১৬ মে ২০২০, ১৯:৫৬

ভারতের চিপকো আন্দোলন বনাম বাংলাদেশের যুক্তিতে মুক্তি মেলেনা

  © টিডিসি ফটো

বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে আন্দোলন গোটা পৃথিবী জুড়েই হচ্ছে। তবে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। এমনই একটি পরিবেশবাদী আন্দোলন হলো চিপকো আন্দোলন। গাছ ও বন রক্ষার জন্য গাছকে জড়িয়ে ধরে যে অহিংস আন্দোলন হয়েছিলো সত্তরের দশকে তাই চিপকো আন্দোলন নামে পরিচিত।

হিন্দিতে চিপকো শব্দটির অর্থ আলিঙ্গন করা, আটকে থাকা। আর গাছকে আলিঙ্গন করার মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনটি গড়ে উঠেছিলো বলে এর নাম চিপকো আন্দোলন। আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ১৯৭৩ সালে স্বাধীন ভারতের উত্তরাখণ্ডে এই আন্দোলনটি শুরু হয়।

কারখানা স্থাপনের জন্য তৎকালীন আমলারা ১০০ গাছ কাটতে উদ্যোগী হন, যার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় গ্রামের দুই যুবক সুন্দরলাল বহুগুনা ও চন্ডীপ্রসাদ ভট্ট। গাছকে জড়িয়ে ধরে তারা এর বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের লক্ষ্য ছিল একটাই যেভাবে হোক গাছ ও বন নিধন বন্ধ করে পরিবেশ রক্ষা করা।

১৯৭৪ সালে সরকার কর্তৃক ২,০০০ গাছ কাটা হলে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং সুন্দরলাল বহুগুনা গ্রামে গ্রামে গিয়ে নারী, পুরুষ, ছাত্রদের এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আহ্বান জানান। ১৯৭২-৭৯ সালের মধ্যে দেড় শতাধিক গ্রাম চিপকো আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিল। উত্তরাখণ্ডে ১২টি বড় ও ছোটখাট অনেক বিক্ষোভ হয়। ১৯৮০ সালে সুন্দরলাল বহুগুনাসহ আরও কয়েকজন নেতা ভাগীরথী নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতা করেছিলেন, যা পরবর্তীতে ‘বীজ বাঁচাও আন্দোলন’ নামে পরিচিত। এটি আজও অব্যাহত রয়েছে। চিপকো আন্দোলনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মহিলা গ্রামবাসীর ব্যাপক অংশগ্রহণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ মাত্রই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় অনুভব হয়। পথের দু’ধারে বিস্তৃত ১০০-১৫০ বছর পূর্বের অনেক বৃক্ষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল আহ্বায়ক রাকিবুল ইসলামের ফেসবুক স্টাটাস মারফত গত দু’দিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু শক্তি কমিশনের গেট থেকে কালী মন্দিরের গেট পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য সড়কের দু’পাশের বড় বড় গাছ গুলো কেটে ফেলার দৃশ্যগুলো দেখে খুবই মর্মাহত হলাম।

ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে জাইকা ও বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক সহায়তায় এমআরটি-৬ প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত (২০.১ কিলোমিটার) নির্মিত হচ্ছে মেট্রোরেল। যার একটি অংশ শাহবাগ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা, টিএসসি ও দোয়েল চত্বর দিয়ে বের হয়ে যাবে।২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি ‘মেট্রোরেলের রুট বদলাও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঁচাও’ শীর্ষক ব্যানারে আন্দোলন শুরু হয়। ওই সময় ক্যাম্পাসে মানববন্ধন থেকে মেট্রোরেলের রুট পরিবর্তনের দাবি জানানো হয়। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও আন্দোলনে সমর্থন জানান।

এরপর ১৪ জানুয়ারি মেট্রোরেলের রুট বদলের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি লেখেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। চিঠিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রাষ্ট্রের উন্নয়নের বিপক্ষে নয় জানিয়ে বলা হয়, রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা ও যানজট নিরসনে মেট্রোরেল স্থাপন নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে এই যুগান্তকারী পদক্ষেপটি বাস্তবায়িত হলে রাজু ভাস্কর্যসহ ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারকচিহ্নগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ছাত্রসংগঠন তখন ছিলো মেট্রোরেলের রুট পরিবর্তনের এর পক্ষে ছিল।

২০১৬ সালের ১৮ জানুয়ারি বেলা সাড়ে ১১টার দিকে টিএসসির সামনে রাজু ভাস্কর্যের নিচে ‘মেট্রোরেল চাই’ শীর্ষক ব্যানারে মানববন্ধন করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক সাধারণ শিক্ষার্থী। ওই সময় টিএসসির সড়ক দ্বীপে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাদেরকে তাদের সাথে উপস্থিত থাকতে দেখা গিয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আবিদ আল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘মেট্রোরেলের পক্ষে-বিপক্ষে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি জানিয়ে আন্দোলন করেছে। এতে ছাত্রলীগের কোনও সম্পৃক্ততা নেই। তবে ঢাবি ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসের ওপর দিয়ে  যাওয়া মেট্রোরেলের পক্ষে।’

ভারতের চিপকো আন্দোলনে নারী-পুরুষেরা শিক্ষার আলো যারা পেয়েছিলোনা তারা প্রকৃতি তথা বৃক্ষকে বাঁচাতে বুক আগলে দাড়িয়েছিলেন বৃক্ষের সাথে। নিধন করতে হলে তাদেরকে হত্যা করে তবেই নিধন। আর শিক্ষার আলোক বর্তিকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশ তখন এসব বৃক্ষ নিধন, ইতিহাস-ঐতিহ্য স্মারককে তুচ্ছ্যতাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন ‘যুক্তিতে মুক্তি মেলেনা’।

আসলেই হইতো যুক্তিতে মুক্তি মেলেনা, কিছু বছর পর হইতো ঢাবির বুক চিড়ে চলবে মেট্রো রেল।কিন্তু, প্রকৃতি আমাদেরকে মাফ করবে তো?

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়