পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাসের সম্ভাব্যতা
মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে শিক্ষা অন্যতম হলেও জীবনের ঝুঁকি যখন প্রবল হয়ে ওঠে, বাঁচা-মরার প্রশ্ন যখন বারংবার উচ্চারিত হয়, তখন শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারকেও কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম দেয়ার প্রয়োজন পড়ে৷ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় মার্চের ৮ তারিখে। এর প্রেক্ষিতে ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করেন। ১৭ মার্চ থেকে চলমান এই ছুটি কয়েক দফায় বৃদ্ধি পেয়ে ইতোমধ্যেই তিন মাস অতিক্রম করেছে। সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই ছুটি বর্ধিত করা হয়েছে আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত।
বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ যে হারে বাড়ছে, তাতে করে খুব শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। যার ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এই ছুটি দীর্ঘায়িত হওয়ার আশংকাও প্রবল৷ এতে লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। স্কুল-কলেজের পাশাপাশি মেডিকেল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ শিক্ষালাভের প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরাও পড়েছেন বিপাকে, দুশ্চিন্তা করছেন অনাকাঙ্ক্ষিত সেশনজট নিয়ে।
এ সংকট নিরসনে সরকারিভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যার মধ্যে টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠদান প্রক্রিয়া কিছুকাল পূর্বে শুরুও হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন ক্লাসের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। তবে অনলাইন ক্লাসের সম্ভাব্যতা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। যদিও বেশ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে অনলাইনে ক্লাস নেয়া শুরু হয়েছে, কিন্তু ব্যাপক আকারে সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সুবিধা চালুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা একটু কঠিন বৈকি।
এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে, যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সংখ্যাধিক্য, ছাত্র-ছাত্রীদের আর্থিক অসচ্ছলতা, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের অপ্রতুলতা, উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগের স্বল্পসংখ্যক ব্যবহার, অবকাঠামোগত চাহিদা প্রভৃতি। তাই অনলাইন ক্লাস শুরুর পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষকে এসব বিষয় নিয়েও ক্রমাগত ভাবতে হচ্ছে। অনলাইনে ক্লাস গ্রহণ ও সকলের উপস্থিতি নিশ্চিত করা একটি জটিল প্রক্রিয়া। যেহেতু ইতিপূর্বে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি, তাই এ বিষয়ে জোরালো প্রস্তুতি না থাকাটাও খুবই স্বাভাবিক। তবে এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
প্রথমত, শিক্ষার্থীদের আর্থিক অসচ্ছলতা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের একটা প্রধান অংশ আসে গ্রামাঞ্চল থেকে, যাদের বেশির ভাগই নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। স্বাভাবিকভাবেই করোনার এই প্রাদুর্ভাবকালে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে, এই পরিস্থিতিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ খানিকটা কঠিন এবং ব্যয়সাধ্যও বটে।
দ্বিতীয়ত, কিছু শিক্ষার্থীর অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও ধীরগতির নেটওয়ার্ক এ প্রক্রিয়ায় বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশের জেলা কিংবা বিভাগীয় শহরগুলোর বাইরে অনেক স্থানেই দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ নেই, এর ফলে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের ক্লাসে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা থেকেই যায়।
তৃতীয়ত, সিংহভাগ শিক্ষার্থী তাদের প্রয়োজনীয় পাঠ্য ও রেফারেন্স বই হলে কিংবা মেসে রেখে এসেছেন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাঠ্যসূচির এই বইগুলোর পিডিএফ সংস্করণ বিনামূল্যে পাওয়া সম্ভব নয়। তাই অনলাইনে ক্লাস নিলেও তা থেকে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যসূচির মূল অংশ বাস্তবিকই শিখতে বা চর্চা করতে পারবে কি না সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এছাড়াও অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস নেয়ার ফলে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যকার স্বাভাবিক মিথস্ক্রিয়া কতটুকু কার্যকর থাকবে সেটিও আলোচনার দাবী রাখে।
তবে শুধু সমস্যার কথা ভেবেই এ থেকে পিছিয়ে আসা উচিত হবে না, বরং এই সমস্যাগুলোর কৌশলগত ও সার্বজনীন সমাধানের বিষয়ে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞদের মতামত গ্রহণ প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষে সকল শিক্ষার্থীর জন্য মোবাইল কিংবা ল্যাপটপ সরবরাহ করা সম্ভব নয়, এই দাবী উত্থাপনও যথেষ্ট অযৌক্তিক। তবে এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত হবে শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা ও সম্ভাব্যতা যাচাই করা। যদি ৮০ বা ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীর পক্ষে অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে, সেক্ষেত্রে বাকি ১০ বা ২০ শতাংশের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করে অনলাইন ক্লাসের আয়োজন করা যায়।
অন্যথায়, এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বৈষম্যের শিকার হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোর পক্ষ থেকে পাঠ্যবইগুলোর ‘পেইড ভার্সন’ সংগ্রহ করে তা শিক্ষার্থীদের ইমেইলের মাধ্যমে প্রেরণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময় পর পর শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে উন্মুক্ত আলোচনার ব্যবস্থাও এ সমস্যাগুলোর সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারবে। এছাড়াও টেলিকম কোম্পানিগুলোর সাথে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চুক্তির মাধ্যমে স্বল্পমূল্যের ইন্টারনেট প্যাকেজ সুবিধা প্রদান করলে অনেক শিক্ষার্থীর জন্যই তা উপকারে আসবে। বস্তুত, অনলাইনে পাঠদানের সিদ্ধান্ত হতে হবে সম্মিলিত চিন্তার ফসল। সব ধরনের সক্ষমতা যাচাইয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে এবং এ থেকে উপকৃত হবে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ই।
লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ishrakf1971@gmail.com