ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ভর্তি হওয়াটা কাকতাল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ভর্তি হওয়াটা কাকতাল। ইচ্ছা, স্বপ্ন, পরিকল্পনা, প্রস্তুতি— কিছুই ছিল না। কোচিং করিনি। ভর্তি গাইডও পড়িনি। মফস্বলেই চাঁদপুর কলেজে ভর্তি হবো- সেটা ধরেই নিয়েছিলাম। ঢাকায় খালার বাসায় এসে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য গেলাম গুলিস্তানে। ও বললো— পরদিন সকাল সকাল শাহবাগ মোড়ে যেতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফরম কিনবে। আমারও কেনা উচিত। কথামত গেলাম। ফরম কেনার চেয়ে বন্ধুর সঙ্গে ঘোরাটা মূল আগ্রহ ছিল। টিএসসিতে ফরম কেনার সে এক দীর্ঘ লাইন। কিন্তু দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েও আমার বন্ধুটি টেকেনি। আর পরীক্ষায় বসবো বলে আমার মনে হয়নি। কোন এক কারণে সেবার কয়েকবার ভর্তি পরীক্ষা পেছাল।
শেষ যে শুক্রবারে পরীক্ষা হবে তার আগের বুধবার রাতেও আজাদদের বাড়ির বাইরের উঠানে ব্যাডমিন্টন খেলছিলাম। তখন রুমন ভাই খেলার এক ফাঁকে পুকুর পাড়ে গল্পের সময় বললেন— ভর্তির কী অবস্থা। আমি বললাম, চাঁদপুরেই সরকারি কলেজে ভর্তি হবো। ভাই বললেন— ফরম কোনটা কিনেছি কিনা। বললাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিনেছি। এরপর রুমন ভাই ও বন্ধু আসিফের কথায় সে রাতেই সাড়ে ১২টার লঞ্চে আসলাম ঢাকা। খাদিজা আন্টির বাসায় একদিনের পড়াশোনা। মানে বিগত বছরের প্রশ্ন দেখে বোঝার চেষ্টা করা— কী ধরণের প্রশ্ন আসে। পরদিন পরীক্ষা দিয়ে সে দিন দুপুরেই ফিরে গেলাম। সম্ভবত দিন তিনেক পর রেজাল্ট বের হলো। ব্রাইট স্টার ক্লাব তখন যায়যায়দিন ও যুগান্তর বাদ দিয়ে কয়েকদিন হলো দেয়ালে ইত্তেফাক সাটানো শুরু করেছে। আসিফ আর আমি দেখি- রেজাল্ট প্রকাশ হয়েছে। এরপর ফিরে আসলাম বাড়িতে। রোল নাম্বার মিলিয়ে দেখি- টিকেছি! একটু পেছনের দিকে। তবে টিকেছি তো! দুই বন্ধু মিলে রাজিব ভাইদের কবরস্থানের সামনে, নদীর পাড়ে দীর্ঘ আলাপ। কী করবো? বেশ সংকটকাল তখন আমাদের। কয়েকদিন পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা হলো। তাতে সামনের দিকে নিজের নাম দেখে বললাম- চাঁদপুর কলেজই সই। গণপূর্তের অফিসে সুইটি আপার কাছে যাওয়ার পর বললো- না, ঢাকাতেই যাও। তারপর ঢাকাযাত্রা। ভর্তি। পদচারণা।
জীবনে কোন কিছুই খুব একটা পরিকল্পনা করে করিনি। যখন যা সামনে এসেছে তা-ই করেছি। অ্যাকাডেমিক জায়গা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি তেমন কিছু নিতে পারিনি। সেটি আমার ব্যর্থতা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান ও গবেষণার মান আর দশটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতই তলানিতে। কিছুটা মাছিমারা কেরানী, কিছুটা আদম তৈরির কারখানা। নানা অপূর্ণতা ও সমালোচনাতো রয়েছেই। তবু এ বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশের সবক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নেতৃত্বও তৈরি করেছে। আমার মত মফস্বলের ছেলেকে একটি আলাদা জীবনবোধ ও দর্শন দিয়েছে। এক মুঠো চমৎকার বন্ধু জুটিয়েছে। যুগ যুগান্তরে ভ্রমণের সুযোগ দিয়েছে। এক পৃথিবী নতুন দৃষ্টিকোন দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণের স্পন্দন প্রায় সব প্রাক্তনকেই আন্দোলিত করে। নস্টালজিক করে। সব শিক্ষাঙ্গনের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। বক্সের ভেতরের অবস্থা অনেক সময় বক্স থেকে না বেরোলে বোঝা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় যতটা বুঝেছি বের হওয়ার পর আরও বেশি টের পেয়েছি, পাচ্ছি। এ দেশের সাংবাদিকতায় যেমন এখন নতুন করে বেস্ট মাইন্ড তেমন আসে না বা থাকে না। তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগেও সিংহভাগ ক্ষেত্রে বেস্ট মাইন্ড গুরুত্ব পায় না। ব্যবস্থাপনা বা প্রণোদনাগত শূণ্যতার কথা নাইবা বললাম। যেখানে যেমন আলো বাতাস খেলা করে সেখানের পরিবেশটাও তেমনই হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুপাতিক হারে বেস্ট মাইন্ড কমেছে, কমছে। তাই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এটাকে দেশের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় বলা যাবে। কিন্তু বেস্ট বা সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয় বলা যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের বেস্ট বিশ্ববিদ্যালয় হোক, থাকুক সে কামনা করি। শুভ জন্মদিন, আমার বিদ্যায়তন।
লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস