কোভিড-১৯ চিকিৎসায় রেমডেসিভির ড্রাগ কতটা কার্যকর?
চলমান মারাত্মক সংক্রমক সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগে বিশ্বে ১৪ মে ২০২০ তারিখ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৪৪ লক্ষ ২৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং মৃতের সংখ্যা ৩ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে (তথ্যসূত্রঃ জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সিস্টেমস সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং)। বাংলাদেশেও বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।
দ্য ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের প্রায় ১৫ শতাংশ মারাত্মকভাবে নিউমোনিয়ায় (ফুসফুসের তীব্র প্রদাহ) আক্রান্ত হচ্ছে এবং তাদের কৃত্রিম উপায়ে বাইরে থেকে ভেন্টিলেটরের সাহায্যে শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, কোভিড-১৯ রোগে মারাত্মক শ্বাসপ্রশ্বাস ব্যাহত ভেন্টিলেটর ব্যবহারকারীর অন্তত অর্ধেক রোগী মারা যাচ্ছে। ফলে হেলথ কেয়ার সিস্টেম বিশেষভাবে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) বিশাল চাপের সম্মুখীন হচ্ছে।
রেমডেসিভির/Remdesivir ড্রাগ (অন্য নাম GS-5734)) মূলত ইবোলা ও সংশ্লিষ্ট ভাইরাসগুলোকে প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্রের গিলিয়াড সায়েন্স কোম্পানি কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছিল। সায়েন্স ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, রেমডেসিভির হচ্ছে এডিনোসাইন এনালগের প্রোড্রাগ (প্রোড্রাগ অর্থ যে নিস্ক্রিয় যৌগ মানবদেহে বিপাকের মাধ্যমে সক্রিয় ড্রাগে রুপান্তরিত হয়)। রেমডেসিভির বিস্তীর্ণ স্পেক্ট্রমের (বর্ণালীর) এন্টি-ভাইরাল ড্রাগ।
ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, কোভিট-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাসের (সার্স-কোভ-২) বাহিরের আবরণে "স্পাইক প্রোটিনগুলো" ২০০২-২০০৩ সালের মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাসের চেয়ে অনেক বেশী সন্নিবিষ্ট হওয়ায় এবং উভয়ের স্পাইক প্রোটিনের গাঠনিক ভিন্নতা থাকায়, বর্তমানে সার্স-কোভ-২ ভাইরাস দ্বারা মানুষের দেহের কোষগুলো শক্তভাবে সংযুক্ত হওয়ার মাধ্যমে কোভিড-১৯ রোগ বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ।
এডভ্যান্সেস ইন ভাইরাস রিসার্চ জার্নালের গবেষণা অনুযায়ী, করোনাভাইরাস হচ্ছে আবরণ বিশিষ্ট RNA (Ribonucleic acid) ভাইরাস পরিবার যা মূলত মানুষের শ্বসনতন্ত্রে (নাক, গলা, ফুসফুস ইত্যাদি) সংক্রমণ করে। সংক্রমণের সময়, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের বাহিরের আবরণের ‘স্পাইক’ প্রোটিন মানুষের শ্বসনতন্ত্রের (নাক, গলা, ফুসফুস) এপিথেলিয়াল কোষের এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২ (এসিই ২) রিসেপটর প্রোটিনের সাথে সংযুক্ত হয়ে মানুষের কোষে প্রবেশ করে বংশবিস্তার (রেপ্লিকেশন) করে। ল্যাব গবেষণায় দেখা গেছে, রেমডেসিভির ড্রাগ মানুষের নাক ও শ্বাসনালীর এপিথেলিয়াল কোষে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের বংশবিস্তার (রেপ্লিকেশন) শক্তভাবে প্রতিহত করে।
সার্স-কোভ-২ সহ অন্যান্ন করোনাভাইরাসের রেপ্লিকেশনে (বংশবিস্তার) "আরএনএ ডিপেনডেন্ট আরএনএ পলিমারেজ" এনজাইম প্রয়োজন। রেমডেসিভির ড্রাগ এই এনজাইমকে ব্লক করে করোনাভাইরাসের বংশ বিস্তার বন্ধ/হ্রাস করে। রেমডেসিভিরের প্রধান কাজ হলো মানব কোষে ঢোকার পর ভাইরাস যে বংশবৃদ্ধি করে তা বন্ধ করে দেওয়া ও বংশবৃদ্ধির গতি কমিয়ে দেওয়া। বংশবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় আক্রান্ত রোগীর দেহে ভাইরাস লোড অনেক কমে যায়। ফলে তাদের হাসপাতালে অপেক্ষাকৃত কম দিন অবস্থান করতে হয়।
সায়েন্স ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় গবেষকগণেরা দেখিয়েছেন, টেস্ট টিউবে সেল কালচার ও ইদুরের দেহে পরীক্ষায় রেমডেসিভির ড্রাগ (GS-5734) সার্স-কোভ-১ ভাইরাসের রেপ্লিকেশন এনজাইমকে বাধাগ্রস্থ করে ভাইরাসের বংশবিস্তার ব্যাহত করতে সক্ষম হয়েছিল। সম্প্রতি সেল রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় পেট্রি ডিশে (in vitro) রেমডেসিভির প্রবলভাবে SARS-COV-2 ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করেছে। রেমডেসিভির ড্রাগ করোনাভাইরাসের আরএনএ শিকলে (RNA chains) প্রবেশ করে; ফলে শিকলের অকাল ভাঙ্গন (premature termination) ঘটে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যবিষয়ক সংবাদ ওয়েবসাইট স্টাট নিউজ ১৬ এপ্রিল ২০২০ তারিখে জানিয়েছে, গিলিয়াড সায়েন্সেস কর্তৃক আবিষ্কৃত রেমডেসিভির ড্রাগ (GS-5734) দিয়ে দ্য ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো মেডিসিন এর চিকিৎসকগণের নিবিড় পর্যবেক্ষন ক্লিনিক্যাল পরীক্ষামূলক চিকিৎসায় জ্বর ও শ্বসনতন্ত্রের গুরুতর লক্ষণযুক্ত সমস্যার মারাত্মক অসুস্থ কোভিড-১৯ রোগীরা দ্রুত আরোগ্য লাভ করেছে এবং প্রায়ই সকল রোগী এক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছে।
রোগীকে বিশ মিলিলিটার ভায়ালের একশত মিলিগ্রাম রেমডেসিভির ইনজেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো মেডিসিন সম্প্রতি গিলিয়াড সায়েন্সেস এর রেমডেসিভির দ্বারা ১২৫ জন কোভিড-১৯ রোগীর উপর তিনটি ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় (clinical trials) দুই ধাপে চিকিৎসা করে। রোগীদের মধ্যে ১১৩ জন মারাত্মকভাবে অসুস্থ ছিলেন। সকল রোগীকে প্রতিদিন রেমডেসিভির ইনফিউশন শিরায় প্রয়োগ করা হয়েছিল। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো এর সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ক্যাথলিন মুলেন কোভিড-১৯ রোগীদের রেমডেসিভির দ্বারা চিকিৎসায় ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালসের নেতৃত্ব দিচ্ছেন (তথ্যসূত্রঃ ১৬ এপ্রিল ২০২০ তারিখের যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যবিষয়ক সংবাদ ওয়েবসাইট স্টাট নিউজ)। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ক্যাথলিন মুলেন বলেন, "সবচেয়ে ভালো খবর হচ্ছে আমাদের অধিকাংশ রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছেন। এটি বিশাল। আমাদের মাত্র দুইজন রোগী প্রাণ হারান।"
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ক্যাথলিন মুলেন যখন রেমডেসিভির এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়্যালের ফলাফল সম্পর্কে অনুপ্রাণিত ছিলেন, তখন তিনি তাঁর সন্দেহ/দ্বিধা অনেক মন্তব্যের মাধ্যমে সুস্পষ্ট করেন। তিনি বলেন, নেগেটিভ দিকটি হলো কোভিড-১৯ মারাত্মক রোগীদের নিয়ে তাঁর নেতৃত্বে ট্র্যায়ালসে তুলনা করার জন্য একটি প্ল্যাসেবো গ্রুপ (placebo group) অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি (প্ল্যাসেবো গ্রুপ হচ্ছে শুধুমাত্র যে গ্রুপের রোগীদের স্বান্তনা দেওয়ার জন্য ওষুধের নামে অন্য কিছু দেওয়া হয়, রোগ নিরাময়ের জন্য নয়)। কিন্তু তিনি বলেন, ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় রোগীদের ওষুধ প্রয়োগের পর অনেক মাত্রার জ্বর দ্রুত কমতে শুরু করে। করোনায় আক্রান্ত সঙ্কটজনক অবস্থায় ভর্তির সময় অনেক রোগীর প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট থাকায় ভেন্টিলেটার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরা (ক্যাথলিন মুলেনের গবেষণা দল) দেখেছি, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালসে রেমডেসিভির ড্রাগ থেরাপি আরম্ভের এক দিন পর রোগীরা সুস্থ বোধ করায় ভেন্টিলেটার ব্যবহার প্রয়োজন হয় নাই। তিনি আরও বলেন, অধিকাংশ মারাত্মকভাবে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ছিল এবং অধিকাংশ সুস্থ হয়ে ছয় দিনেই হাসপাতাল ত্যাগ করেছে। তাই ১০ দিনের ট্রায়ালসে অধিকাংশ ১০ দিনের আগে সুস্থ হয়েছে। খুব সামান্য রোগী, মাত্র তিন জন দশ দিনে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেছে (তথ্যসূত্রঃ ১৬ এপ্রিল ২০২০ তারিখের যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যবিষয়ক সংবাদ ওয়েবসাইট "স্টাট" নিউজ)।
এক বিবৃতিতে ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো মেডিসিন বলেছে, ‘এ মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না এবং তা বৈজ্ঞানিকভাবে যুক্তযুক্ত নয়।’ ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর রেমডেসিভির এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়্যালের সম্পর্কে স্ক্রিপস রিসার্চ ট্রান্সলেশনাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক এরিক টপল বলেছেন, এটা উৎসাহব্যঞ্জক। মারাত্মক রোগীদের ক্ষেত্রে মৃত্যুঝুঁকি থাকে বেশি। যদি ১১৩ জন রোগী এ ক্ষেত্রে সুস্থ হওয়ার ছাড়পত্র পায় তবে তা ওষুধের কার্যকারিতার ইতিবাচক ইঙ্গিত।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনের এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং মারাত্মক লক্ষণযুক্ত ৫৩ জন রোগীর ক্ষেত্রে রেমডেসিভির শতকরা ৭০ ভাগ কার্যকর। কিন্তু ২৫% ক্ষেত্রে কিডনি ও লিভারের জটিলতাসহ নানা ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের গিলিয়াড সায়েন্সের রেমডেসিভির ইনফিউশন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রেও গবেষণা করা হয়। এই গবেষণা ১০৬৩ জন রোগীর উপর করা হয়। এখানে দুটি ভাগ করা হয়। একটি দলকে রেমডিসিভির দেয়া হয়েছিল, অপর দলটিকে রেমডেসিভির দেয়া হয়নি (প্ল্যাসেবো গ্রুপ)। দেখা গেছে, যাদের ১৫ দিনে সুস্থ হবার কথা তারা ১১ দিনে সুস্থ হয়েছে।.
উপকার-ঝুঁকি (Benefit-Risk) বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের গিলিয়াড সায়েন্স কোম্পানির অ্যান্টি-ভাইরাল ড্রাগ রেমডেসিভিরকে কোভিড-১৯-এর চিকিৎসায় এমারজেন্সি (জরুরী) ভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে আমেরিকার ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর বাংলাদেশের আটটি ফার্মাসিউটিকাল প্রতিষ্ঠানকে 'রেমডেসিভির' উৎপাদন করার অনুমতি দিয়েছেন। তবে এখনও কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এই ড্রাগের সফলতা সম্পূর্নভাবে নিশ্চিত হয়নি।
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর কোভিড-১৯ রোগের উপসর্গ রয়েছে এমন অসংখ্য রোগীর ওপর রেমডেসিভির ওষুধটির পরীক্ষা চলছে। এছাড়া মধ্যম পর্যায়ের কোভিড-১৯ রোগের উপসর্গ রয়েছে এমন অনেক রোগীর মধ্যেও ওষুধটির পরীক্ষা হচ্ছে। স্ক্রিপস রিসার্চ ট্রান্সলেশনাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক এরিক টপল বলেছেন, আরও গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। অধিকতর বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যাপক মানুষের মধ্যে পরীক্ষায় নিশ্চিত হতে পারলে রেমডেসিভির কোভিড-১৯ চিকিৎসায় পরীক্ষিত ওষুধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।
লেখক: প্রফেসর, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়