‘গোরু’ নাকি ‘গরু’— ব্যাখ্যা দিলেন অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর
গরু না গোরু—কোন বানান ঠিক, এ নিয়ে তর্ক ছিলই। কিন্তু এবার কোরবানির ঠিক আগে আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হঠাৎ আবার সরব হয়েছেন অনেকেই। চলমান এ বিতর্ক নিরসনে বাংলা একাডেমি একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছে।
ব্যাখ্যায় সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি বলছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলমান বানান বিতর্কে যে বিকল্প বানানের কথা বলা হচ্ছে তা ইতোমধ্যে ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’-এর পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণে সংযোজিত হয়েছে। এছাড়াও বহুল ব্যবহৃত শব্দের বিকল্প বানানও এ সংস্করণে যোগ করা হয়েছে। ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’-এর এ সংস্করণটি অচিরেই বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হবে এবং চলমান বানান-বিতর্কের অবসান ঘটবে- এমনটাই প্রত্যাশা।
এদিকে, গরু না গোরু—কোন বানান ঠিক, তার ব্যাখা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর। আজ মঙ্গলবার ফেসবুক পোস্টে ‘গরু-গোরু সমাচার ও রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি। নিচে সেই স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হল—
সংস্কৃত ‘গোরূপ’ থেকে পর্যায়ক্রমে ‘গরু’ শব্দটি ( গোরূপ > গোরুপ > গোরু > গরু) বাংলায় এসেছে। বাংলা একাডেমির জামিল চৌধুরী সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’-এ ‘গরু’ বানানভুক্তিটি নেই। ফলে ইতোমধ্যে বেশ প্রতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
অভিধানে আছে: ‘গোরু’। অনেকেই বলে থাকেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি ‘গোরু’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। হ্যাঁ, করেছেন; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ‘গরু’ শব্দও ব্যবহার করেছেন। তাঁর শব্দব্যবহারে বৈচিত্র্যেরতো শেষ ছিল না! তিনি গাভী, বৃষ, গাঈ (গাই), ধেনু-- নানা শব্দই প্রয়োজনানুসারে ব্যবহার করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের ‘গরু’ ও ‘গোরু’ বানান ব্যবহারের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাক:
গরু-- এই বানানে লেখা:
* ‘কোন দুটি গরু শব্দ করিতেছে? তোমারই দুটি গরু শব্দ করিতেছে।’ (‘সংস্কৃত শিক্ষা’, দ্বিতীয় ভাগ)
* ‘আমার সাহায্য চায়, ফলফুলুরি দেয় এনে, কারও বা ঘরে গরু আছে দুধ জুগিয়ে থাকে।’ (‘চার অধ্যায়’)
গোরু-- এই বানানে লেখা:
* ‘ম চালায় গোরুগাড়ি / ধান নিয়ে যায় বাড়ি’। (প্রথম ভাগ : ‘সহজ পাঠ’)
* ‘অভ্যাসের মেঠো পথ দিয়া গাড়ির গোরু আপনি চলে, গাড়োয়ন ঘুমাইয়া পড়িলেও ক্ষতি হয় না।’ (ভাষার কথা : ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’)
এখানে বিশাল ‘রবীন্দ্র-রচনাবলি’ থেকে মাত্র দুটো করে উদ্ধৃতি দেওয়া হলো। একটি শিশুপাঠ্য গ্রন্থ থেকে অন্যটি বড়োদের জন্য রচনা থেকে। লক্ষ্য করার বিষয়, ‘সংস্কৃত শিক্ষা’ বইতেও রবীন্দ্রনাথ ‘গরু’ বানান লিখছেন, নির্ভেজাল সংস্কৃত শব্দ নির্বাচন করেননি।
অতএব, বাংলা শব্দ ‘গরু’ ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’-এ ভুক্তি হিসেবে থাকবে না কেন? বিশেষ করে, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এ যেখানে হিন্দি ভাষায় ‘গোরু’ শব্দের ব্যবহারকে চিহ্নিত করেছেন, সেখানে বাংলা একাডেমির অভিধানে ‘গোরু’ পর্যন্ত থেমে যাওয়া উচিত হয়নি; বাঙালির বহু পরিচিত ও ব্যবহৃত শব্দ ‘গরু’ ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’-এ উল্লেখ করা প্রয়োজন।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি বাংলা একাডেমির বেশকিছু বানান নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত গরু বানান ‘গরু’ না ‘গোরু’। নতুন বানানরীতিতে বাংলা একাডেমি বলছে গোরু।