১৩ মে ২০২০, ০৮:৩২

করোনা রোধে নতুন জীবাণুমুক্তকরণ চেম্বার বিপজ্জনক

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যত বাড়ছে, ততই মানুষের মধ্যে এর প্রতিকারে বিভিন্ন উদ্ভাবনী কার্যক্রম পরিলক্ষিত হবে—এটাই স্বাভাবিক। তবে নতুন কিছু উদ্ভাবন করে যেন ক্ষতি না বাড়ে, সেদিকে লক্ষ রেখে অবশ্যই এগুলো ব্যবহার করতে হবে। যেকোনো নতুন আবিষ্কারের পর এর কার্যকারিতা পরীক্ষা এবং ক্ষতিকর দিকটা দেখা আবশ্যক।

ইদানীং সিলেট ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিসইনফেক্টিং বা জীবাণুমুক্তকরণ চেম্বারের নামে যা দেওয়া হয়েছে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁদের পিপিই পরেই চেম্বারের একদিকে ঢুকে ৩০ সেকেন্ড অপেক্ষা করে স্বয়ংক্রিয় জীবাণুনাশক স্প্রে নিয়ে অন্যদিকে বের হয়ে গেলে তাঁরা জীবাণুমুক্ত হবেন এবং পিপিই পরা অবস্থায় নিশ্চিন্তে নিজ ঘরে ফিরে যেতে পারবেন। সিলেটের প্রদত্ত একটি ফটকের মতো চেম্বারে ঢুকলেই মেশিন থেকে অনেক স্প্রে দিয়ে ৩ শতাংশ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ছিটানো হবে। তাতে বলা হচ্ছে, পিপিইতে থাকা এবং আপাদমস্তকের সব করোনাভাইরাসই মারা পড়বে। ব্যাপারটা এখনই তলিয়ে দেখা ভীষণ জরুরি। এতে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি না অথবা কোথায়, কীভাবে এর উপকারিতা বা অপকারিতার পরীক্ষা করা হয়েছে, তা জানা জরুরি।

প্রথমত, করোনাভাইরাস মানুষের নাক মুখ ও চোখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। তাই লোকারণ্য জায়গাতে মাস্ক পরা অত্যন্ত জরুরি। হাসপাতালে করোনা রোগী দেখার জন্য ওয়ার্ডে বা কেবিনে ঢুকলে মাস্ক, গগলস ও গাউন পরে রোগীকে সেবা দিতে হবে। গাউন পরে রোগীর কেবিন বা ওয়ার্ড থেকে বের হওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। গাউন খুলে দরজার পাশে রাখতে হবে। তাই কাপড়ের গাউন ব্যবহার করলে তা সাবান–পানি দিয়ে ধুয়ে বারবার পরিধান করা যাবে। আর কাগজের ডিসপোজিবল গাউনগুলো একবারের বেশি ব্যবহার কর যাবে না। গাউনটা কাজ শেষে সন্তর্পণে খুলতে হবে। কারণ, যদি ঝাড়া দেওয়া হয়, তা থেকে ভাইরাস উড়তে পারে এবং নিজেকে এবং কাছের মানুষকে সংক্রমণ করতে পারে। পিপিই পরে বাড়িতে কেন, হাসপাতালেও ঘোরাফেরা সম্পূর্ণ নিষেধ।

পর্যাপ্ত পিপিই না থাকার কারণে সারা বিশ্বের মানুষ এর বারবার ব্যবহারের জন্য অনেক চিন্তাভাবনা করছে। নাক, মুখ ও চোখের মধ্য দিয়ে করোনার সংক্রমণের জন্য মাস্কগুলো অত্যন্ত জরুরি। তাই পিপিই বারবার ব্যবহারে জন্য আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) তিনটি প্রক্রিয়া উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে আলট্রাভায়োলেট লাইট, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বাষ্প আর অতিমাত্রায় গরম বাষ্প ব্যবহার করা। সাধারণত ৩ শতাংশ তরল হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড দিয়ে টেবিল, চেয়ার, হাতল, বাথরুম ইত্যাদি সম্পূর্ণভাবে ভাইরাসমুক্ত করা যাবে।

কাপড় বা কাগজের পিপিই সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। কারণ, সেগুলোর মধ্যে অনেক ছোট ছোট ছিদ্র থাকে এবং কাপড়ের ওপর তা কার্যকরী হবে না। সে জন্য কাপড়ের গাউনকে পানির ভেতর সাবান দিয়ে গরম পানিতে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করার কথা মার্কিন সিডিসির গাইডলাইনে বলা হয়েছে। সাবান–পানি শুধু ভাইরাসকে ধুয়ে সরিয়ে দেয় না, সাবান ভাইরাসকে প্রথমে ধ্বংসও করে। মেডিকেল মাস্ক যেমন এন৯৫ মাস্কের জীবাণুনাশের জন্য ৩০ শতাংশ (১০ গুণ বেশি) হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড থেকে বাষ্প ছড়িয়ে একটি বন্ধ ঘরে ৪০ মিনিটের মতো রাখলে সেটা আবার জীবাণুমুক্ত করা যায়। সে জন্য আমেরিকায় এর প্রক্রিয়া মাত্র শুরু হচ্ছে। সেই বাষ্প অনেকক্ষণ সংস্পর্শে থাকলে তবে তা মাস্কের ভেতরের ছিদ্রগুলোতে ঢুকতে পারবে। তাই শুধু ৩ শতাংশ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ছিটিয়ে আপাদমস্তক কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জীবাণুমুক্ত করার এই নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করা শুধু স্বাস্থ্যকর্মীদের এবং তাঁদের সংস্পর্শে আসা মানুষকে ভীষণ বিপদের মধ্যে ফেলে দেওয়া। এই মিথ্যা আশ্বাস হবে মারাত্মক ক্ষতিকর।

এই পদ্ধতি যদি কার্যকর হয়, তবে এর কার্যকারিতার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এবং ক্ষতিকর দিকটি অবশ্যই আগে দেখে নিতে হবে। এই দুর্যোগে আমরা চাই নতুন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে মানুষের উন্নত সেবা প্রদান করা, তবে তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। যেমন করে বাংলাদেশে কিছু ভেন্টিলেটর, ডায়াগনস্টিক কিট ইত্যাদি প্রাথমিক পর্যায়ে পরীক্ষিত হচ্ছে। আমি আশা করব, এর উদ্ভাবকেরা অনতিবিলম্বে এর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফল জানিয়ে সরকারের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে এই পদ্ধতি স্বাস্থ্যকর্মীদের রক্ষার জন্য ব্যবহার করবেন। নতুবা এই অতি উৎসাহী প্রচেষ্টা হিতে বিপরীত হবে।

লেখক: অধ্যাপক, মেডিসিন অ্যান্ড নেফ্রোলজি, টেম্পলে বিশ্ববিদ্যালয়, ফিলাডেলফিয়া। প্রফেসর ইমেরিটাস, ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র