শিক্ষা নাকি স্বাস্থ্যবান্ধব— কেমন বাজেট চাই
জাতীয় সংসদে আগামী ১১ই জুন আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। করোনা মহামারিতে অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারনে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে জনমনে চলছে নানা জল্পনাকল্পনা। এরই মধ্যে সংবাদপত্রের মাধ্যমে বাজেটের সম্ভাব্য আকার ও খাতভিত্তিক বরাদ্দের কিছু আভাসও পাওয়া গেছে।
এদিকে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আগামী বাজেটকে আরও অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে ওয়েবসাইটের মাধ্যম সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে মতামত গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রতিবছরের বাজেটে শিক্ষাখাত থাকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মূল আলোচনায়। তবে এবার শিক্ষার পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্থবিরতা নিরসণ এবং স্বাস্হ্য খাতও আলোচনায়। আসন্ন বাজেট নিয়ে কি ভাবছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তা তুলে ধরেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী— এমদাদুল হক সরকার
অর্থনৈতিক স্থবিরতা নিরসণে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ চাই
কুতুব উদ্দিন
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
নোবেল করোনা ভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর যে ধস নেমেছে তা বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতি পুনর্গঠন করতে হবে। প্রায় দুই মাস ধরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর লকডাউনে থাকা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও শ্রমিক এবং প্রান্তিক চাষিদের কর্মহীন হয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে এবারের বাজেটে কর্মসংস্থান, শিল্প ও কৃষি খাতে উৎপাদন সচল করাসহ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার করার মতো উপাদান থাকতে হবে।
যে খাতগুলো ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে সেগুলোকে রিকভার করতে প্রয়োজনে ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করা যেতে পারে। অন্ন, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রশাসন ও পোশাকশিল্প এ খাতগুলোর প্রতিও গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। বিশেষভাবে চিকিৎসা খাতে বাজেটের বড় অংশ রাখা যেতে পারে। চিকিৎসা খাতে নতুন নতুন চিকিৎসা-সামগ্রী ক্রয় থেকে শুরু করে নতুন হাসপাতাল নির্মাণ, স্বাস্থসেবার মান বাড়ানো, ডাক্তার ও নার্সদের গবেষণার সুযোগ ও নিরাপত্তা জোরদার করে এমন বাজেট ঘোষণা করতে হবে।
করোনা পরবর্তী দেশ পুনর্গঠণের দিকে লক্ষ্য রেখে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। ঋণ-সুদের হার হ্রাসকরণ, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে থাকে এমন প্রণোদনা বাজেট ঘোষণা করা করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম-মান নির্ধারণ করা যেতে পারে। যার দরুন সারাদেশে একই খুচরামূল্যে পণ্যগুলো বিক্রি করবে। সর্বোপরি কৃষক, দিন মজুর, প্রবাসী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি নির্ভর বাজেট প্রণয়ণ করতে হবে। তারা বাঁচলে বাঁচবে দেশ, হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ।
শিক্ষা-প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ চাই
আব্দুল কাদের উজ্জ্বল
একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আসন্ন বাজেটে শিক্ষা, প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ ও এর কার্যকর বাস্তবায়ন হোক, এটাই চাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগের চেয়েও অনেক বেশি স্নাতক বেরোচ্ছেন অথচ সেই তুলনায় কাজের সুযোগ বাড়েনি। তাই কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্রে আরও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রত্যাশা করছি।
ডাক্তার-নার্স ও ফার্মাসিস্টদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি চাই
তানভীর আহমেদ রাসেল
ফার্মেসী বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের নাজুক পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তাই সময় এসেছে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতকে আসন্ন বাজেটে বিশেষভাবে নজর দেওয়া। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হয় ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট ও নার্সের সমন্বিত চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশের হাসপাতাল গুলোতে এখনো গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের জনসাধারণ। স্বাস্থ্যখাতের নানান দাপ্তরিক কাজে ফার্মাসিস্ট না থাকায় যুগোপযোগী ও যথার্থ সিদ্ধান্ত নিতে অনেকটাই হিমশিম খাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
তাই আসন্ন বাজেটে স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি ফার্মাসিস্টদের হসপিটালে নিয়োগ ও বিসএসের মাধ্যমে ফার্মাসিস্টদের স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি করছি।
শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো হোক
মো. কামরুল হাসান
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত।করোনার কারনে অনেকের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি চাকরি হারিয়েছেন। টিউশন করে যারা পড়ালেখার খরচ চালাতেন বর্তমানে সেটাও সম্ভব হচ্ছেনা। তাই শিক্ষাখাতে বরাদ্ধ বৃদ্ধিসহ করোনা উত্তর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত উপবৃত্তির আওতায় আনা হোক।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল পান না। গবেষণা সহযোগী হিসেবে যেসব শিক্ষার্থী কাজ করেন, তাঁদের পারিশ্রমিক দেওয়ার মতো সুযোগ শিক্ষকদের থাকে না। ফলে পড়ালেখার পাশাপাশি আয়ের জন্য টিউশন বা অন্যান্য কাজের দিকে ঝুঁকলেও গবেষণায় আগ্রহী হন না শিক্ষার্থীরা। এবারের বাজেটে গবেষণার জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হোক।
বেকারত্ব নিরসণে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা চাই
আব্দুর রহমান খান
আইন বিভাগ
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস
করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য একটি বাস্তবমুখি বাজেট অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং শিল্প ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে লক্ষ্য রেখে পরিকল্পনা অনুযায়ী বরাদ্দ দিতে হবে। কেননা উল্লেখিত বিভাগ গুলো দেশের উন্নোয়ন কে ত্বরান্বিত করবে। বেকারত্ব সমস্যা বাংলাদেশে প্রকট আকার ধারণ করেছে।
তাই এই সমস্যা সমাধানের জন্য আত্মকর্মসংস্থান, স্বনির্ভর ও উদ্যোক্তা হওয়ার জন্যে উৎসাহ ও প্রণোদনা দিতে হবে। আয়কর উত্তোলনে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। করোনায় যেসব খাতে নড়বড়ে অবস্থা, সেসব খাতে বরাদ্দ বেশি দিতে হবে। সরকারি চাকুরীতে যে পদগুলো খালি রয়েছে সেগুলো প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূরণ করারসহ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকনির্দেশনা আসন্ন বাজেটে থাকলে অনেকাংশেই বেকারত্ব হ্রাস পাবে।
শিক্ষা ও কৃষি নির্ভর বাজেট চাই
মাহফুজ কিশোর
বাংলা বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসের সবচাইতে বড় বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তিখাতে ব্যয়ের পরিমাণও ছিল সর্বোচ্চ (১৫.২%)। এটা নিঃসন্দেহে আশার কথা। শিক্ষাব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এবারও তার ধারাবাহিকতা রেখে লকডাউনের ক্ষতি পোষাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত।
কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ হলেও বাজেট স্বল্পতার দরুণ কৃষকরা উন্নত প্রযুক্তির চাষাবাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে করে কৃষির সামগ্রিক উন্নয়ন হচ্ছে না। তাই কৃষিখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প নেই। লকডাওনে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে শ্রমিকদের কারিগরি প্রশিক্ষণ ও কর্মক্ষেত্রে তার বাস্তবিক প্রয়োগ এবং তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে বাড়তি বরাদ্দ জরুরি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সারাবিশ্বের মতো দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়বে। তবে একটি সুপরিকল্পিত ও বাস্তবমুখী বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সেই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করি।