'আই হেট পলিটিক্স' বলে আর দায় এড়ানো যাবে না!

  © টিডিসি ফটো

সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানে বহু উঠতি তরুণের প্রোফাইল পরিচিতিতে চোখে পড়ে 'আই হেট পলিটিক্স' শব্দগুচ্ছটি। কার্য-কারণ চিন্তা না করে বিষয়টাকে একটা স্মার্টনেসের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে তরুণ আবেগ। রাজনীতি বিমুখতা কি আসলেই স্মার্ট চিন্তা? আমি কোনো সিদ্ধান্ত চাপাবো না, শুধু আরেকবার চিন্তা করতে বলবো!

ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই এক বক্তব্যে বলেছিলেন- "America is not run by the President, but by the System"। একইভাবে উন্নত বিশ্বের সবগুলো দেশই তাদের নিজস্ব একটা সিস্টেমের মধ্যে চলে। তাদের সরকার আসে-সরকার যায় কিংবা রাজনৈতিক দলের হাতে সরকার পালাবদল হয় কিন্তু রাষ্ট্রনীতি বদলায় না, বদলায় না দেশের সৌভাগ্যও।

বাংলাদেশ কি সরকার একা চালায়? করোনা মহামারী শুরুর আগে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের এক সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা, বর্তমানে দলের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য দুঃখ করে বলছিলেন, তার ব্যক্তিগত কাজ, তারপরও ফাইল ছুটাতে মন্ত্রীকে দিয়ে ফোন দেওয়ানো লেগেছে। যদিও এই উদাহরণটি পরিপূর্ণ সিস্টেমের প্রতিচ্ছবি নয়, তবুও স্বাক্ষী দেয় যে, সিস্টেমের কাছে কোনো না কোনো জায়গায় আমরা সবাই অসহায়।

বাংলাদেশে কোনো কিছু ঠিক পথে চলছে কি? দৈনিক কোটি টাকা আয়ের উন্নত হাসপাতালে এসি বিস্ফোরণে সেবাপ্রার্থীরা মারা যায়। স্বয়ং দেশের রাজধানীতেই মহামারী করোনার সাথে পাল্লা দিয়ে ডেঙ্গুতে লোক মরে। প্রতিদিন রোড এক্সিডেন্টে মৃত্যুর হার করোনায় মৃত্যুর চেয়ে কম নয়। পত্রিকায় পাতায় গণপরিবহনে কিংবা রাজপথে ধর্ষণের মতো ঘটনা ছাপানো এখন স্বাভাবিক। ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়েছে, কৃষক নিঃস্ব হয়েছে, দালালের পেট ভারী হয়েছে। মুমূর্ষু শিক্ষাখাত, ভেঙ্গে পড়া চিকিৎসা খাত আর কিংকর্তব্যবিমুঢ় বিচার বিভাগ নিয়ে দেশটা পঙ্গুর মতো এগুচ্ছে।

এক মাসের লকডাউনে মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে হাজার হাজার লোক রাস্তায়— কেউ চাকুরী বাঁচাতে, কেউবা পেটের দায়ে ত্রাণের আশায়! সংবিধানে প্রতিজ্ঞা করা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা কিংবা শিক্ষা কোনো কিছুরই নিরাপত্তা আছে? জীবনের নিরাপত্তা চাওয়া যে আমাদের অধিকার সেটাও আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। অথচ, গত ১০ বছরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশী ধনী বেড়েছে বাংলাদেশে, দেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনুমোদন!

একথা অকপটে স্বীকার না করে উপায় নাই যে, প্রায় সবগুলো ঘটনা প্রবাহে কোনো না কোনো ভাবে রাজনৈতিক ব্যক্তির জড়িত থাকার বিষয়টা প্রমাণ করা সহজ হবে। কিন্তু, রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই কি দেশের সব? দেশের স্বার্থ কেন্দ্রীক সব সিদ্ধান্ত একা নেওয়ার ক্ষমতা কিংবা যোগ্যতা কি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের আছে?

প্রাচীন চাইনিজ প্রবাদে বলা হয়েছে, যে যেই কাজে অভিজ্ঞ সেকাজে সেই প্রাকৃতিক নেতা। ধরেন, আপনি গ্রামে গেলেন। একটা বাঁশের সাঁকো পার হতে হবে। এর আগে কখনো সাঁকো পার হন নাই, কৌশল জানেন না। গ্রামের এক ৫ বছরের শিশু আপনাকে কৌশল শেখানোর দায়িত্ব নিলেন। সঠিক কৌশল সঠিকভাবে রপ্ত করলেই আপনি নিরাপদে সাঁকো পার হতে পারবেন। শিশুটির কৌশল কিংবা আপনার শিক্ষায় ত্রুটি থাকলে পানিতে পড়া স্বাভাবিক। বয়সে, ক্ষমতায় কিংবা বিবেচনায় আপনি যতই বড় হন না ঐ পাঁচ বছরের শিশুই কিন্তু সাঁকো পারাপারের সময়টুকুতে আপনার নেতা।

তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতি, রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক সচেতনতার মধ্যে তাত্ত্বিক ও বাস্তবিক তফাৎগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। নিজের রাজত্বে আমরা সবাই রাজা, সবাই নেতা। তবে সবসময় কি নিজের রাজত্বে বিচরণ সম্ভব? অন্যের বিশৃঙ্খল রাজত্ব কি আমাকে ভোগায় না? নিজের নেতৃত্বদানের জায়গাটুকুতে আমি আমার মনের মতো করে না গুছালে আরেকজন এসে জায়গাটা নষ্ট করে দেওয়া স্বাভাবিক।

বিখ্যাত গ্রীক রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস নাগরিকদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, "রাজনীতি নিয়ে আপনার মাথাব্যাথা থাকতে নাই পারে, কিন্তু আপনাকে নিয়ে রাজনীতির মাথাব্যাথা ঠিকই আছে"। আপনাকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করাই রাজনীতির কাজ। স্বাধীনতা আপনার হাতে যে, আপনি কি 'আই হেট পলিটিক্স' বলে পরোক্ষভাবে অপ-রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন, নাকি নিজের বলয়ে থাকা নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগটুকু কাজে লাগিয়ে একটা কার্যকর সিস্টেম গঠনে ভূমিকা রাখবেন!

এই দেশটার গোঁড়ায় উঁইপোকা ধরেছে। উঁইয়ের মুখে তুঁত ছিটাতে হবে এখনই। নতুন প্রজন্মের ভাবতে হবে দেশ নিয়ে। হতে হবে রাজনৈতিক অধিকার সচেতন। নিজের রাজত্বে দেশকে নেতৃত্ব দিতে হবে সামনে থেকে৷ সোচ্চার হতে হবে অধিকার নিয়ে। যুক্ত থাকতে হবে যৌক্তিক পরিবর্তনের আন্দোলনে। 'আই হেট পলিটিক্স' বলে আর দায় এড়ানো যাবে না। রাজনীতি নয়, সমস্যাযুক্ত সিস্টেমকে ঘৃণা করাই এখন স্মার্টনেস!

লেখক: এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট


সর্বশেষ সংবাদ