করোনার লাশও পঁচে যাবে কিন্তু যারা বাচঁবে তাদের কী হবে?
আমি তখন মস্ত বড় জ্ঞানী। বত্রিশ বছর আগের কথা। জ্ঞানের তো অভাব ছিল না, কিন্তু ডিগ্রীটা দরকার ছিল, তাই ইউনিভার্সিটিতে এ্যাডমিশন নিলাম। দুনিয়ায় যেমন ‘বারো রকম মানুষ’ আছে, গরুদেরও ঠিক ওই রকমফের আছে। বারো রকম কিনা বলা মুশকিল তবে কোন কোন গরু দেখতাম সামনে যা পায় তাই খায়, মাটি পর্যন্ত খেয়ে ফেলে। আবার কোন গরু দেখতাম খুব বেছে বেছে ঘাস খায়, প্রথমে নাক দিয়ে শুঁকে দেখে, ভাল লাগলে খায়। পছন্দ না হলে এক ধরণের অদ্ভুত শব্দ করে যার মানে দাঁড়ায়, ‘উহ্ কি বিশ্রি গন্ধ, মানুষের গায়ের মত’।ছোটবেলায় আমার অবস্থা ছিল ওই দু’শ্রেনির গরুর মতই। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে ওই দ্বিতীয় শ্রেনীতেই পড়তাম। ঝাল ছিল দু’চোখের বালি, মিষ্টি ছিল অতি পছন্দের। অনেক বছর পর্যন্ত ভাবতাম যে টাকা-পয়সা হলে মিষ্টির দোকান দেব। আমার না খাওয়ার তালিকাটাও বেশ লম্বা ছিল। কিন্তু বই পড়ার বিষয়ে ওই মাটি খাওয়া গরুর মতই, কোন রকম বাছ-বিচার নাই। সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, সমাজবিজ্ঞান, বাংলা, ইংরেজী যা সামনে পেতাম পড়ে ফেলতাম।
মায়ের বইয়ের বেশ ভালো সংগ্রহ ছিল। যখন পড়া শিখিনি, মায়ের মুখে ওই সব বইয়ের গল্প শুনতাম। সীতানাথ বসাকের বারো খানা আদর্শ লিপি গবেষণা শেষে নিজেই পড়া শিখে গেলাম। কিন্তু ওই কয়খানা বই পড়তে তো বেশি দিন লাগে না, অতএব রিভিশন চলতো। অন্য সব বইতো বটেই, এমনকি মকছেদুল মোমঈনও অনেকবার পড়া হয়েছে। বড়বোন বড় ক্লাসে পড়ত, তার ক্লাসের বইগুলোও পড়ে ফেলতাম। চাচাতো ভাইরা বিভিন্ন ক্লাসে পড়ত, তাদেরও বাংলা ইংরেজী বইয়ের গল্পগুলো জানা হয়ে যেতো। হাইস্কুলে আরো কিছু বই ধার করে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কলেজে ভর্তির সময়ই আমি মোটামুটি জ্ঞানী। হোস্টেল জীবন, পুরাই স্বাধীন। ক্লাসের বাধ্যবাধকতা নাই, গেলেও ভাল, না গেলে আরও ভাল। হোষ্টেলে অনেকের কাছেই গল্পের বইটই পাওয়া যেতো। তখনও আমার স্বভাব ওই মাটি খাওয়া গরুর মতই, সামনে যা পাই তাই পড়ি। শরৎ সমগ্র আগেই পড়া ছিল, কবিতা বাদে রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাস, নাটকও শেষ। ফাল্গুনী, আশুতোষ, নীহার রঞ্জন, নজিবুর, আকবর হোসেন, নসীম হিজাযী, বনফুল, নিমাই, রোমেনা আফাজ তো কলেজে আসার আগেই শেষ। কলেজে এসে হুমায়ুন আহমেদ, কাজী আনোয়ার হোসেন (সেবা প্রকাশণী), ইমদাদুল হক মিলন এমনকি বটতলার বই পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেলাম।
কলেজ-ইউনিভার্সিটির গ্যাপে দু’পাতা মার্ক্স-লেনিন, মাও সেতুং পড়ার সুযোগ হলো। ম্যাক্সিম গোর্কীর ‘মা’, নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির ‘ইস্পাত’ তো কতবার যে পড়েছি। যখন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হলো, তখন মনে হলো জগতের সব আমার আগেই জানা হয়ে গেছে। ছোটখাটো নয়, আমি মস্ত জ্ঞানী, ধরাকে মনে হতো জাস্ট একটা সরা বৈ কিছু নয়। তখন অনেক প্রিয় লেখককে চটুল মনে হতে লাগল, রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’র অমিত রে মতই বুদ্ধিজীবীদের ‘Overrated’ মনে হতে লাগল, বিখ্যাত গল্প উপন্যাসকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা শুরু করলাম, যেমনটা জ্ঞানী লোকেরা করে আর কি। ভাবটা এমন যে গল্প, উপন্যাস কিংবা কবিতা-এক ধরণের ভাব বিলাসিতা, এসব আমার মত জ্ঞানীদের জন্য না। ওই সময় নীলক্ষেত, পুরানা পল্টনসহ ঢাকা শহরের অনেক ফুটপাতেই মস্কো প্রকাশনী, প্রগতি প্রকাশনী আর ও কি কি যেন প্রকাশনী ছিল, খুব কমদামে রুশ লেখকদের অনুবাদিত বাংলা ও ইংরেজী বই পাওয়া যেত। একদিন নীলক্ষেতের ফুটপাতে ‘Resurrection’ নামে একখানা ঢাউস সাইজের বই দেখলাম। দামে সস্তা আবার ঋষির মত চেহারার Tolstoy মলাটে, কাজেই, লোভ হলো, পকেটে যা টাকা ছিল তাতে হয়ে গেল। সামান্য যা থাকলো তা দিয়ে দু’টো ডালপুরী খেলাম, সাথে ফ্রি পেঁয়াজ কাটা। নীলক্ষেতের সেই রেস্টুরেন্টগুলো এখনও আছে, কিন্তু বহু বছর ঢোকা হয় না। ওখানকার ডালপুরী আমি এখনও মিস করি।
ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস শুরুর পরে আমার জ্ঞানের বোঝা মাথা থেকে নামা শুরু হলো। দু’পাতা বই পড়া আর ইংরেজী সাহিত্য বোঝা এক নয়- হাড়ে হাড়ে টের পেতে লাগলাম। শিক্ষক এবং সহপাঠিদের সাথে যতই আলাপ হতে লাগলো, ততোই নিজেকে অকিঞ্চিতকর মনে হতে লাগলো। সহপাঠিদের অনেকেই যখন ঠোঁট আর জিহ্বার কেরামতি দেখিয়ে ‘Forrest Gump’ ছবির নায়ক Tom Hanks এর মত অ্যালাবামার ডায়ালেক্টে ইংরেজি বলত, আমি হা করে বক্তার মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম। একদিন আমারও হবে-ভেবে নিয়ে সান্ত্বনা খুঁজতাম। তারপর তেত্রিশ না হলেও বত্রিশ বছর কেটে গেছে, আমার হয়নি, আর হবেও না। যাহোক, ক্লাসের পড়াশুনা, Tutorial, Assignment নিয়ে কিছুটা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। হঠাৎ করেই ‘sine die’ (অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ) এবং হল ছাড়ার নির্দেশ। অগত্যা বাক্স গুছিয়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে যাত্রা। ক্লাসের বইয়ের সাথে টলষ্টয় সঙ্গে নিয়ে নিলাম। বাসের ঝাঁকুনীতে পড়া হয় না, তারপরও ‘Resurrection’ হাতে। আমি যে বিরাট বিদ্বান সহযাত্রীদের এটা বোঝানোর সুযোগ তো আর হাতছাড়া করা যায় না। বাসে পড়া না হলেও বাড়িতে গিয়ে পুরো বইটা সত্যিই পড়ে ফেললাম। ‘War and Peace’ আর ‘Anna Karenina’ দিয়েই সাধারনতঃ টলষ্টয়কে চেনা হয়, ‘Resurrection’ খুব পাঠকের জানা। কালের পরিক্রমায় Anna Karenina, War and Peace পড়েছি, বই দু’টোর উপর নির্মিত একাধিক মুভি ও দেখা হয়েছে। যে যাই বলুক, আমার কাছে সেরা ‘Resurrection’ ই, টলষ্টয়ের লেখা শেষ উপন্যাস। রাশান নামগুলো আমার কাছে জটিল লাগে, মনেও থাকে না, তবে এত বছর পরেও আমার নায়িকার Katusha নামটা মনে আছে, যদিও তার আসল নাম ছিল বোধহয় Maslova। উপন্যাসের নায়কের নামের অংশ বিশেষ মনে আছে-Dimitri. নানা ভাষায় উপন্যাসের উপর মুভি নির্মিত হয়েছে। আমার মত যারা উত্তম কুমারের ছবি পছন্দ করেন তারা নিশ্চয়ই উত্তম- সুপ্রিয়া জুটির ‘জীবন জিজ্ঞাসা’ দেখেছেন। Resurrection র কাহিনী নিয়েই ‘জীবন জিজ্ঞাসা’ নির্মিত হয়েছে।
এই অঞ্চল বিশেষ করে বাঙালী সমাজে গল্প, উপন্যাস, নাটক কিংবা সিনেমায় নারী ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় তথাকথিত অর্থে কলঙ্কিত হলে দর্শক কিংবা পাঠকেরা তাকে আর জীবিত দেখতে পছন্দ করে না, ফলে, তার মৃত্যু ঘটানো অনিবার্য হয়ে উঠে। Resurrection-এ না থাকলেও ‘জীবন জিজ্ঞাসায়’ নায়িকা রাধা ওরফে শেফালীর মৃত্যু ঘটে। কাছাকাছি সময়ে হিন্দি ভাষাতেও এই উপন্যাস অবলম্বনে ‘Barkha Bahar’ নামে একটা মুভি নির্মিত হয়। মুভিতে কিছুটা Tolstoyএর উপন্যাসের নায়ক Dimitri তার অতীতের পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়, এবং পাপের প্রায়াশ্চিত্তের মাধ্যমেই তার পূণর্জন্ম হয়। Katusha’ র প্রতি তার অন্যায় সংশোধনের জন্যেই তার সাথে সাইবেরিয়া যায়। হিন্দি ছবিতেও নায়ক রাহুল রূপী Navin Kumar তার পাপের প্রায়াশ্চিত্তের জন্য নায়িকা গঙ্গা ওরফে চম্পা রানীকে অনুসরন করে। আমাদের তো আর সাইবেরিয়া নাই, তাই সাজা ভোগের জন্য নায়িকাকে কালাপানি পাঠানো হয়। মূল উপন্যাস এবং ছবির দুটোর কাহিনী এটাই যে নায়ক সমাজের উচু তলার মানুষ, আশ্রিতা অনাথ নায়িকার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে দূরে চলে যায়। নায়িকা গর্ভবতী হয়ে আশ্রয় থেকে বিতাড়িত হয়, ভাগ্যের বিড়ম্বনায় বেঁচে থাকার প্রয়োজনে নাম পাল্টিয়ে পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সেখানেও মিথ্যা খুনের দায়ে সাজা প্রাপ্ত হয়। প্রতিষ্ঠিত (Jury, Barrister) নায়ক যখন সাজা প্রাপ্ত বা বিচারাধীন নায়িকাকে চিনতে পারে তখন নায়ক তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয় এবং মানসিক পীড়ন থেকে পরিত্রানের জন্যই সাইবেরিয়া কিংবা কালাপানি গমন করে নায়িকাকে বিয়ে করতে চায়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশ হিসেবে যেমন বড়, সেখানকার মানুষদের জীবনের জমিনটা ও বেশ বড়ই ছিল, যাকে বলে, “Larger than the life”. সে কারনে সেখানকার গল্প-উপন্যাসগুলোও বেশ বড়। শেষ মূহূর্তে ফায়ারিং স্কোয়াড থেকে পরিত্রান পাওয়া Fyodor Dostoevsky’র মাষ্টারপিস ‘Crime and Punishment’ মনে হয় অনেকেই পড়েছেন। নায়ক Raskolnikov সেই সুদখোর বুড়িকে হত্যার পর বিবেকের তাড়নায় দগ্ধ হতে হতে প্রায় পাগল হয়ে যায়। অনুশোচনায় উম্মত্ত প্রায় রাসকলনিকভ এক সময় উপযাচক হয়েই পুলিশের কাছে হাজির হয়, হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে। শাস্তি ভোগের জন্য হৃষ্টচিত্তে সাইবেরিয়া চলে যায়। সাইবেরিয়াতে তার প্রেমিক Dunya ওরফে Sonya’র ভালোবাসা আর যত্নে ধীরে ধীরে Raskolnikov’র পূণর্জন্ম লাভ হয়। রোমান্টিক কবি S.T. Coleridge’র দীর্ঘ কবিতা ‘The Rime of the Ancient Mariner’র অদ্ভূত দেখতে নাবিকটা বিনা কারনেই শুধুমাত্র খেয়ালের বশে সমুদ্রে উপকারী Albatross পাখি মেরে ভয়ানক বিপদে পড়ে। সঙ্গী-সাথীরা একে একে মারা পড়ে, নিজেও পিপাসায় মূমূর্ষ। এরকম অবস্থায়, জীবের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন আর অনুতাপের মাধ্যমেই পরিশুদ্ধ হয়, সে যাত্রা রক্ষা পায়, একন যেখানে যাকে পায়, ওই গল্প শুনিয়েই প্রায়াশ্চিত্ত করে।
দুনিয়া জুড়ে মহামারী করোনা কালে অনেকেই মনে করে, বিশ্বে যারা পাপী-তাপী তারা সবাই অনুতাপের দহনে দগ্ধ হচ্ছে। তাদের অন্যায় আর খামখেয়ালি আচরণের জন্য তারা অনুশোচনায় ভুগছে, তারা ভীষন অনুতপ্ত। তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে, এবার তাদের বিরাট ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। করোনার পরে পরিবর্তিত বিশ্বে মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম, ভালোবাসাও নাকি বাড়বে। বিশ্বব্যাপী সংঘর্ষ, সংঘাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও হানাহানি বন্ধ হবে। Dmitri যদি এত বছর পরে Katusha কে দেখে অনুশোচনার আগুনে পুড়ে পরিশুদ্ধ হয়, কিংবা Raskolnikov যদি শুধুমাত্র বিবেকের তাড়নায় অনুতপ্ত হয়ে খুনের দায় স্বীকার করে নেয় (যেখানে তার ধরা পড়ার সম্ভাবনাই ছিল না) তাহলে করোনার মত এত বড় ঘটনা কেন মানুষের বিবেককে নাড়া দেবে না। কাজেই সব মানুষ ভালো হয়ে যাবে। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতেও চাচ্ছেন কিংবা জানাচ্ছেন যে, করোনায় বেঁচে গেলে কে কি করবেন।
রোগ, ব্যাধি কিংবা মহামারী ইতিহাসে নতুন নয়। দশ হাজার বছর আগে শিকার নির্ভর জীবনযাত্রা থেকে বেরিয়ে এসে মানুষ যখন সমাজবদ্ধ হয়ে কৃষিকাজে যোগ দেয় তখন থেকেই মরামারীর শুরু। কলেরা, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠরোগ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, গুটিবসন্ত ইত্যাদি ওই সময় থেকেই ছড়িয়ে পড়ে। সমাজ তৈরি হলেও এখনকার মত ‘সামাজিক দূরত্ব’ না মানার কারনেই আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যেত, কোন কোন অঞ্চল মহামারীতে জনশূন্য হয়ে পড়ত। করোনার মতই ‘Yersinia pestis’ নামের একটা অদৃশ্য ব্যাকটেরিয়া কয়েকশো বছর মানুষকে ভালই ভেলকিবাজি দেখিয়েছে। যীশুখ্রিষ্ট্রের জন্মের শ’দেড়েক বছর পর থেকে ওই ব্যাকটেরিয়া প্লেগ রোগের বিস্তার ঘটায়। এরপর প্রায় ১৭০০ বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে ফিরে বিভিন্ন নামে প্লেগ মহামারী কোটি কোটি মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। তারপরেও মানুষ বদলায়নি, স্বভাবের তেমন কোন পরিবর্তনই হয়নি। প্লেগ ছাড়াও কলেরা, কুষ্ঠরোগ এবং গুটি বসন্ত ও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মহামারী রূপে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে।
তবে বিশ্বের ইতিহাসে এককভাবে সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণ কেড়েছে স্প্যানিশ ফ্লু। ১৯১৮-১৯২০-এই তিনটি বছরে বিশ্বের প্রায় পঞ্চাশ কোটি মানুষ স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়। সে যুগে ইন্টারনেট ছিল না, WHO কিংবা জাতিসংঘের জন্ম হয়নি, ‘Worldometer’ কাজ করেনি, ফলে মারা যাওয়ার সঠিক সংখ্যা না পাওয়া গেলেও ধরে নেওয়া হয় পাঁচ থেকে দশ কোটি মানুষ মারা যায়।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে যখন স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছিল তখনও কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বন্ধ হয়নি। স্প্যানিশ ফ্লুতে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর সাথে পাল্লা দিয়েই মহাযুদ্ধ চলছিল। বরং যুদ্ধরত সৈন্যদের যাতে মনোবল না হারায়, তাই যুদ্ধরত আমেরিকা-ইউরোপ স্প্যানিশ ফ্লুর সংবাদ পত্রিকায় ছাপতে দিত না, ব্লাক আউট করত। ব্যতিক্রম ছিল, স্পেন-যুদ্ধে অংশ নেয়নি, ফলে স্পেনের পত্র-পত্রিকায় ফ্লুর সংবাদ নিয়মিত ছাপা হতো, লুকোচুরি ছিল না বলেই এ নিয়ে বিস্তর গবেষণাও স্পেনে হয়েছিল। ফলে স্পেন এই রোগের উৎসস্থল না হলেও অন্যান্য দেশ এই ফ্লুর নাম দেয় ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। যেমন কেউ কেউ করোনাকে উহান কিংবা চীনা ভাইরাস বলে থাকে।
মহামারী করোনার কারণে মানবজাতি আজ মহাসংকট কাল অতিক্রম করছে। বিশ্বায়নের ফলে করোনা অল্প সময়ের ব্যবধানে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে, বিশ্বের মোট ২১৩ টি দেশ ও ভূখন্ডে করোনা হানা দিয়েছে। সনাক্ত হওয়ার পাঁচ মাসের মাথায় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার কারনেই মানুষ মহাসংকটে পড়েছে। আজকের হিসেবে বিশ্বে ৫৩ লাখ ৩৭ হাজারেরও বেশী মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, মারা গিয়েছে তিন লাখ ৪২ হাজারের বেশী মানুষ আর বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর হার প্রায় ৬.৫%। ইতোপূর্বের মহামারী কলেরা, গুটি বসন্ত,যক্ষ্মা, প্লেগ এবং স্প্যানিশ ফ্লুর মৃত্যুর সংখ্যা ও শতকরা হার অনেক বেশী। আবার জাতীয়, আঞ্চলিক সংঘাত, গণহত্যা, মহাযুদ্ধেও এর চেয়ে অনেক বেশী মানুষ নিহত হয়েছে। তথাপি, বর্তমান বিশ্ব অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অধিকতর সংকটে। ইতোপূর্বে অধিকাংশ মহামারীই ছিল আঞ্চলিক কিংবা আন্তর্জাতিক হলেও তার ব্যপ্তি ছিল অল্প সংখ্যক দেশ কিংবা অঞ্চলে। আবার বিশ্বযুদ্ধ দু’টিতে বিবদমান দেশের সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা, ফলে শুধুমাত্র বিবদমান দেশের জনগনই সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কিন্তু করোনার কারনে সারা বিশ্বের মানুষই ক্ষতির মুখে পড়েছে। করোনা থেকে বাঁচতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার স্বার্থে দেশে দেশে লকডাউন কার্যকর করা হয়েছে। ফলে, কল-কারখানা, দোকানপাট, শপিংমল, বিনোদন কেন্দ্র, অফিস, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে, জলযান, বায়ুযান এবং সড়ক যান বন্ধ হয়। মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা-সবই বন্ধ করা হয়েছে। খোলা ছিল শুধুই হাসপাতাল, নার্সিং হোম আর চিকিৎসা কেন্দ্র। তারপরও প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কোন কোন দেশে সংক্রমন ও মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমলেও নতুন নতুন দেশে আক্রান্ত বাড়ছে।
“মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারনে-অকারনে বদলায়”- শহীদ মুনীর চৌধুরীর “রক্তাক্ত প্রান্তর” নাটকের এই কথাগুলো প্রায়ই আমার মনে পড়ে। করোনায় যারা মারা যাবে তারা বড়ই হতভাগ্য, মৃত্যুকালে তাদের মুখে পানি দেওয়ার মত আপনজন পাশে না থাকারই কথা। করোনায় মৃত লাশকে অভিশপ্ত বলেই বিবেচনা করা হবে। জানাযা কিংবা দাফনের লোকের সংকট দেখা দেবে, কর্তৃপক্ষ চাইবে কত তাড়াতাড়ি অভিশপ্ত লাশের সৎকারের মাধ্যমে ঝামেলা শেষ করা যায়। তবে করোনায় মারা গেলেও লাশ ঠিকই ই পঁচে যাবে। আর যারা বেঁচে যাবে, অবশ্যই তারা বদলাবে। কিন্তু সে বদল যে ইতিবাচক হবেই এমনটা বলা কঠিন। আসলেই মানুষ সকালে-বিকালে বদলে যায়, কারনে-অকারনেই বদলায়। করোনায় পরে ও নিশ্চয়ই বদলাবে। কিন্তু কেমন হবে সে বদল, Dimitri, ব্যারিষ্টার ইন্দ্র রূপী উত্তম কিংবা ব্যারিষ্টার রাহুল রূপী নভীন কুমারের মতই কি তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হবে, সকল দম্ভ-অহঙ্কার ঝেড়ে ফেলে তারাও কি তাদের ‘victim of crime’ দের কাছে ক্ষমা চাইবে? তারা কি Raskolnikov এর মতই তাদের অন্যায়-অপরাধ স্বীকার করে সাজা ভোগের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হতে চাইবে? তারাও কি Coleridge এর প্রাচীন নাবিকের মতই ‘জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’-ব্রত নিয়ে সমস্ত হিংসা, লোভ, হানাহানি ভুলে সকল মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠবে? নিশ্চয়ই না, কেউ কেউ অবশ্য ‘মন না রাঙিয়ে বসন রাঙালে বোষ্টমী হওয়া যায় না’ জেনেও বসন রাঙাবে, অর্থাৎ উপরে উপরে বদলানোর বেশ ধরবে, ভেতরে বদলাবে না।
অতীতের ন্যায় করোনা মহামারী ও পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। কিন্তু বিশ্ববাসী কখনোই হুবহু আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়বে, মানুষ আরো বেশী স্বার্থপর হয়ে উঠবে। সামাজিক দূরত্ব রক্ষার নামে পরিবারের আকার আরো ছোট হবে। যে সমস্ত সমাজে যৌথ পরিবার প্রথা রয়েছে, সেখানে যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে পারে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা অপরিহার্য় হয়ে পড়বে। পৃথিবীর অনেক দেশেই খাদ্যাভাব এমনকি কোথাও কোথাও দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। আগামী দু’তিন বছরেও পর্যটন শিল্প পূর্বের অবস্থায় ফিরবে বলে মনে হয় না, ফলে পর্যটন নির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোতেও অর্থনৈতিক মন্দা প্রকট আকার ধারন করবে। একই সাথে জ্বালানী তেলের দাম কমায় তেল উৎপাদনকারী দেশসমূহ কিছুটা সমস্যায় পড়বে। তবে, ভালো দিক হচ্ছে, পৃথিবীর সব রাষ্ট্রই নিজেদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কারে মনোযোগী হবে, পাবলিক হেলথ সিস্টেম উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াবে।
করোনায় আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫ তম যা গতকাল ছিল ২৭তম। আজকের হিসেবে দেশে মোট আক্রান্ত ৩২ হাজার ৭৮ জন, ইতোমধ্যে মারা গেছে মোট ৪৫২ জন। ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হওয়ার পর ২৫ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষনা করে মানুষকে ঘরে থাকার অনুরোধ করা হলেও ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর থেকে লাখ লাখ মানুষ সামাজিক দূরত্ব কিংবা স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে গ্রামে চলে যায়। সেটি সংক্রমনের প্রথম পর্যায় ছিল বলেই হয়তো খুব বেশী মানুষ আক্রান্ত হয় নাই। করোনার প্রথম দিকে ঢাকা শহরের অধিকাংশ মানুষই ঘরে থেকেছে, কিছু মানুষ অবশ্য শুরু থেকেই বেপরোয়া ছিল। মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত আক্রান্তের বেশীর ভাগই ছিল ঘনবসতি পূর্ণ এলাকা-ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর। গ্রাম-গঞ্জে আক্রান্তের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম ছিল, তবে গত কয়েকদিন ধরে সেটা বেড়েই চলেছে। ঈদকে কেন্দ্র করে নিষেধাজ্ঞা এবং পরামর্শ উপেক্ষা করে অনেকেই শেকড়ের টানে গ্রামে গিয়েছে এবং এখনও যাচ্ছে। আমার আশঙ্কা (আমি চাই আশঙ্কা মিথ্যা হোক) এবার করোনা শেকড়ে পৌঁছে যেতে পারে। কাজেই, আমাদের সতর্ক হতেই হবে, সাবধানতা অবলম্বনের কোনই বিকল্প নাই। ভ্যাকসিন কিংবা ওষুধ আবিষ্কারে পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন, আশাবাদী হওয়ার মতো সফলতার কথাও শোনা যাচ্ছে। তবে, ব্যাকটেরিয়ার ন্যায় ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে সফলতার খুব বেশী তথ্য এখনও চিকিৎসাকর্মীদের হাতে নেই, তাই ভরসা ঐ ভ্যাকসিনেই। অন্যান্য ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন পেতে বছরের পর বছর লেগেছে একথা সত্যি। তবে করোনা যেহেতু নতুন ভাইরাস নয়, এটি সার্সের সেকেন্ড জেনারেশন, তদুপরি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এখন অনেক এগিয়েছে এবং শক্তিশালী আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলো ‘worst victim’, সেহেতু, অচিরেই ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে। চ্যালেঞ্জ আরো আছে- ভ্যাকসিন আবিষ্কারে সাফল্য আসলেও আমাদের দেশে কখন সেটি সহজলভ্য হবে। তাই যতদিন তা না হয়, ততদিন, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে। আবার আক্রান্ত হলে ‘বল বল বাহুবল’ অর্থাৎ আপনার লড়াই আপনাকে একাই লড়তে হবে, কোন ডাক্তার আপনার খুব একটা উপকার করতে পারবেন না। কাজেই সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বনের মাধ্যমেই আপনাকে করোনা থেকে রক্ষা পেতে হবে। সে কারনেই আমার পরামর্শ গুলো হলো-
### সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন;
### অতি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাবেন না, কেননা, বাইরে যাওয়া মানেই আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়া;
### বাইরে গেল যথাযথ ভাবে মাস্ক পরুন, অবশ্যই শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন;
### অপরিষ্কার হাতে কখনোই নাক, মুখ এবং চোখ স্পর্শ করবেন না;
### বাইরে যাতায়াত থাকলে অবশ্যই বাসার বয়স্ক, জটিল রোগে ভোগা এবং গর্ভবতী সদস্য থেকে দূরে থাকুন;
### ঈদ করতে যারা শেকড়ে গেছেন, দয়া করে বয়স্ক সদস্যদের সাথে যথাযথ দূরত্ব বজায় রাখুন;
### করোনার কোন উপসর্গ দেখা গেলে গোপন না করে নিজেই অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যান এবং পরীক্ষা করান;
### করোনা পজিটিভ হয়ে গেলে আতঙ্কিত হবেন না, অন্য কোন শারীরিক সমস্যা না থাকলে আপনি এমনিতেই সুস্থ হয়ে যাবেন;
### যারা প্রতিদিন বাইরে যাচ্ছেন, তারা আক্রান্ত হতেই পারেন ধরে নিয়ে করোনা মোকাবিলায় শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি গ্রহন করুন;
### যাচাই বাছাই না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধমের সব তথ্য বিশ্বাস করবেন না এবং শেয়ারও করবেন না। যাচাই-বাছাই করার জন্য নির্ভরযোগ্য গনমাধ্যম কিংবা ব্যক্তির সহায়তা নিতে পারেন;
### WHO, IEDCR এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন, নিরাপদ থাকুন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র নয় মাসে এদেশের ত্রিশ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়ে পাকিস্তানের আধুনিক সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের পরাজিত করেছে। বাঙালী অতীতে কখনো পরাজিত হয় নি, এবারও হবে না, এ দূর্যোগ একদিন কেটে যাবে। আমি বিশ্বাস করি, বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ভবিষ্যদ্বানী ভুল প্রমান করে দিয়েই আমরা করোনাকে জয় করতে পারবো। কেননা,
“..deep in my heart
I do believe
We shall overcome, some day.”
লেখক: অতিরিক্ত কমিশনার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি)