কোভিড-১৯ পরিস্থিতি এবং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার

  © প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাস থেকে সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯ সামাল দিতে গোটা বিশ্বে আজ টালমাটাল। বাংলাদেশেও এ রোগ জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। কোভিড-১৯ সামাল দিতে গিয়ে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের চিকিৎসাব্যবস্থার দুর্বলতা ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা প্রকটভাবে দৃশ্যমান। এ খাতে দুর্বলতা ভবিষ্যতে দেশের সম্ভাব্য বিভীষিকাময় পরিস্থিতি নিয়ে অনেককেই শংকিত করে তুলেছে।

তবে করোনাভাইরাস বোধহয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার পাশাপাশি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাও আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে। এর কয়েকটি দিক আছে। প্রথমত, শিক্ষার গুনগত মান। একজন শিক্ষিত মানুষের মেধা, বুদ্ধি, চিন্তাভাবনা সবকিছুই সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে সহায়ক হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষা মানুষের মননের বৃদ্ধি ঘটায়। রাষ্ট্র, সমাজের ক্রান্তিকালে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব হচ্ছে আপাতত প্রধান উপায়।

তাই সরকার যথাযথভাবেই সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করল। কিন্তু কি দেখা গেল? মানুষ দলে দলে বাড়ি ছুটছে, এমনকি ছুটি কাটাতে ভ্রমণে বেরোচ্ছে। পুলিশ-সেনাবাহিনী দেখে মানুষ ভয়ে লুকাচ্ছে, তারা চলে গেলে আবার সব স্বাভাবিকভাবে চলছে। এ ভিড়ে নিশ্চয়ই অনেক প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত মানুষও আছে। তাহলে? অর্থাৎ আমরা জীবনমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছি না। আমরা শিক্ষিত হয়েও সচেতন নাগরিক হতে পারছি না। আমরা হয়ত সনদ নিয়ে চাকরির বাজারে প্রবেশের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করি। কিন্তু শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু এটা হতে পারে না। তাই কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সচেতন, বিবেকবান মানুষ হিসেবে গড়ার শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হবে।

দ্বিতীয়ত, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আরও বাস্তবমুখী শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে হবে। জীবনে চলতে এবং বিভিন্ন বিপদের সময় মানিয়ে নিতে ব্যবহারিক জ্ঞান প্রয়োজন। যেমন, বিদেশে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ফায়ার ড্রিল হয়। আমাদের দেশে নিয়মিতভাবে এগুলো হলে তার ফলস্বরূপ অগ্নিকান্ডে ব্যাপক প্রাণহানি কমানো যেত। তদরুপ, স্কুল কলেজে সাঁতার শেখা বাধ্যতামূলক হলে লঞ্চডুবিতে প্রাণহানি কমানো যেত।

ব্যবহারিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার আরেকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, ছোটবেলা থেকেই আমরা ইংরেজি ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করলেও দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষই সঠিক ইংরেজি ব্যবহার করতে পারেনা। এর মূল কারণ, বলা বা লিখা চর্চার চেয়ে এ প্লাস পাওয়াই যেন ইংরেজি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। আবার, বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে লকডাউনে পারিবারিক অশান্তি বাড়ছে। অর্থাৎ মানুষ মানসিকভাবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারছে না। এজন্য শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করতে হবে।

তৃতীয়ত, দেশের শিক্ষায় প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধন আরও বাড়াতে হবে। লকডাউনে যখন আমরা সবাই বদ্ধ, তখন ইন্টারনেট-এর ওপরই সব নির্ভরশীল। তাই অনলাইন ক্লাস থেকে শুরু করে পরীক্ষা, উত্তরপত্র মূল্যায়ন ও অনলাইন-এ নম্বরপত্র জমাদান ইত্যাদি বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রাম-গঞ্জে পৌঁছতে হবে। যেমন, এসএসসির ফলপ্রকাশে বিলম্ব হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে নম্বরপত্র সময়মত না পৌঁছানো। কিন্তু প্রত্যেক বোর্ডভিত্তিক যদি অনলাইন পোর্টাল থাকত, যেখানে নম্বরপত্র প্রবেশ করিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ফলাফল তৈরি হয়, তবে সহজেই এ সমস্যার সমাধান করা যেত।

দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলেও সরকারী বিভিন্ন সংস্থা যেমন ইউজিসি থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছেনা, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এক্ষেত্রে পেছানো। বর্তমান এ পরিস্থিতি যে সাময়িক নয়, তা বুঝাই যাচ্ছে। তাই প্রাত্যহিক জীবনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাইকেই শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে সক্রিয় থাকতে হবে।

পরিশেষে, দেশের উচ্চশিক্ষাকে চাকরিমুখী থেকে গবেষণামুখী ও উদ্যোক্তামুখী করতে হবে। দেশের ক্রান্তিলগ্নে গবেষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আজকাল প্রতিদিন দুপুরে আমরা গবেষকদের মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকি, তাদের সংবাদ সম্মেলন থেকে ভাল কোন খবর পাওয়ার আশায়। করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক-এর জন্য আজ সারা বিশ্ব গবেষকদের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু আমাদের দেশ এই গবেষণায় অবদান রাখতে পারছে না। আমরা তাকিয়ে আছি উন্নত দেশের দিকে। কারণ আমাদের দেশে গবেষণা বলতে সেভাবে কিছু নেই।

ছেলেমেয়েরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকে যেখানে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান আরোহন করবে, সেখানে তখন তাদের হাতে আজকাল বিসিএস প্রস্তুতির বই থাকে। বড়ই দুর্ভাগ্য। করোনাভাইরাস পরবর্তী পৃথিবী চরম অর্থনৈতিক মন্দায় পড়বে বলে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। চাকরির বাজার অনেকাংশেই ধ্বসে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রেই প্রায় দুই কোটির উপর লোক চাকরি হারিয়েছে। সেদিক দিয়ে, বাংলাদশে চাকরির বাজার আরও সংকটে পড়বে। অধিক জনসংখ্যার এই দেশে সরকারি-বেসরকারি চাকরির সমন্বয় নেই। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার আশায় দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা দিনের দিনের পর দিন সরকারি চাকরির আশায় বেকার বসে থাকে। ফলে, বাড়ছে বেকারত্ব সমস্যা।

পরবর্তী পরিস্থিতিতেও এমন চললে তা দেশের বেকারত্ব সমস্যা আরো বাড়াবে। তাই ব্যবহারিক আর সৃজনশীল শিক্ষার মাধ্যমে দেশের মেধাবীদের স্বাবলম্বী, গবেষণামুখী এবং উদ্যোক্তামুখী করতে হবে। বিপদ থেকে শিক্ষা নেয়াই মানুষের কাজ। তা না হলে বিপদ কাটানো যেমন কঠিন, তার পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়া আরও কঠিন। তাই দেশের স্বাস্থ্যখাতের পাশাপাশি শিক্ষাখাতের সংস্কারও আজ অতীব জরুরি। কোভিড-১৯ আমাদের সে বার্তাই দিচ্ছে।

লেখক: শিক্ষক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি


সর্বশেষ সংবাদ