০৬ আগস্ট ২০২০, ১৮:৫৭

রাম মন্দির: প্রশ্নের মুখে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা   

এক.
বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করলেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি রাম মন্দিরের কাজ শুরুর জন্য এমন একটি দিনকেই বেঁচে নিলেন যেদিন (আগস্ট, ২০১৯) ভারতীয় সংবিধানে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সংক্রান্ত ৩৭০ এবং ৩৫এ (এ) ধারা বাতিল করে কাশ্মীরকে ভেঙ্গে দুই টুকরো করে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ নামে দুটো প্রশাসনিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হয়। যে সিদ্ধান্ত কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামীদের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সাথে কাশ্মীরের পার্থক্য স্পষ্ট করে দিত ৩৭০ ধারা। এই ধারা বলেই কাশ্মীরের নিজস্ব সংবিধান, আইন ও পতাকা ছিল। ৩৫এ (এ) ধারায় ছিল কাশ্মীরের জনগণের শিক্ষা, চাকরি ও ভূমির বিশেষ অধিকার।আগে কাশ্মীরে কোনো ভারতীয় জমি কিনতে পারতো না যা এখন খুব সহজেই সম্ভব। মোদি কাশ্মীরে ভারতীয়দের পেনিট্রেশন করে কাশ্মীরের মূল জনমিতির পরিবর্তন ঘটিয়ে মূলত স্বাধীনতার স্পিরিটকে ধ্বংস করতেই ভারতীয় সংবিধানের উল্লেখযোগ্য দুটি ধারা বাতিল করে বর্তমানে কাশ্মীরকে ভেঙ্গে দুটো ভারতীয় কলোনি বানিয়ে রেখেছে।এক কোটি মানুষের জন্য আট কোটি সেনাসদস্য মোতায়েন (দি ডন) করে রেখেছে কাশ্মীরে! কল্পনা করা যায় পৃথিবীর কত ভয়ংকর মিলিটারাইজড জোন কাশ্মীর? সারা পৃথিবী ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে লকডাউন শব্দের সাথে করোনা মহামারীর জন্য পরিচিত হলেও কাশ্মীরের মানুষের জীবনের সাথে কার্ফু, লকডাউন খুব কমন বিষয়। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। টুরিজমকেন্দ্রিক অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধ্বংশের পথে। বাড়ছে বেকারত্ব, বাড়ছে বিদ্রোহ, বাড়ছে তরুণদের মধ্যে ঘৃণা। কাশ্মীরে চলছে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ইন্টারনেট লকডাউন।যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে।

দুই.
সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় ইন্ডিয়া ইন্ডিপেনডেন্ট এক্ট অনুযায়ী ব্রিটিশরা কাশ্মীরকে হয় স্বাধীন থাকা অথবা ভারত পাকিস্তানের যেকোনো একটি দেশের সাথে মিশে যাওয়ার অধিকার দিয়েছিল। সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমান জনগণ স্বাধীন থাকতে চাইলেও কাশ্মীরের হিন্দু রাজা হরিসিং নেহেরুর সাথেই হাত মেলালেন।কাশ্মীরের স্বাধীনতার কবর দিলেন। যার পরিনতি সত্তর বছর যাবত আজো ভোগতে হচ্ছে কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষকেই। কাশ্মীর নিয়েই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে একাধিক বার যুদ্ধ হলো। নিজ দেশেই কাশ্মীরীরা আজ পরবাসী। স্বাধীনতাকামীদের জঙ্গি ট্যাগ লাগিয়ে বিগত কয়েক বছরে দশ হাজার লোককে গুম করা হয়েছে। যারা বেঁচে আছে নাকি মরে গেল তা কেউ জানেনা। যে কাশ্মীরের স্বাধীনতামীদের উপর ভারত এত নিপীড়ন নির্যাতন চালিয়েছে তারাই কেন অতীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য আশ্রয়, অস্ত্র ও সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে সহযোগিতা করেছে- সেই প্রশ্নও আল জাজিরায় এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী রায় রেখেছেন।

কাশ্মীরকে দুই টুকরো করে মোদি ইন্ডিয়ান সেকুলারিজমের যে যাত্রায় অংশ নিলেন, পথে পথে সেখানে দেখা মিলবে বিভক্তি, বিভাজন আর অবিশ্বাসের রাজনীতি। বলা হয়েছিল ৩৭০ ধারা বাতিলের ফলে কাশ্মীরে উন্নয়ন ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। কিন্তু কী হল? কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের এক বছর পূর্ণ হলো ৫ অগাস্ট কিন্তু কী পেল ভারত, কী পেল কাশ্মীর? কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামীদের লাশও ছিনতাই করে নিয়ে যায় সামরিক বাহিনীর লোকেরা। কারণ এসব জানাজায় হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়। যেখানে নতুন করে শপথ নেয় লড়াই করার। ২০১৬ সালে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী বুরহান ওয়ানীর মৃত্যুেকে কেন্দ্র করে তো পুরো কাশ্মীর উপত্যকায় তরুণরা নতুন করেই জেগে উঠেছিল। কাশ্মীর ভেঙ্গে দুটুকরো করেই কান্ত হয়নি মোদি। গ্রেফতার করেছে কাশ্মীরের সাবেক তিন মুখ্যমন্ত্রী অমর আব্দুল্লাহ, ফারুক আব্দুল্লাহ ও মেহবুবা মুফতিকে। বাদ যায়নি আলোচিত তরুণ রাজনীতিবিদ শাহ ফয়সাল ও শেহলা রশিদরাও। এক বছরে কয়েক হাজার কাশ্মীরীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাখা হয়েছে দূরবর্তী প্রদেশের কারাগারে। যাতে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে না পারে। কাশ্মীর দুটুকরো হওয়ায় কাশ্মীরীদের অর্জন নির্যাতনের আর নিপীড়নের বাইরে কিছু নয়! নেপাল ভারতের বিতর্কিত ভূমি নিয়ে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করছে, পাকিস্তানও সম্প্রতি পুরো কাশ্মীরকে তার নিজ দেশের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করেছে।চীন গালওয়ান ভ্যালিতে সরাসরি ভারতের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়েছে- এসব সব ঘটনার সাথেই একটা ইন্টারকানেকশন আছে। ভারত কী আসলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অক্ষম নাকি তার গণতান্ত্রিক চরিত্রই হারিয়েছে? সেই প্রশ্নও উঠছে জোরে সুরে!

তিন.
ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি এমন একটি ধর্মীয় কট্টরপন্থী হিন্দু মৌলবাদী রাজনৈতিক দল যারা ভারতকে রামরাজত্ব বানাতে চায়।বিজেপির মূল সংগঠন আরএসএসের রেডিকেল সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথে নতুন করে পরিচয় করানোর প্রয়োজন নেই। নরেন্দ্র মোদি তার রাজনৈতিক আত্মজীবনী ‘এ পলিটিকাল বায়োগ্রাফি’তে লিখেছেন, তিনি মাত্র আট বছর বয়সেই আরএসএসে যোগ দেওয়ার জন্য ঘর ছেড়ে ছিলেন। সুতরাং আরএসএসের মিশন আর ভিশনই যে মোদির লক্ষ্য তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। সমস্যা হল ভারতকে সারা দুনিয়ায় বৃহত্তর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে এতদিন ব্রান্ডিং করা হলেও গণতান্ত্রিক চরিত্র হারানোর সে যাত্রায় মোদিই বোধহয় শেষ পেরেকটি টুকে দিচ্ছেন, তবে শুধুমাত্র বিজেপি কিংবা মোদি মানেই ভারত নয়। এনআরসি আর সিএএ-এর বিরুদ্ধে সারা ভারতে তুমুল প্রতিবাদ হয়েছে। ভারতের প্রতিটি প্রদেশেই এনআরসি ও সিএএ বিরোধী দিল্লির শাহিনবাগের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচীর আদলে গণআন্দোলন হয়েছে। মানুষ সে আন্দোলনে শতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেছে, অবশেষে দিল্লিতে এক নারকীয় তান্ডবের মাধ্যমে সেই লড়াইকেও থামিয়ে দেয়া হয়েছে। সারা বিশ্বে মোদির নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও প্রতিবাদের যে ঢেউ বয়ে গিয়েছিল সেটা ছিল এমন একটা বার্তা সেখানে উগ্রবাদ ও বিভাজনের রাজনীতির কোনো সমর্থন ছিল না। আসাম থেকে এনআরসির নামে প্রায় বিশ লাখ বাঙ্গালিকে বাংলাদেশকে ফেরত পাঠানোর দাবী তুললো মোদি সরকার। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসও এনআরসি- সিএএ এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামলো। কলকাতায়ও দিল্লির শাহিনবাগের মত প্রতিবাদ হল কিন্তু মোদি থামলেন না।

সিটিজেনশিপ এমেন্ডমেন্ট এক্টের (সিএএ) এর মাধ্যমে মোদি সরকার বাংলাদেশ,পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের নাগরিকদের ভারতে বসবাসরত অবস্থায় নাগরিক হওয়ার জন্য কিছু পূর্ব শর্ত জুড়ে দেয় যার অন্যতম হচ্ছে মুসলিমরা নাগরিকত্ব পাবেনা তবে অন্যান্য সংখ্যা লঘুরা পাবে! যারা যুগের পর যুগ ভারতে বসবাস করছে, ভারতের আলো বাতাসে বড় হচ্ছে শুধু মাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তারা নাগরিকত্ব পাবে না! এক বিংশ শতাব্দীর এই সভ্য দুনিয়ায় এটা কল্পনা করা যায়? কেউ কেউ এ লেখা পড়ে বিরক্তও হতে পারেন এজন্য যে বাংলাদেশেই তো সমস্যার শেষ নেই, আমি কেন মোদির সমালোচনায়, ভারত সরকারের সমালোচনায় মুখর? বাংলাদেশ এখন ভূরাজনৈতিক ভাবে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে তার রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে চাইলে ভারতের রাজনৈতিক গতিপথের দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব অস্বীকারের সুযোগ কোথায়? সেটা ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ক্ষেত্রেই। বহুধাবিভক্ত একটি সমাজ হিসাবে ভিন্ন মত পথ ধর্ম সংস্কৃতি ভাষাকে সঙ্গী করে একটি বৃহত্তর গণতান্ত্রিক সেকুলার রাষ্ট্র হিসেবে কিছু সীমাবদ্ধতার পরেও ভারত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে জায়গা তৈরি করেছিল মোদি সরকার যে তার সম্পূর্ণ বিপরীতে মেরুতে হাটছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। রাম মন্দির তার বাস্তব উদাহরণ। কারণ একটা মসজিদ ভেঙ্গে একটি মন্দির বানানোর রাজনীতি একশো কোটি জনগণের মধ্যে প্রায় ত্রিশ কোটি মসুলমানকে কতটা আহত করতে পারে সেটা একটা সরকারের অবশ্যই ভাবনার বিষয় হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে উল্টো!

চার.
চলুন সেখানে শুরু করেছিলাম সেই বাবরি মসজিদে ফিরে যাই।গত বছর ৫আগস্ট মোদি সরকার কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার সংক্রান্ত ৩৭০ ধারা ভারতীয় সংবিধান থেকে বাতিল করেছিলেন। সেই ক্ষত শুকানোর আগেই ঠিক এক বছর পর একই দিনে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করলেন মোদি।কেউ কেউ এ প্রশ্নও তুলতে পারেন যে এরদোয়ান আয়া সোফিয়াকে মসজিদ বানাতে পারলে মোদি কেন বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির বানাতে পারবেন না? এই প্রশ্নের উত্তর একটাই এদুটো ঘটনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১৫২৮ সালে মুঘল সম্রাট জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবরের সেনাপতি মীর তাকি ভারতের উত্তরপ্রদেশের (যে প্রদেশে দেওবন্দ মাদ্রাসা) ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। যা বাবরি মসজিদ নামে পরিচিত। হিন্দুরা মনে করে বাবরি মসজিদের জায়গাটি রামের জন্মভূমি। এখান থেকেই শুরু হয় হিন্দু মুসলমানের দ্বন্দ্ব।

১৮৫৩ সালে প্রথম বারের মতো হিন্দু -মুসলমানের মধ্যে বাবরি মসজিদ নিয়ে সহিংসতা দেখা দিলে মসজিদের বেস্টনীর ভেতরে মুসলমান আর বাইরে হিন্দুদের ধর্মীয় বিষয় পালনের সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে মসজিদের ভেতরে রামের মূর্তি বসালে শুরু হয় নতুন সংকট, এক মামলার রায়ে মসজিদটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৮৪ সালে বিজেপি নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানি ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতৃত্বে বাবরি মসজিদের জায়গায় মন্দির বানানোর লক্ষ্যে এক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। হিন্দুত্ববাদকে কেন্দ্র করে বিজেপির যে রাজনৈতিক উত্থান সেখানে বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির বানানোর ঘটনা একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। অবশেষে ১৯৯২ সালে ৬ ডিসেম্বর সভ্য দুনিয়ার চোখে একরাশ ঘৃণার জন্ম দিয়ে একশ্রেণির কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা বাবরি মসজিদের মিনারে শাবল চালায়।যার নেতৃত্বে ছিল বিজেপি, আরএসএস এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মীরা। বাবরি মসজিদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গায় প্রাণ হাড়িয়েছে কয়েক হাজার মানুষ।মুসলিম বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ভারতের প্রতিবেশি মুসলমান রাষ্ট্রগুলোর উপর এই ঘটনার প্রভাব পড়েছে।

বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার তদন্তের জন্য যে লিবারহাম কমিশন গঠিত হয়েছিল সেখানেও স্পষ্টভাবে বিজেপিকে মসজিদ ভাঙ্গার জন্য বিজেপিকেই দায়ী করা হয়। কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এক বিতর্কিত রায়ে বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণের পক্ষেই রায় হয়। মুসলমানদের অন্য একটি এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণ করতে পাঁচ একর জায়গা দিতে রায়ে সরকারকে নির্দেশ দিলেও এই রায় সহজ ভাবে মানতে পারেনি মুসলমান সম্প্রদায়।অবশেষে ৫আগস্ট ২০২০ বাবরি মসজিদের জায়গায় নির্মাণ কাজ শুরু করলো বিজেপির নেতৃত্বাধীন নরেন্দ্র মোদির সরকার। এই দিনটিকে বিজেপি উৎসব ও ভারতের স্বাধীনতা দিবস ১৫ আগস্টের সাথে তুলনা করলেও ভারতের মুসলমানরা এটিকে কালো দিবস হিসেবে দেখছে। পাঁচশো বছরের পুরনো বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণ শুরু করার প্রতিক্রিয়ায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম পারসনাল ল বোর্ড বলছে- ‘বাবরি মসজিদ একটা ছিল আর থাকবে, আয়া সোফিয়া আমাদের কাছে একটা বড় উদাহরণ। অবস্থা চিরকাল এক রকম থাকবেনা’ এসব বক্তব্য কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট মুসলমানরা এই ঘটনাকে সহজভাবে নিতে পারছেনা। ক্ষত রয়েই গেল। এতদিন বিজেপির রাজনৈতিক লক্ষ্য উদ্দেশ্যই ছিল কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা, নাগরিকত্ব আইন পাস এবং বাবরি মসজিদের জায়গায় রামের মন্দির নির্মাণ করা। পরপর দুই মেয়াদে মোদি সরকার এই তিনটি উদ্দেশ্যই বাস্তবায়ন করে ছাড়লো।এসব করে বিভক্তি ও বিভাজনের রাজনীতির যে ধারা বিজেপি ভারতে সৃষ্টি করলো তার প্রতিক্রিয়া হয়ত যুগ যুগ ধরে চলবে।

পাঁচ.
বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করার জন্য বিজেপি,আরএসএস কিংবা ভিএইসপি সহ কয়েকটি হিন্দু সংগঠন ও মোদি সরকার  দায়ী হলেও ভারতের সমগ্র হিন্দু সম্প্রদায়কে দায়ী করা যায় না। এমনকি কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, শশি থারুর ও তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ ভারতের অনেক হিন্দু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আশার জায়গা এখানেই। এইসব রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে মোদির তীব্র সমালোচনা হবে সেটা মোদির মত একজন ঝানু রাজনীতিবিদ জানেন না, বুঝেন না, বিষয়টা কী আধো সে রকম? অবশ্যই না। এনআরসি, সিএএ, ৩৭০ ধারা বাতিল কিংবা বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির বানানোর রাজনীতি -যাই বলুন না কেন এগুলো মূলত মোদির ক্ষমতার রাজনীতির উন্মাদনা। যেহেতু ভারতের সংখ্যা গরিষ্ঠ হিন্দু সুতরাং উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধর্মীয় ফ্লেভার দিয়ে ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়া সহজ।মোদি তাই করছেন। বিজেপির টার্গেট ২০২৪ সালের ভোট। গণতন্ত্র থাকলো কিনা, মানবাধিকার থাকলো কিনা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলো কিনা, ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলো কিনা, গরু রক্ষায় মানুষ মরলো কিনা- এগুলো নিয়ে মনে হয় মোদির ভাবনার সময় নেই। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের এক বছর পূর্ণ হওয়ার মত একটি দিনকে রাম মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের জন্য কেন বেঁচে নেয়া হলো? মোদির উদ্দেশ্য আর যাই হোক এবার সফল হয়নি।ভারতের জনগণ একটি সম্ভাব্য দাঙ্গা এড়াতে পেরেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের চাপে পড়ার জন্য মোদি সরকার কী খুব কম দায়ী? কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল, বিতর্কিত এনআরসি-সিএএ নাগরিকত্ব আইন পাস, সর্বশেষ বাবরি মসজিদের ধ্বংস স্তুপের জায়গায় রাম মন্দির বানানোর রাজনীতির মাধ্যমে মোদি হয়ত তার ধর্মীয় উগ্রবাদী রাজনীতির ষোলকলা পূর্ণ করলেন। কিন্ত হেরে গেল বিশ্বের বৃহত্তর গণতান্ত্র, হেরে যাচ্ছে ভারতের সংবিধানের মূল স্পিরিট। মোদির রাজনীতি ভারতকে বিভক্তি বিভাজনের পথেই ঠেলে দিচ্ছে!

লেখক: মো. নিজাম উদ্দিন, রাজনৈতিক বিশ্লেষক