করোনায় বেঁচে থাকার সংগ্রাম!
গত বছরের ডিসেম্বরে চীন থেকে সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী এ পর্যন্ত ২১৩টিরও বেশি দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। গত ১১ মার্চ করোনাভাইরাস সংকটকে মহামারি ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
চীনের উহান শহর থেকে ছড়ানো করোনাভাইরাস মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছে গোটা বিশ্বকে। গত ডিসেম্বরের পর থেকে এখন পর্যন্ত ভাইরাসটিতে আক্রান্তের সংখ্যা এক কোটি ৬৯ লাখ ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা ছয় লাখ ৬৪ হাজার প্রায়। তবে সুস্থ রোগীর সংখ্যা এক কোটি চার লাখ ৭২ হাজার ছাড়িয়েছে।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় বলে জানায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। আর ১৮ মার্চ প্রথম একজনের মৃত্যুর সংবাদ জানানো হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ২,৩৩,১৯৪ জন প্রায়, সুস্থ হয়েছে ১,৩০,২৯২ জন প্রায় আর মৃত্যুবরণ করেছে ৩০৩৫ জন। এই সংখ্যা প্রতি দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পুরো বিশ্ব যখন করোনা ভাইরাসে স্তব্ধ ঠিক সেই সময় বাংলাদেশে জেকেজির আরিফ, ডা. সাবরিনা এবং রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদ করোনা টেস্টের নামে শুরু করেছে প্রতারণা। হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। এসবের দায় নিতে রাজি নয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিংবা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এসবের কারণে পদত্যাগ করেছে স্বাস্থ্য ডিজি আবুল কালাম আজাদ, আর নতুন ডিজি বলেছে এই দায় শুধু সরকারের একার নয়। করোনা ভাইরাস দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশা।
এই মহামরিতে যাদের টাকা আছে তারা কিছুটা চিকিৎসা পেলেও, চিকিৎসা পাচ্ছে না অসহায় মানুষগুলো। হাসপাতালের ধারে ধারে ঘুরেও করাতে পারছে না টেস্ট মিলছে না চিকিৎসা।
ভদ্রপল্লীর সদস্যদের চিকিৎসার সুযোগ ও সামর্থ্য বেশি। কিন্তু গরীবের মধ্যেও যারা হদ্দ গরীব, নিভৃত পল্লী, দুর্গম চর বা হাওরাঞ্চলে যারা থাকে অথবা মফস্বলে ও উপজেলা অঞ্চলে যে দরিদ্র জনগোষ্ঠী আছে, চিকিৎসার ন্যুনতম সুযোগ না থাকায় তারা যে স্বাস্থ্য পরীক্ষাই করাতে যায় না সেই তদন্ত কে করবে?
গরীবের প্রতি আর কত জারি থাকবে সিস্টেমেটিক বঞ্চনা? গরীবের টাকা নেই; ফলে সন্তানের জন্য উচ্চশিক্ষা ক্রয়ের সামর্থ্য নেই; উচ্চতর ডিগ্রি নেই তাই ভালো চাকরী নেই; বড় চাকরী নেই তো বড় বেতন নেই; বড় বেতন নেই বলে ভালো বাসস্থান এবং পুষ্টিকর খাদ্য নেই; খাবার নেই তাই রোগ-বালাইয়ের শেষ নেই; রোগ হলেও চিকিৎসা কেনার টাকা নেই; ভালো-খেয়ে-পড়ে-চিকিৎসা সেবা নিয়ে-আরামে-আনন্দে জীবন কাটানোর সুযোগ নেই বলে গরীবেরা তাড়াতাড়ি মারা যায়।
করোনা ভাইরাসের কারণে আয়-উপার্জন হারিয়ে ঢাকা ছাড়ছে দিশেহারা মানুষ। ফেসবুকের ওয়ালে ভাসছে শহরত্যাগী মানুষের মাল-বোঝাই ট্রাকের ছবি ও খবর। ঢাকাসহ বড় শহরগুলোয় এই প্রস্থান দৃশ্য। এক হিসাবে দেখা যায়, এরই মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি লোক ফিরে গেছে গ্রামে। উঠতি মধ্যবিত্তের একটা অংশ কম ভাড়ার বাসায় চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে কম ভাড়ার মেসে উঠেছেন।
কাজ নেই। আয়-রোজগার নেই। সঞ্চয়ও কারো শেষ, কারো বা তলানিতে। এই দুর্দিনে কীভাবে চলে কৃষক-শ্রমিক-কুলি-মজুর-তাঁতি-জেলে-কুমার-দেহপসারিনী-গৃহপরিচারিকাদের সংসার?
উবার-পাঠাও চালিয়ে, গৃহশিক্ষকতা করে, কাপড় ইস্ত্রির দোকান দিয়ে, পার্ট-টাইম বিক্রয় কর্মীর কাজ করে যাদের অন্ন জুটতো, কী করে চলছে তাদের?
গত ৮ই জুন এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত জানান, মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে সরকারঘোষিত ৬৬ দিনের লকডাউনে প্রায় পৌনে চার কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছে। এ সময়ে পাঁচ কোটি ৯৫ লাখ মানুষের শ্রেণিকাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে দুই কোটি ৫৫ লাখ মানুষ হতদরিদ্র হয়েছে। তবে অতি ধনীর অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে।
প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের প্রভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যে বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। সদ্য সমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরের (জুলাই-জুন) বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হজার ৭৮৬ কোটি ১০ লাখ (১৭৮৬.১ মিলিয়ন) ডলার; বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতির এ পরিমাণ আগের অর্থবছরের চেয়ে ২০২ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ১২.৭৯ শতাংশ বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৫৮৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানি বাণিজ্যে বড় বড় হোঁচট খাওয়ায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। চীনের হুবেই প্রদেশে থেকে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস বছরের শুরু থেকে ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বব্যাপী আঘাত হানে। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে পুরো দুনিয়া।
লেখক: যুগ্ম আহ্বায়ক, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ।