শিক্ষা ক্যাডারের হতাশায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থা
- আরিফুর রহমান
- প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২০, ১২:১১ PM , আপডেট: ১২ জুলাই ২০২০, ১২:১১ PM
শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে শিক্ষণ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে শিক্ষা ক্যাডার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। অথচ এই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বঞ্চনার শেষ নেই। তীব্র বৈষম্য ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্রমান্বয়ে পুঞ্জীভূত হচ্ছে ক্ষোভ আর হতাশা।
প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কর্মরত কর্মকর্তার এই ক্যাডারের দুর্দশা যেভাবে প্রকট আকার ধারণ করেছে, তা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এক অশনিসংকেত। একটা উদাহরণের মাধ্যেমে এই ক্যাডারের সমস্যা যে কতটা ভয়াবহ তা কিছুটা উপলব্ধি করা সম্ভব হতে পারে। সরকারি কলেজের একজন প্রভাষকের ছাত্র বিসিএস দিয়ে ঐ কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করার কয়েক বছর পর ঐ নব্য প্রভাষকের ছাত্রও পাশ করে আবার সেই কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন আর বছরের পর বছর কেউই পদোন্নতি না পেয়ে বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন। এমনই করুণ পরিস্থিতি শিক্ষা ক্যাডারের।
শিক্ষা ক্যাডারে দীর্ঘ দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে সব স্তরের পদোন্নতি। এমনিতেই ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতির পরিবর্তে বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতির কারণে এই ক্যাডারের পদোন্নতির গতি স্লোথ। তার ওপর যদি এই প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে, তাহলে কী অবস্থা দাঁড়ায় তা সহজে অনুমেয়। পদোন্নতি নিয়ে গড়িমসির কারণে প্রায় ৭০০ সহযোগী অধ্যাপক পদোন্নতি না পেয়েই অবসরে চলে যাচ্ছেন। এরকম বঞ্চনার শিকার আরো অনেকে। এই ক্যাডারে বহুসংখ্যক শিক্ষক আছেন, যারা পদোন্নতির সব যোগ্যতা অর্জন করার পরও এক যুগের বেশি সময় ধরে পদোন্নতিবঞ্চিত। এমনকি একটানা ১৬-১৭ বছর কোনো প্রমোশন না পাওয়ারও রেকর্ড আছে।
এ থেকে উত্তরণের জন্য বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতির পদ্ধতি বাদ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ব্যাচভিত্তিক যোগ্যতানুসারে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালাটি অনুসরণ করলেই এই সমস্যার অনেকটা সমাধান সম্ভব। তবে পদোন্নতির জট সমস্যা সমাধানের জন্য পদ সৃষ্টিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা ক্যাডারে মাত্র চারটি স্তর। আবার উচ্চক্রম অনুযায়ী ওপরের দিকে পদের সংখ্যা অনেক কম। তাই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শূন্য পদের অভাবে অনেকেই পদোন্নতি পাচ্ছেন না। আবার অনেক কলেজেই রয়েছে শিক্ষকের তীব্র সংকট। তাই একজন শিক্ষককে প্রচণ্ড চাপ নিতে হয়।
কোনো কোনো কলেজে কোনো বিষয়ে একজন মাত্র শিক্ষক থাকায় ঐ শিক্ষকের বদলির প্রয়োজন হলেও বদলি হতে পারছেন না। সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষকের ঘাটতি থাকায় একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে তীব্রভাবে। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষকের ঘাটতি দূর করা প্রয়োজন। দীর্ঘদিনের এই সমস্যা দূর করার জন্য বেশ কয়েক বছর আগে এই ক্যাডারের প্রতিটি স্তরে নতুন পদ সৃষ্টি করার জন্য একটি প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এ নিয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। অথচ একটি ক্যাডার সার্ভিস সচল রাখার জন্য বিষয়টি খুবই জরুরি।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার নামে যেহেতু একটি স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস রয়েছে, তাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে শিক্ষার সামগ্রিক প্রশাসনিক দায়িত্ব শিক্ষা ক্যাডারের হাতে ন্যস্ত থাকাই যুক্তিসংগত। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সাধারণত সরকারি কলেজে শিক্ষকতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অল্প কিছুসংখ্যক কর্মকর্তাই প্রশাসনিক পদে চাকরি করার সুযোগ পান। প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরের জন্য তো শিক্ষা ক্যাডারের কাউকে বিবেচিতই করা হয় না।
প্রশাসন ক্যাডারসহ অন্যরা প্রেষণে এই মন্ত্রণালয় ও এর সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে কাজ করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব অধিদপ্তর, পরিদপ্তরের প্রথম শ্রেণির প্রশাসনিক পদগুলোতে অল্পসংখ্যকই শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা সুযোগ পান। অথচ এসব জায়গায় শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরই থাকার কথা। শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োজিতদের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেওয়া হলেও তাদের একমাত্র পরিচয় হয়ে উঠেছে কলেজশিক্ষক।
অন্যান্য ক্যাডারে জেলা ও থানা পর্যায়ের অফিসগুলোতে ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হলেও শিক্ষা ক্যাডারে কলেজ ছাড়া আর কোনো প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দেওয়া হয় না। ফলে দেখা যায় জেলা শিক্ষা অফিসার, থানা শিক্ষা অফিসার যে সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন, সেখানে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা কেবল কলেজশিক্ষক হিসেবেই বিবেচিত হন।
শিক্ষা ক্যাডার আরো অনেক ধরনের বৈষম্যের শিকার। বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে প্রণীত চাকরি পুনর্গঠন ও শর্তাবলি অ্যাক্টে ক্যাডার বৈষম্য নিরসনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ক্যাডার বৈষম্য হ্রাসের নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু অজানা কারণে এখনো তা প্রতিপালিত হয়নি। তাই সুবিধাভোগী কিছু ক্যাডারের সঙ্গে শিক্ষা ক্যাডারের বৈষম্য ক্রমে বেড়েই চলেছে।
প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা পঞ্চম গ্রেড থেকে পদোন্নতি পেয়ে তৃতীয় গ্রেডে গেলেও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে চতুর্থ গ্রেডে যান। উপজেলা পর্যায়ে একজন ইউএনওর জন্য অর্ধকোটি টাকার গাড়ি বরাদ্দ থাকলেও শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদে আসীন সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের জন্য কোনো গাড়ি বরাদ্দ থাকে না, যা অত্যন্ত লজ্জার।
উপসচিব পর্যায়ে গাড়ি কেনার ঋণসুবিধা থাকলেও সেই সুযোগটাও এই ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদধারীদের নেই। বোর্ড থেকে উত্তরপত্রের বস্তা মাথায় করে নিয়ে যাওয়া শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তার ছবি পত্রিকার পাতায় উঠে এসেছে। অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তা এমনকি নন-ক্যাডার কর্মকর্তা অফিস থেকে গাড়ির সুবিধা পেলেও এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। অন্যান্য ক্যাডারসহ নন-ক্যাডাররা অনেক ক্ষেত্রেই আবাসিক সুবিধা পেলেও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা এই সুবিধার কথা চিন্তাও করতে পারেন না। যেখানে তাদের অফিসে স্বতন্ত্র বসার জায়গাটা পর্যন্ত নেই, সেখানে আবাসিক সুবিধা লাভের চিন্তা সুদূর পরাহত।
বিষণ্নতা ও হতাশা নিয়ে বেশি দূর এগিয়ে যাওয়া যায় না। শিক্ষা ক্যাডারের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য ব্যাচভিত্তিক যথাসময়ে পদোন্নতি, প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এর সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর, পরিদপ্তর এবং বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলাভিত্তিক প্রশাসনিক পদের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যেমে শিক্ষা ক্যাডারদের নিয়োগ, আবাসিক সুবিধা, গাড়ির সুবিধা, মোবাইল ও ইন্টারনেট ভাতা প্রদান, বই ক্রয়ের ভাতা, অতিরিক্ত দায়িত্বভাতা প্রদান, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণসুবিধাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য আশু পদক্ষেপ না নিলে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করাও সম্ভব হবে না। এজন্য প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের সদিচ্ছা ও সমন্বয় জরুরি।
লেখক: শিক্ষক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: ইত্তেফাক