চীন-ভারত দ্বন্দ্ব: কী বার্তা দিচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়
- মো. নিজাম উদ্দিন
- প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২০, ০৪:২০ PM , আপডেট: ২৩ জুন ২০২০, ০৬:০১ PM
এক.
বিশ্ব যখন করোনা মহামারীতে থেমে গেছে, দেশে দেশে চলছে মৃত্যুের মিছিল, তখন বিশ্বের দুই পারমাণবিক শক্তিশালী রাষ্ট্র চীন- ভারত মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে। যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কেউ কাউকেই ছাড় দিতে রাজী নয়। এরই মধ্যে ভারতের বিশ জন সৈনিক চীনা সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছে। নিহতদের মধ্যে ভারতের উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাও রয়েছেন। চারজন অফিসার সহ দশজনকে চীন ধরে নিয়ে গেলেও পরে মুক্তি দেয়, ধরে নেওয়ার বিষয়টি অবশ্য ভারত প্রথমে স্বীকার করতে চায়নি।
চীনের কেমন সংখ্যক সৈনিক হতাহত হয়েছে সে ব্যাপারে চীনা সেনাবাহিনীর কোনো বিবৃতি এখনো চোখে না পরলেও সংখ্যাটা যে শূন্য হবে না সেটা সবাই ধরে নিয়েছেন। ভারতীয় গণমাধ্যম এএনআই বলছে -চীনের ৪৩ জন সৈনিক নিহত হয়েছে! যদিও এ ব্যাপারে চীন এখনো মুখ খোলেনি। ভয়াবহ এই ঘটনার জন্য চীন ভারত উভয়ই একে অপরকে দোষারোপ করছে। চীনা আর্মির লোহার রডে, কাঠে-পেরেক ঢুকানো যে আদিম অস্ত্র দিয়ে ভারতীয় সৈনিকদের পিটিয়ে মেরেছে ভারতের প্রখ্যাত প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা তাকে 'বর্বর' বলেই উল্লেখ করেছেন।
১৯৭৫ সালে অরুণাচল প্রদেশের একটি প্রত্যন্ত গিরিপথে চীন-ভারত সংঘর্ষে চারজন ভারতীয় সৈনিক নিহত হওয়ার পর বিগত পয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে বড় সীমান্ত সংকট বা খুনোখুনির ঘটনা ঘটল। ১৯৬২ সালের চীন ভারত যুদ্ধের পর এমন ঘটনা নজির বিহীন। ভারত চীনের মধ্যে সীমান্ত রয়েছে তিন হাজার চারশো চল্লিশ কিমি। যার একটা বড় অংশই দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল, ভারত চীনের সীমান্ত লাইন অব একচুয়াল কট্রোল এলএসি নামে পরিচিত। সীমান্তও স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত নয়। ডি ফ্যাক্টো -এই সীমান্তের অমীমাংসিত একটা জায়গার নাম গালওয়ান ভ্যালি। যেখানে ভারতের বিশ সৈনিককে হত্যা করে চীন। যার উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় চৌদ্দ হাজার ফুট উপরে। এই গালওয়ান ভ্যালির একপাশে চীন শাসিত আকসাই চীন অঞ্চল ।এই আকসাই চীনের ১৫০০০ বর্গমাইল এলাকাকে আবার ভারত তাদের নিজস্ব ভূমি বলে দাবী করে।
উল্লেখ্য ১৯৬২ সালের চীন ভারত যুদ্ধে চীন ভারতের অরুণাচল প্রদেশ ও আকসাই চীন দখল করে নিলেও পরবর্তীতে আকসাই চীনকে রেখে অরুণাচলকে ভারতের কাছে ফেরত দেয়। তবে এখনো অরুণাচলকে চীন নিজেদের বলে দাবী করে। গালওয়ান ভ্যালির অপরপাশে ভারতের লাদাখ। এই লাদাখ ২০১৯ সালের আগ পর্যন্ত জম্মু কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিন্তু মোদী গত বছর কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার সংক্রান্ত ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করে কাশ্মীরকে দুই টুকরো করে এক অংশের নাম রাখে লাদাখ। বিতর্কিত গালওয়ান ভ্যালি লাদাখে। তবে লাদাখ ও আকসাই চীন এক সময় এদুটো অঞ্চলই কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
দুই.
ভারত ২০১৯ সালে ভারত চীন সীমান্তের লাদাখের গালওয়ান ভ্যালি দিয়ে একটি রাস্তা নির্মাণ করে। দুইশো পঞ্চান্ন কিমি দীর্ঘ এই সড়ক লাদাখের রাজধানী লে কে সীমান্তের উপত্যকায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ এক ভারতীয় বিমানঘাটির সাথে যুক্ত করেছে। যে বিমানঘাঁটিটি চীন ভারত যুদ্ধ হলে ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকে চীনের জিনজিয়াংয়ের সামরিক ঘাটি গুলো খুব দূরে নয়। ভারতের এই সড়কের মাধ্যমে চীন-ভারত যুদ্ধ হলে ভারত খুব সহজেই সীমান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সামরিক সরঞ্জাম পৌঁছাতে পারবে। ভারতের সড়ক যোগাযোগের জন্য ভবিষ্যতে জিনজিয়াংয়ের কাসগর শহর থেকে তিব্বতের লাশা শহরে চীনের যে সড়ক তা হুমকির মুখে পড়বে-চীনের ভয় এখানেও।
অমীমাংসিত সীমান্তে চীন তাই ভারতের সড়ক নির্মাণকে খুব সহজ ভাবে নিতে না পেরে গত মে মাসেই ভারতের সৈনিকদের সাথে প্রথমে ধাক্কা ধাক্কিতে জড়িয়ে পড়ে।লাদাখের প্যানগং লেকের উত্তর পাশ,গালওয়ান ভ্যালি ও সিকিমের নাথুলা সীমান্তে চীনা সেনাবাহিনী ভারতে ঢুকে পড়ছে-এমন ঘটনা বার বার ঘটছিলো। যার চূড়ান্ত পরিনতি ১৫ জুন ২০ ভারতীয় জওয়ান হত্যা। ভারতের সীমান্তের কাছাকাছি সড়ক নির্মাণের পর চীনও সীমান্তের কাছাকাছি সামরিক সরঞ্জাম ও অস্ত্র শস্ত্রের ব্যাপক সমাবেশ ঘটাতে থাকে। তাবু ও পরিখা ও ব্যাংকার নির্মাণ করে চলে যুদ্ধের সাজ সাজ রব। হাজার হাজার চাইনিজ আর্মিকে গালওয়ান ভ্যালির দিকে মুভ করতে দেখা যায়। এমনকি গালওয়ান ভ্যালির (ভারতের) প্রায় চল্লিশ থেকে ষাট কিমি ভেতরে ঢুকে যায় চীনা সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে ভারতের সাথে অন্যান্যা দেশের সীমান্তে ভারতের যে আক্রমণাত্ম মনোভাব দেখা যায় ভারতের বিশজন সৈনিক নিহত ও দশজনকে ধরে নিয়ে গেলেও চীনের ক্ষেত্রে কিন্তু এমনটা দেখা যায়নি! মোদির এই নিরবতার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ভারতে। রাহুল গান্ধীও তীব্র সমালোচনা করছেন সরকারের। ভারত জুড়ে চীন পণ্য বয়কটের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কেউ কেউ মোদির উচিৎ শিক্ষা বলে নিরবে মুচকি হাসছে, হাততলিও দিচ্ছে!
তিন.
ভারতের সাথে চীনের সীমান্ত সংকটের কিছু ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও কারণও রয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী যা করে তার পেছনে একটি রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট অবশ্যই থাকে। চীনা সৈনিকরা তাদের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের অগোচরে ভারতের বিশজন সৈনিককে মেরে ফেলেছে এমনটি ভাবার নুন্যতম কোনো কারণ নেই। চীনা প্রেসিডেন্ট একই সাথে কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনা সেনাবাহিনী-চাইনিজ পিপলস আর্মিরও প্রধান। চীনা কংগ্রেসের এক অধিবেশনে কয়েকদিন আগেই শি জিংপিং তার সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন - সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুদ্ধের জন্য তৈরি থাকো। যা ঘটেছে তা আকস্মিক নয়। পরিকল্পিত। প্রথমে এটা একটা ছোট বিষয় থাকলেও এখন চীন পুরো গালওয়ান ভ্যালিটাই নিজেদের বলে রাষ্ট্রীয় ভাবে দাবী করছে। সুতরাং এটা একটা বড় সংকট হয়েই থাকছে।
১৯৪৭ সালে ভারত আমেরিকাকে ছয়টি বিমান ঘাটি ব্যবহার করতে দেয়। যেখান থেকে আমেরিকা চীনের কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কাজ করে। ১৯৫০ সালে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি তিব্বত দখল করলে সেখানকার একটি গেরিলা গোষ্ঠীকে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে মদদ দেয় ভারত ও আমেরিকা। সেই ঘটনাও ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের একটি ঐতিহাসিক কারণ। তিব্বতের বৌদ্ধদের আধ্যাতিক নেতা দালাইলামাকে ভারতে আশ্রয় দেয়াটাও চীন খুব সহজ করে দেখে না। সম্প্রতি তাইওয়ানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানে ভারতের অংশ নেয়াটায় চীন বিরক্ত। কারণ চীন মনে করে তাইওয়ান চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।চীন ভারতের সীমান্ত সংকটের মূল কারণ হয়ত এটা নয়, আরো গভীরে। যেমন- আটারো শতাব্দীতে চীন ভারতের যে সীমারেখা ছিল তাতে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ ও লাদাখের কিছু অংশ চীনের ছিল। চীন সেই সীমারেখাকেই এখনো ভারত চীনের মূল সীমারেখা মনে করে। সে হিসাবেই এখনো চীন ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে তাদের নিজেদের বলে দাবী করে।
কিন্তু ১৯১৩ সালে ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার আগেই চীন ভারতের একটি সীমারেখা চিহ্নিত করে যায়। যার নাম ম্যাকমোহন লাইন। সেই ম্যাকমোহন লাইনকেই মূল সীমারেখা মনে করে ভারত। যাকে চীন পাত্তাই দেয়না। লাদাখের গালওয়ান ভ্যালি সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় চৌদ্দ হাজার ফুট উপরে, সে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বের উচু সীমান্ত গুলোর একটিও বলা যায় একে। আবহাওয়া অত্যন্ত বৈরি। অঞ্চলটি সব সময়ই ভূ প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে থাকে। ধারণা করা হচ্ছে দু'পক্ষের মারামারিতে আঘাত নিয়ে হিমশীতলে টিকতে না পেরে উচু উপত্যকা থেকে গালওয়ান নদীতে পড়ে গিয়েও মারা যায় কয়েকজন। গালওয়ান ভ্যালির কোন জায়গাটি ভারত চীনের মূল সীমারেখা তাকে চিহ্নিত করা শুধু কঠিনই নয়,অসম্ভবও বটে। এমন একটি জায়গা নিয়ে চীন কেন যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করতে গেল? সহজ উত্তর হচ্ছে ভারত চীনকে আর নুন্যতম ছাড় দিতে নারাজ। ১৯৯৬ সালে চীন ভারতের এক চুক্তি অনুযায়ী লাইন অব একচুয়াল কট্রোলের উভয় পাশের দুই কিমি এর মধ্যে এবার কেউ অবশ্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেনি। কিন্তু পেরেক লাগানো যে রড ব্যবহার করা হয়েছে তা রীতিমতো বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে।
পাঁচ.
ভারত চীনের এই শ্বাসরুদ্ধকর সময়ের চুল-ছেঁড়া বিশ্লেষণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পণ্ডিতদের মধ্যে। কী বার্তা দেয় এই ঘটনা? মহামারীর মত একটা সময়ে চীন কেন এ ধরনের একটি পদক্ষেপ নিতে গেল? ভারত কেন নিরব? চীন কি এখন এটাই জানান দিতে চাইছে যে তারা শুধু অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ারই নয়। চাইলে সব পারে। ভারতের এক ধরনের নিরব আত্মসমর্পণ এটাই প্রমাণ করে মোদি যুদ্ধ চাননা, পারমাণবিক বোমার অধিকারী দুটো দেশের কোনো সশস্ত্র যুদ্ধ শুধু দুদেশেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, শেষ করে দিবে পুরো অঞ্চলকেই। বড় কোনো যুদ্ধে দুটো দেশের জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা হয়ত নেই কিন্তু সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মত এমন ঘটনা হয়ত থামানো যাবেনা। কট্টরপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী দামোদর দাস মোদিকে নিজ দেশে কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা রদ কিংবা এনআরসি ও সিএএ নিয়ে যতটা জাতীয়তাবাদী বক্তৃতা আচরণ ও কাজ করতে দেখা গেছে সেই তুলনায় বিশজন সৈনিক হারানোর পরও তার নিরব প্রতিক্রিয়ায় কেউ কেউ বিস্ময়ও প্রকাশ করছেন। ভারতের বিশ বছরের পরিক্ষিত বন্ধু আমেরিকা কিন্তু এখনো একটা বিবৃতি দেওয়ার সময় পায়নি। যে ইসরায়েল ও ইউরোপকে ভারতের পরম বন্ধু মনে করা হত তারাও নিরব।
১৯৬২ সালের চীন ভারত যুদ্ধে রাশিয়া বন্ধু হয়েও ভারতের সাথে যে আচরণ করেছিল, পাশে থাকেনি, আমেরিকাও এবার সে আচরণটাই করেছে।আমেরিকা ও পাশ্চাত্য দুনিয়ার ভারতের পাশে এবার না দাঁড়ানোটা কী চীনকে এ অঞ্চলে আরো বেপরোয়া করে দিতে পারে? উঠছে সেই প্রশ্নও।
এমন এক সময়ে ভারতের সাথে চীনের সংঘর্ষ বাদলো যখন নেপাল ভারতের ভেতরের বিতর্কিত ভূমি কালাপানি, লিপুলেখ ও লিম্ফিয়াতোয়া নামক তিনটি বিতর্কিত ভূমিকে নিজেদের বলে সংসদে আইন পাস করে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করলো। এমনকি সম্প্রতি নেপালি সৈনিকদের হাতে সীমান্তে এক ভারতীয়ও মারা গেছে! নেপাল এখন সম্পূর্ণ চীনের নিয়ন্ত্রণে বলা চলে, নেপালের ক্ষমতায় কমিউনিস্টরা, যা ভারতের জন্য চরম দুঃসংবাদ। নেপাল এখন যা করছে তা চীনের ইশারাতেই। পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মিরের বালাকোটে মোদি নির্বাচনের আগে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের নামে যে হামলা করেছিলেন তাতে নির্বাচনে জিততে মোদি জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা তৈরি করতে পারলেও ভারত এই ঘটনায় খুব বেশি একটা লাভবান হতে পারেনি।
মালদ্বীপে বিমানবন্দর নির্মাণ, দ্বীপ কিনে পর্যটন শিল্প ও অবকাঠামোয় বিশাল বিনিয়োগের মত চায়নিজ পেকেজ রয়েছে।শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোগা বন্দর এখন চীনের হাতে একশো বছরের লিজে। শ্রীলঙ্কার সরকারে চীনের প্রভাব ব্যাপক। আর পাকিস্তান তো চীনের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু। পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্ক বরাবরেরই মতোই। ২০১৭ সালে ভারত ভুটান ও চীন সীমান্তের দোকালাম বিতর্কিত ভূমি নিয়ে ৭২ দিনের সংকট চললেও ভুটানের সাথে চীনের সম্পর্ক খারাপ নয়, তবে চীন ভুটানকে ভারতের কামানের গোলা না হওয়ার হুশিয়ারি দিচ্ছে। যদিও সে সময় ভারত ভুটানের পক্ষে সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেছিল। সুতরাং ভারত কী দক্ষিণ এশিয়ায় একেবারেই একা হয়ে যাচ্ছে? এখন বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় মোদির কোনো বিশ্বস্ত বন্ধু নেই। ২০১০ সালে বিশ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে চট্টগ্রামে চীন একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে রাজী হলেও শুধু ভারত, আমেরিকা ও জাপানের চাপে সরকার চীনের কাছ থেকে সরে আসে। সেই বন্দর এখন জাপান বানাচ্ছে। এটি নিয়েও বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন জনগণের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাশে দাঁড়ানোর বিনিময়ে ভারত যেভাবে নোংরা হস্তক্ষেপ করে তা দেশের তরুণ প্রজন্ম প্রচন্ড ঘৃণা করে। ভারতকে মনে রাখতে হবে -একবিংশ শতাব্দীর দুনিয়ায় মানুষ যেকোনো ধরনের আগ্রাসন ও সাম্রাজ্যেবাদকে প্রচন্ড ঘৃণা করে।
সম্পূর্ণ ভারতপন্থী সরকার ক্ষমতায় থেকেও চীন থেকে কেন সাবমেরিন কেনে বাংলাদেশ,সামরিক অস্ত্র কেনে-এটা ভারত যত তারাতাড়ি বুঝতে পারবে ততই মঙ্গল। গণমাধ্যমে আসছে চীন এখন বাংলাদেশকে তার দেশে বিশাল সংখ্যক পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রদেশাধিকার দিতে চাইছে। যা ভারত ভালো চোখে দেখছে না। তবে নেপালের পরে বাংলাদেশই যে চীনের টার্গেট এটা খুব পরিস্কার। পরিস্হিতি স্পষ্ট করে জানান দিচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় সময়টা বোধহয় চীনের, একা হচ্ছে মোদি, একা হচ্ছে ভারত! বাংলাদেশ চাইলে চীন ভারতের মাঝখানে থেকে এখন একটা অসাধারণ রাজনীতি করতে পারে, যে সুযোগ একটা জাতির জীবনে বার বার আসেনা। চীন ভারত এমন দুটো রাষ্ট্র তাদের যেকোনো সংকট ও সম্ভাবনা দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করে।তুলনামূলক আলোচনায় যেতে হল এজন্যই। তবে দক্ষিণ এশিয়া ভারতের প্রভাব থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দায় ভারতেরই। কোনো প্রতিবেশীর সাথেই শান্তি পূর্ণ বসবাসের মানসিক ইচ্ছে ভারতের নেই, সমস্যা সেখানেই। বিকল্প হিসেবে চীনকে পেয়ে ভারতের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অনেকেই।
ছয়.
চীনের সাথে না পেরে আমেরিকা এখন ভারতের দিকে বেশি ঝুকবে মনে করা হলেও ভারতের সংকটে আমেরিকার নিরবতা চীনকেই লাভবান করছে,হতাশ করছে ভারতকে। আমেরিকা মহামারীতে নিজের ঘর সামাল দিতে পারছেনা। মহামারী নিয়ন্ত্রণে আমেরিকা যেখানে হযবরল অবস্থায় চীন সেখানে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, যদিও চীনের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চরম নিয়ন্ত্রিত। মেডিকেল লজিস্টিক সাপোর্ট দিচ্ছে। ২০০৮ সালে বিশ্বের অর্থনৈতিক সংকটে আর্থিক ঋণ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছিল ২০২০ সালের করোনা মহামারীতেও চীন বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতার জানান দিচ্ছে। করোনা মহামারী জানান দিচ্ছে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা চীনের রয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য এটাও বলছেন- চীন হংকংয়ের গণতান্ত্রিক মুভমেন্ট থেকে বিশ্বের মনোযোগ আড়াল করতেই ভারত সীমান্তে সংঘাতে জড়িয়েছে চীন।
চীন- ভারতে একটি কনভেনশনাল ওয়ার হলে ভারত হয়ত অনেককেই পাশে পাবে কিন্তু চীনকে লড়তে হবে একা। সর্বোচ্চ রাশিয়া পাশে থাকতে পারে।সে সম্ভাবনাও কম। সে জন্যই চীন নিকট প্রতিবেশীদের কাছে টানতে মরিয়া, সে ছোট হোক কিংবা বড় হোক। চীন ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে মুক্তার মালার মত(স্ট্রিং অব পার্লস) এশিয়ার দেশগুলোকে একটার সাথে আরেকটাকে গেথে দিচ্ছে যাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট বলা হচ্ছে। আমেরিকার বাধার কারণে ভারত এই প্রজেক্টে নেই। এ অঞ্চলে চীনের 'স্ট্রিং অব পার্লস' পলিসির কাছে আমেরিকার 'পিভট টু এশিয়া' পলিসি মারাত্মকভাবে মার খাচ্ছে। গালওয়ান ভ্যালির সীমান্ত সংকট নিঃসন্দেহে চীনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্বকেও অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে, কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের পাশে কেউ নেই। বাংলাদেশ চাইলে এখন চীনকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানেও ব্যবহার করতে পারে। ভারতের কাছ থেকে একটু নড়ে গেলেই বাংলাদেশের সামনে চীনের পক্ষ থেকে সম্ভাবনার বিশাল দুয়ার খুলে যাবে। চীন -ভারতের সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘর্ষ দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি রাষ্ট্রকেই মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে।
গালওয়ান ভ্যালি সংঘর্ষের মাধ্যমে চীন- ভারতকে কী এই বার্তাই দিতে চাইছে যে -দক্ষিণ এশিয়ার আগামী দিন গুলো ভারতের নয়, চীনে?
লেখক: এমফিল গবেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়