খুব মনে পড়ে। প্রত্যাশা করি যেন খুব দ্রুতই ফিরতে পারি সেই কর্মব্যস্ত সময়গুলোতে।
মামুন সোহাগ
জিটিসি প্রতিনিধি, রাইজিং বিডি
সদস্য, তিতুমীর কলেজ সাংবাদিক সমিতি
সাংবাদিকতা একটি সম্মানজনক ও চ্যালেঞ্জিং পেশা। একটা সময় মনে করা হতো সাংবাদিকতা একটা নির্দিষ্ট গন্ডিতে আবদ্ধ। কিন্তু বর্তমান সময়ে সে ধারণা নিছক ভুল ছাড়া কিছু নয়। সাংবাদিকতার আবদ্ধ গন্ডি ভেঙ্গে বিস্তৃত হয়েছে অনেকরূপে। এসব বিস্তৃত বিষয়গুলোর মধ্যে ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা অন্যতম। বর্তমান সময়ে তরুণ প্রজন্মের নিকট ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা অনেক জনপ্রিয়।
করোনা ভাইসের কারণে ক্যাম্পাস-হল বন্ধ থাকলেও ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা থেমে নেই। যদিও অনেক ক্যাম্পাস রিপোর্টার বাড়িতে অবস্থান করছে তারপরও ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সকল সংবাদ বাড়িতে বসেই পাঠাতে হয়। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো সিদ্ধান্তের সংবাদ হলে প্রেস রিলিজ থেকে সংবাদ করতে হচ্ছে। ক্যাম্পাসে কাটানো দীর্ঘদিনের কর্মব্যস্ত আর সংবাদ মুখর সময়গুলো এখন কেবলই স্মৃতি। লকডাউনের কারণে ছুটির প্রথমেই চলে আসি গ্রামের বাড়িতে। গ্রামে এসেই লাগাতারভাবে কাজ করছি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক হয়ে। কখনো মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছাচ্ছি, কখনো বা করছি সতর্ক। এইতো, করোনায় চলছে নতুন জীবন, ব্যতিক্রমী অভ্যেস।
খাদিজা খাতুন স্বপ্না
সাব প্রতিনিধি, দৈনিক অধিকার
সদস্য, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক ফোরাম
করোনা কালীন সময়ে ক্যাম্পাসে না থেকেও প্রতিনিয়তই বিভিন্ন মাধ্যম অথবা মুঠোফোনে তথ্য সংগ্রহ করে ক্যাম্পাসের সকল খবর তুলে ধরছি। বরাবরের চেয়ে এটি অন্য রকম অভিজ্ঞতা। তবে আমি মনে করছি এই বন্ধকালীন সময় আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। যেহেতু অন্যান্য ব্যস্ততা মোটেই নেই তাই লেখালেখির চর্চাটা বেশ ঝালিয়ে নেয়ার সুযোগ হয়েছে। সেইসাথে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন, বিভিন্ন ফলোআপ রিপোর্ট পড়ার মাধ্যমে নিজের জ্ঞানগত যোগ্যতাও বৃদ্ধি করার সুযোগ পাচ্ছি।
তবে ক্যাম্পাসের সাংবাদিক কমিতির সাংগঠনিক কার্যক্রম খুব মিস করি।যদিও অনলাইন মিটিং এর বদৌলতে দূরে দূরে থেকেও সবাই খুব কাছাকাছি আছি বলেই মনে হচ্ছে। আমি মনে করি ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা ক্যাম্পাসের প্রাণ। ক্যাম্পাসে সাংবাদিকতার হাতেখড়ির মাধ্যমে দক্ষ আর যোগ্য লেখনী দিয়েই পরবর্তী সময়ের পূর্ণ সাংবাদিকতায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করা যায়। তাই বলি ক্যাম্পাস সাংবাদিকতা আমাদের জন্য আশীর্বাদ। প্রত্যাশা করি, সবকিছু আবার আগের মতো স্বাভাবিক হবে।আবার ফিরবো ক্যাম্পাসে। আবারো ফিরে পাবো কর্মব্যস্ত সেসব মুহূর্ত।