করোনায় ইচ্ছে মতো ওষুধ খেলে মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যাবে
করোনা সন্দেহে বা টেস্টে পজিটিভ এলেই প্রচুর ওষধ খেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। মনে রাখতে হবে, করোনার উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও লুকিয়ে রাখলে কিংবা মিথ্যা তথ্য দিলে অথবা উপসর্গ ভিত্তিক ওষধ না খেয়ে ইচ্ছে মতো নিজে বাড়াবাড়ি চিকিৎসা করলে মৃত্যু ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাবে।
করোনাতে শ্বাসকষ্ট বা বুকে ব্যথা না-থাকলে অথবা হাঁপানি, সিওপিডি, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের রিং পরানো, কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, স্ট্রোক বা ডায়ালাইসিসের রোগী না হয়ে থাকলে সচরাচর হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না।
সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন করোনা রোগীদের মৃত্যুহার বৃদ্ধি, শরীরে হৃদযন্ত্রের গুরুতর সমস্যাসহ নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করে প্রমাণিত হওয়ায় এর ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। চোখের রেটিনার রোগী, লিভারের রোগী, গর্ভবতী, স্তন্যদানকারীদের ক্ষেত্রে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন সেবন নিষিদ্ধ।
করোনা চিকিৎসায় আইভারমেকটিন কতটুকু কার্যকর বা আদৌ কার্যকর কি-না, তা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলা যাবে। ৮০ ভাগ করোনা রোগী এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। তারা ওষুধ খেলেও সুস্থ হবেন, না খেলেও সুস্থ হবেন। বরং যে ২০ ভাগ রোগীকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয় বা বিশেষ করে তাদের ওপর আইভারমেকটিন কাজ করে কি-না সেটা দেখা দরকার। গবেষণাগারের গবেষণায় যে মাত্রার ডোজে আইভারমেকটিন ব্যবহৃত হয়েছে তা অনেক বেশি। সমমাত্রার আইভারমেকটিন রক্ত প্রবাহে পেতে হলে যে পরিমাণ ডোজ লাগবে, তা মানব দেহের জন্য মোটেও নিরাপদ নয়।
এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) করোনাভাইরাসের জন্য আইভারমেকটিন গ্রহণ না করার জন্য জনগণকে সতর্ক করেছে। হাঁপানি রোগী, লিভারের রোগী, গর্ভবতী, স্তন্যদানকারী মহিলা ও ১৫ বছরের নীচে শিশুদের ক্ষেত্রে আইভারমেকটিন সেবন নিষিদ্ধ। লিভারের রোগী, কিডনীর রোগী ও গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে ডক্সিসাইক্লিন সেবন নিষিদ্ধ।
ডেক্সামিথাসন কোনো সাধারণ ওষুধ নয়। শ্বাসকষ্ট জাতীয় সমস্যার ক্ষেত্রে, নিউমোনিয়া হলে, তীব্র হাঁপানি থাকলে অনেকসময় চিকিৎসকরা এই ধরণের ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দেন। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ বলে রোগীর সংকটাপন্ন অবস্থায় জীবন বাঁচানোর জন্য শুধু এই ওষুধটি প্রয়োগ করা হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই ওষুধ ব্যবহারে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে চর্বির পরিমাণ পেপটিক আলসার হতে পারে এবং ডায়াবেটিসের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে পারে, মুখে, পেটে বা পায়ে পানি আসতে পারে, কিডনী বিকল হতে পারে এবং লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিডনী বা লিভারের সমস্যা বা ডায়বেটিস যাদের রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এই ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া গুরুতর হতে পারে।
এছাড়া শরীরে কোনো ধরনের ইনফেকশন থাকলে তাও বেড়ে যেতে পারে। দীর্ঘদিন সেবন করলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে জটিল ধরনের ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা হতে পারে। এই ওষুধ শুধুমাত্র নিবীড় পরিচর্যায় বা আইসিইউতে চিকিৎসাধীন গুরুতর অসুস্থ করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে কিছুটা সফল প্রমাণিত হয়েছে। সব করোনা রোগীর জন্য নয়। অতএব দয়া করে একে মুড়িমুড়কি ভাববেন না।
মনে রাখবেন করোনা সংক্রমণের পূর্বে অথবা করোনা উপসর্গের প্রথম ৭ দিনের মধ্যে ডেক্সামেথাসন সেবন করলে করোনাভাইরাসের সংখ্যা অস্বাভাবিক দ্রুত বেড়ে গিয়ে উল্টো রোগের জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়াতে পারে।
বিশ্ব ইতোমধ্যে করোনার পাশাপাশি সেল্ফ-মেডিকেশন, ওষুধ-ঘাটতি, এমনকি হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন অতি মাত্রার মহামারি দেখেছে। এসবের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেকোনো ওষুধ ব্যাপকভাবে প্রয়োগের আগে তার কার্যকারিতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া দরকার। আর অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাবেন, নিজে নিজে বাড়াবাড়ি চিকিৎসা আর নয়।
লেখক: অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,
বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক এন্ড কনসাল্টেশান সেন্টার, লালবাগ, ঢাকা।