১৮ জুলাই ২০২০, ০৯:০১

আন্ত ক্যাডার বৈষম্যের প্রভাব উচ্চশিক্ষায়

দেশের আন্ত ক্যাডার বৈষম্যের প্রভাব পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণায়। সরকারি চাকরিতে ক্যাডারে ক্যাডারে বৈষম্য দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় এ প্রভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশোনায় দিন দিন আগ্রহ কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিশেষায়িত পড়াশোনায় এর প্রভাব সংশ্লিষ্ট সেক্টরের যুগোপযোগী গ্র্যাজুয়েট তৈরিতে একদিকে যেমন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে সেক্টরগুলোতে হতাশা ও ক্ষোভের কারণে মানসম্মত সেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে না।

পত্র-পত্রিকা ও ভুক্তভোগী গ্র্যাজুয়েটদের তথ্য মতে, কখনো পদোন্নতি বৈষম্য, কখনো কর্তৃত্ব বৈষম্য আবার কখনো আর্থিক সুযোগ-সুবিধা, রাষ্ট্রীয় প্রটোকল, খবরদারি ও যৌক্তিক প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বেশির ভাগ ক্যাডারের চাকরিজীবীরা। একই পরীক্ষায়, একই দিনে পরীক্ষার ফল পেয়ে, আবার একই দিনে যোগদান করে ক্যাডার কর্মকর্তারা যদি তাঁদের পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করেন তাহলে তাঁদের একই দিনে পদোন্নতি হওয়ার যৌক্তিকতা থাকলেও তা হচ্ছে না বলে জানা যায়। এমনও দেখা গেছে, ১৫-১৭ বছর এন্ট্রি লেভেলে থেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেক ক্যাডারের সুপারনিউমোরারি পদ তো দূরের কথা গ্রেড-২ পর্যন্ত উঠার সুযোগ নেই। শিক্ষা ক্যাডারের অবস্থা আরো শোচনীয়। এমনকি উচ্চশিক্ষার জন্য যেখানে শিক্ষা ক্যাডারে সুযোগ দেওয়া উচিত সেখানে অন্য ক্যাডাররা এসব সুযোগ বাগিয়ে নিচ্ছেন। ফলে হতাশা, অভিমান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে কর্মস্থলে অবদান রাখার মনোবল ভেঙে যাচ্ছে তাঁদের। এসব বৈষম্য ও অসামঞ্জস্যতার প্রভাব শিক্ষাক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীদের পদভ্রষ্ট করছে।

একসময় বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা গ্র্যাজুয়েশন মনোযোগ দিয়ে শেষ করে বিবিএসে মনোনিবেশ করতেন। আস্তে আস্তে এটি বেড়ে এমন অবস্থায় চলে গেছে যে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এইচএসসি পাস করার পর থেকে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কোনোভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শুরু করে দেন পুরোদমে বিসিএস প্রস্তুতি। কোচিং, প্রাইভেট, লাইব্রেরিতে গ্রুপ করে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে দেখা যায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে। স্নাতক পার করে নামমাত্র মাস্টার্সে ভর্তি হন আবাসিক হলে সিট ধরে রেখে বিসিএসের পড়াশোনার জন্য। মাস্টাসের্র ক্লাস কম করা, পরীক্ষা পেছানো, নামমাত্র গবেষণা, সেমিস্টার বিলম্ব করা এবং পাস করার পরও হলে বা হোস্টেলে থাকার প্রবণতা দেখা যায় তাঁদের মধ্যে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলাফল ক্যাডার চাকরিপ্রাপ্তিতে কোনো ভূমিকা না রাখায় একাডেমিক পড়াশোনা শিক্ষার্থীদের কাছে অনেকটা নন-মেজর বা গৌণ হয়ে গেছে। মুখ্য হয়ে গেছে বিসিএস। লক্ষ্য একটাই—বিসিএস ক্যাডার হওয়া চাই।

এ চিত্র বিশ্বের কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। এই বিসিএস মোহ আজ বাংলাদেশের মেধা ধ্বংস করে চলেছে। বিদেশমুখী করছে অনেক মেধাবীকে। কিন্তু রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের এটাও চিন্তা করা উচিত, এই বিসিএসের নামে প্রতিবছর কমপক্ষে চার লাখ বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট বেকার তৈরি করছে। শিক্ষার্থীরা স্নাতক থেকে শুরু করে ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রায় ১০ বছর মূল্যবান সময়টুকু এই বিসিএসের পেছনে অতিবাহিত করছেন। বিসিএসের মাধ্যমে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার মিলিয়ে ৮-৯ হাজারের চাকরির ব্যবস্থা হচ্ছে, তাহলে বাকিরা কী করছে, এটিও ভাবার বিষয়।

চাকরির যেখানে সংকট, যেখানে দিন দিন বেকারত্ব বাড়ছে, সেখানে একের পর এক বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়, অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান ও কলেজ কী জন্য খোলা হচ্ছে, তা অনেকের বোধগম্য নয়। আবার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে বিশেষায়িতরা যাতে সাধারণ ক্যাডারে না যায়। তাহলে তাঁরা যাবে কোথায়। শিক্ষার্থীদের এ ক্ষেত্রে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এটি সিস্টেমের দোষ। তাই পরিবর্তন প্রয়োজন সিস্টেমের।

বেকারত্বের অভিশাপ থেকে সবাই মুক্তি পেতে চায়। সবাই ভালো থাকতে চায়। চাকরি একজন ব্যক্তির সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা। একজন ভালো শিক্ষার্থী ভালো ফল করে ভালো চাকরি করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। সর্বশেষ ৩৮তম বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে বিশেষায়িত গ্র্যাজুয়েটের আধিক্য আন্ত ক্যাডার বৈষম্যের প্রভাবের একটি উত্কৃষ্ট উদাহরণ। তাই আন্ত ক্যাডার বৈষম্য যত দিন দূর না হবে তত দিন বিশেষায়িত ডিগ্রিধারীরা সাধারণ ক্যাডারের দিকেই ঝুঁকবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এভাবে চলতে থাকলে দেশের উচ্চশিক্ষা, বিশেষ করে বিশেষায়িত শিক্ষা যে মুখ থুবড়ে পড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

শুধু শিক্ষার্থী নয়, ক্যাডার বৈষম্য প্রভাব ফেলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়। ক্লাসের প্রথম সারির শিক্ষার্থীরা যখন ক্যাডারের মোহ না করে শিক্ষকতায় আসেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর বন্ধুটিকে যখন অনাকাঙ্ক্ষিত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে দেখেন তখন সামাজিক ও মানসিকভাবে কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হন। তখন সেই শিক্ষক সরকার থেকে আশানুরূপ কিছু না পেলেও নিজের চেষ্টায় আর্থিক সক্ষমতা অর্জনে মরিয়া হয়ে ওঠে। লেকচার পদে যোগ দিয়েই ভালো স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার্স, পিএইচডি, পোস্টডক ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে আর্থিক ভারসাম্য তৈরির চেষ্টা করেন। দেশে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকলে, গবেষণায় প্রণোদনা থাকলে বাইরে যাওয়ার প্রবণতা কম থাকত। সম্প্রতি এ প্রবণতা অন্য ক্যাডারদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। সরকারি অনুদানে বা সরকার নিয়ন্ত্রিত স্কলারশিপগুলো তাঁরা ভোগ করে থাকেন, কিন্তু এগুলো প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা ক্যাডার ও গবেষকরা পেলে শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন হতো এবং জাতি উপকৃত হতো।

শুধু উচ্চশিক্ষা নয়, আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায়ও প্রভাব ফেলেছে। শিক্ষকদের সুবিধাবঞ্চিত করা এবং এ পেশায় মেধাবীদের আকর্ষণ করতে না পারায় শিক্ষার মানে প্রভাব পড়েছে। সরকারি চাকরিতে ১-২০ গ্রেডের মধ্যে নিচের গ্রেডগুলোর সঙ্গে ওপরের গ্রেডগুলোর আকাশ-পাতাল বৈষম্য থাকায় সামাজিক ও আর্থিকভাবে দীনতায় পড়েছেন নিম্ন গ্রেডের চাকরিজীবীরা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষকরাও এর বাইরে নন। শিক্ষকদের জন্য যুগোপযোগী যোগ্যতা নির্ধারণ সাপেক্ষে স্বতন্ত্র পে-স্কেল করা না গেলে শিক্ষার মানোন্নয়ন কখনই সম্ভব নয়।

বলা হচ্ছে, এসব বিশেষায়িত বিষয়ে শিক্ষাদান অনেক ব্যয়বহুল। সরকারকে অনেক টাকা ব্যয় করতে হয় তাঁদের তৈরি করতে। অনেক দামি গ্র্যাজুয়েট তৈরিতে অনেক টাকা লাগবে, এটাই স্বাভাবিক। আবার এই দামি গ্র্যাজুয়েটদের কম দামি চাকরিতে বাধ্য করার কৌশলও কতটুকু যৌক্তিক হবে। বিসিএস পরীক্ষার ক্ষেত্রে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হলে চাকরিতে লেভেল এনজয়িং ফিল্ডও (সুযোগ-সুবিধা ভোগের সমতল ক্ষেত্র) তৈরি করা প্রয়োজন। তা না হলে সবাই লেভেল এনজয়িং ফিল্ডের দিকে দৌড়াবে। পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতি যেভাবেই হোক না কেন চাকরির প্রয়োজনে মেধাবীরা তা ওভারকাম বা পরাস্ত করে ফেলবে। সমস্যা পরীক্ষায় নয়, সমস্যা চাকরির কাঠামোতে, সমস্যা সিস্টেমে।

একটি বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়ের ডিজি থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত একই পেশার বা বিষয়ের হলে এবং প্রয়োজনে বিশেষায়িত টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী থাকলে ওই সেক্টরের সমস্যা সহজে চিহ্নিতকরণ, অনুধাবন এবং প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজ হবে এবং সেক্টরের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রকৌশল, কৃষি, পশুসম্পদ, মৎস্য ইত্যাদি প্রফেশনাল ক্যাডারদের নিজ মন্ত্রণালয়ের কাজে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে। এই প্রফেশনাল ক্যাডাররা সর্বোচ্চ পদটি পাওয়ার আশা ও উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করতে পারবেন। দেশের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি এবং প্রয়োজনীয় জনবলের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন পদ সৃষ্টি সহজ হবে। বিশেষায়িত গ্র্যাজুয়েটদের নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, যার প্রতিফলন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষায়িত লেখাপড়ায় প্রাণের সঞ্চার ঘটাবে। তাই পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় করে পেশাভিত্তিক প্রশাসন গড়ে তোলা জরুরি।

লেখক : গবেষক ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়