অনলাইন পরীক্ষার সঠিক মূল্যায়ন পদ্ধতি: একটি প্রস্তাবনা
আমাদের পৃথিবী প্রতিদিনই পরিবর্তন হচ্ছে। সাথে সাথে পরিবর্তন হচ্ছে এর নিয়ম কানুন, রীতিনীতি, কলা কৌশল। আর এই পরিবর্তনের সাথে যারা খাপ খাওয়াতে পারে না, তারাই কালের গহব্বরে হারিয়ে যায়। এটাই হলো বিবর্তন। বর্তমান বিশ্বে এই বিবর্তনের গতি অতি মাত্রার বৃদ্ধি করেছে করোনাভাইরাস। এতে কোন সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশে লকডাউন শুরু হয়েছে গত ২৬ মার্চ থেকে। আর গত ১৭ মার্চ থেকে সকল স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি বন্ধ রয়েছে। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও কোন না কোনভাবে কিছু কিছু স্কুল, কলেজে ও প্রায় সকল প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি ক্লাস শুরু করেছে।
এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। তারা প্রথম থেকেই অনলাইন ক্লাস নিতে অনীহা দেখিয়েছে। এর মূল কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একটা অংশ ও কিছু শিক্ষক এই ডিজিটাল টেকনোলজির সাথে পরিচিত নয় আবার কিছু অংশ এর সাথে খাপ খাওয়াতেও ইচ্ছুক নয়।
যদিও বলা হচ্ছে, প্রায় ২০% স্টুডেন্ট এই ডিজিটাল টেকনোলজি গ্রহণের সক্ষমতা রাখে না। এই স্টুডেন্টদের কিভাবে এই ডিজিটাল প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে হবে, তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও সরকারকে ভাবতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই করোনা পরিস্থিতি সহসায় ঠিক হবে না। আর এটা ইতিমধ্যেই আইইডিসিআর ঘোষণাও দিয়েছে যে আগামী তিন বছর বাংলাদেশে করোনা থাকবে।
তাহলে এখন? গত ২৫ জুন ইউজিসির সাথে পাবলিক বিশ্বাবিদ্যালয়গুলো কথা বলেছে আর সম্মতি দিয়েছে যে তারা খুব তাড়াতাড়ি অনলাইনে ক্লাস শুরু করবে। তবে তারা কোন পরীক্ষা বা ব্যবহারিক ক্লাস নিবেন না। ব্যবহারিক ক্লাস হয়ত নেওয়া সম্ভব না, কিন্তু পরীক্ষা ছাড়া কিভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা যাবে?
তাদের বড় একটা অংশ মনে করছে, বিশ্বাবিদ্যালয় যখন খুলবে তখন একত্রে সব পরীক্ষা নিয়ে নিবে। কিন্তু সেটা কত দিন পরে বা একত্রে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেবে কিনা সেটা অনিশ্চিত। হয়ত কিছুদিন পরে তারা আবার বলবে আমরা অনলাইনে পরীক্ষাও নিব। তাহলে যা করতেই হবে, তা নিয়ে যদি আগেই প্রস্তুতি থাকা যায় তাহলে পড়ানোর মান কিংবা ছাত্র-ছাত্রীদের সেভাবে পাঠাদান করাটাও শিক্ষকদের জন্য সহজ হবে।
আমি আজকের এই লেখায় সে দিকটায় তুলে ধরার চেষ্টা করব। অর্থাৎ অনলাইনে কিভাবে সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব। আর এই সমস্যার কার্যকরী সমাধান দিতে পারে ব্লুমস টেক্সোনমি (Blooms Taxonomy) প্রশ্ন পত্র প্রনয়নের মাধ্যমে।
এখন প্রশ্ন হল, সেটা কি বা কিভাবে?
প্রথমেই বলে রাখি, আমাদের দেশের বেশিরভাগ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে পাঠদান ও পরীক্ষা নেওয়া হয় তা ২০০০ সালের আগেই পৃথিবীর বেশিরভাগ উন্নত দেশ বাতিল করেছে। ক্লাসে শিক্ষক লেকচার দেবেন আর শিক্ষার্থীরা শুধু শুনবে কিংবা পরীক্ষায় গদবাধা রচনা লিখবে, এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
এখন ওকে গুগলের যুগ, তাই পরিবর্তনটা অপরিহার্য। আমাদের দেশের স্কুল-কলেজ পর্যায়েও এখন সৃজনশীল প্রশ্ন করা হয়। কিন্তু তার বাস্তবতা কতটুকু তা সবাই জানে। তাই এই মহামারী সময়ে আমাদের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিৎ, তাদের পরীক্ষা পদ্ধতিতে ব্লুমস টেক্সোনমির পুরাপুরি প্রয়োগ করা। এখন আসেন আসল কথা বলি।
ব্লুমস টেক্সোনমি (Blooms Taxonomy) কি?
বেঞ্জামিন স্যামুয়েল (১৯১৩-১৯৯৯) সর্ব প্রথম ১৯৫৬ সালে শিক্ষার গুনগত উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য একটি বৈজ্ঞানিক টেক্সোনমির প্রণয়ন করেন যা ১৯৯৯ সালের পর আবার রিভাইস করা হয়। Taxonomy শব্দটির Taxis অর্থ ব্যবস্থা এবং nomos অর্থ বিজ্ঞান অর্থাৎ Blooms Taxonomy হলো ব্লুমস প্রবর্তিত একটি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা যা দিয়ে একজন শিক্ষার্থীর সঠিক মেধার মূল্যায়ন করা হয়।
বর্তমান পৃথীবিতে উন্নত দেশগুলোতে এই Blooms Taxonomy অনুসরণ করে স্কুল কলেজ ও ভার্সিটিতে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে। এই টেক্সোনমিতে মোট ছয়টি ধাপে প্রশ্ন থাকে, যার মাধ্যমে একজন পরীক্ষার্থীর মেধা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা যায় সবচেয়ে সহজ থেকে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে। যেমন-
১ম ধাপ: মুখস্থ করা প্রশ্ন (Remembering Question)–
প্রশ্নপত্রের প্রথমেই কিছু প্রশ্ন থাকবে যেগুলো শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করে উত্তর দিবে যেগুলোকে আমরা তথ্যমুলক প্রশ্ন বলতে পারি। আর এগুলো সবচেয়ে সহজ প্রশ্ন। যেমন: বাংলাদেশের রাজধানীর নাম কি?
২য় ধাপ: বুঝতে পারা প্রশ্ন (Understanding Question)
এই প্রশ্নগুলো আগের তুলনায় কিছুটা কঠিন হবে আর এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কতটুকু বুঝতে পারলো তা যাচাই করা হয়। যেমন: এই গল্প থেকে আমরা কি শিখলাম?
৩য় ধাপ: প্রয়োগ করা প্রশ্ন (Applying Question)
এই প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান থেকে কতটুকু তা বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারলো তা যাচাই করা হয়। যেমন: আমরা যদি এই ফলাফলের সাথে ৯ দিয়ে গুন করি তাহলে তার ফলাফল কি হবে?
৪র্থ ধাপ: বিশ্লেষণ প্রশ্ন (Analyzing Question)
এই প্রশ্নগুলো কিছুটা কঠিন হবে আর এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। যেমন: কেন ভারত পাকিস্থানের মধ্যে যুদ্ধ বাধে?
৫ম ধাপ: মূল্যায়ন প্রশ্ন (Evaluating Question)
এই প্রশ্নগুলো আগের তুলনায় আরো একটু কঠিন হবে যার কোন কিছু হুবহু ক্লাসে পঠিত বিষয় থেকে থাকবে না। আর এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার ক্ষমতা বের করা যাবে। যেমন: তুমি কি মনে কর গল্পের নায়ক ঠিক কাজটিই করেছিল? তুমি হলে কি করতে?
৬ষ্ঠ ধাপ: সৃষ্টিশীল প্রশ্ন (Creating Question)
এই প্রশ্নগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান থেকে কোন কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। যেমন: এই শব্দগুলো একত্র করে একটি বাক্য তৈরি কর।
অনলাইনে পরীক্ষা ও আমার প্রস্তাবনা-
অনলাইনে পরীক্ষা মানেই হলো ওপেন বুক পরীক্ষা। তাই এই ওপেন বুক পরীক্ষাও সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব। যদি প্রশ্নপত্র Blooms Taxonomy অনুসরণ করা হয়। কারণ পরীক্ষার্থীরা তাদের বই থেকে ২০-৩০% এর বেশি কপি করতে পারবে না। বর্তমানে অনেক অনলাইন প্লাটফর্ম আছে যার মাধ্যমে সহজেই সময় বেধে দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব। যেমন গুগল ক্লাস্রুমে, এক্সাম ডট নেট ইত্যাদি। যেকোন (স্কুল, কলেজ বা) বিশ্বাবিদ্যাল নিম্ম উপায়ে কিংবা এগুলোর যে কোন সমন্নিত রুপ নিয়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিতে পারে।
পরীক্ষার ধরণ: চলমান মূল্যায়ন (Continuous Assessment)
প্রশ্নের ধরণ: কুইজ, (এম সি কিউ/ সত্য-মিথ্যা/ শূন্যস্থান পুরন), প্রেজেন্টেশন, এসাইনমেন্ট, ফ্লিপ এক্টিভিটিস, সরাসরি ভাইভা, এটেন্ডেন্স ইত্যাদি।
মার্কস: ৩০
পরীক্ষার ধরণ: সাময়িক (Mid Term) Blooms Taxonomy
প্রশ্নের ধরণ: (ছোট, বড় ও কেস প্রশ্ন)
মার্কস: ৩০
পরীক্ষার ধরণ: বার্ষিক (Final) Blooms Taxonomy
প্রশ্নের ধরণ: (ছোট, বড় ও কেস প্রশ্ন)
মার্কস: ৪০
Blooms Taxonomy যথাযথভাবে অনুসরণ করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করলে যদি কোন শিক্ষার্থী বাসায় বসে ওপেন বুক পরীক্ষাও দেয় তবুও তার সঠিক মেধা যাচায় করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে কিছু শর্ত পালন করতে হবে। যেমন-
১) একই রকম উত্তর দুই বা ততধিক শিক্ষার্থীর খাতায় দেখা গেলে তারা সবাই সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তরে কোন মার্ক পাবে না। শিক্ষকগণ সেটা খুব সহজেই বের করতে পারবে।
২) পরীক্ষার সময় নিদিষ্ট থাকতে হবে।
৩) পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উত্তর পত্রের ছবি তুলে নিয়ম অনুসারে আপলোড করে পাঠাবে অথবা সরাসরি অনলাইনে লিখবে।
উল্লেখ্য, যদি পড়ানোর বিষয় গাণিতিক ক্যাল্কুলেশন হয় তবে প্রশ্ন পত্র কয়েক সেট করে একই দিনে একই সময় কিংবা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কয়েকটি গ্রুপ করে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ইন্টারন্যশনাল বিজনেস এন্ড ইকোনমিক্স, বেইজিং, চীন